খুব বেশি দিন আগের কথা বলছি না। আমাদের ছোটবেলাতেও আমরা দেখেছি, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুলের অনেক শিক্ষক গ্রামে বসবাস করতেন। গ্রামীণ সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। গ্রামে বাড়ি, গ্রামে চাকরি করে এবং গ্রামে বসবাস করে বর্তমানে এ রকম প্রাথমিক-মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক খুঁজে পাওয়া খুবই দুষ্কর হয়ে গেছে। আগে যে মানুষগুলো তাদের সন্তানদের কলেজে পড়ানোর জন্য শহরে পাঠাতেন, সেই শ্রেণির মানুষগুলোই এখন তাদের বাচ্চাদের প্রাথমিক স্তর থেকেই শহরের স্কুলে পড়ানোর জন্য ছেলেমেয়ের সঙ্গে নিজেরাও গ্রাম ছাড়েন। গ্রামগুলো এখন সচেতন ও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শূন্য হওয়ার উপক্রম। এতে গ্রামগুলোর নিজস্ব 'ইতিবাচক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা' প্রায় ভেঙে পড়েছে। উল্লেখিত শিক্ষকরা নিজেদের চাকরিটা পার্টটাইম করে নিয়েছেন। গ্রামের বিশেষত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে এখন পড়াশোনা হয় না বললেই চলে। গ্রামীণ প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষক নিজেরাও ভালো করে জানেন তাদের নিজেদের করুণ অবস্থার কথা। তাই তারা তাদের বাচ্চাদের নিজেদের স্কুলে না পড়িয়ে শহরের কিন্ডারগার্টেনে পড়ান। গত দুই-এক দশকে গ্রামীণ এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে যারা শিক্ষক হয়েছেন, তাদের তাৎপর্যপূর্ণ একটা অংশের কেউ স্থানীয় কোনো নেতার স্ত্রী, কেউ কোটাধারী কিংবা কেউ সাবেক ছাত্রনেতা; গ্রামের গরিব মানুষের সন্তানদের বঞ্চিত করে নিজেদের জীবনকে নিরাপদ করেছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্ররাই মূলত এই অযোগ্য প্রার্থীদের লিখিত পরীক্ষায় পাস করানোর জন্য টাকার বিনিময়ে প্রক্সি দেয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা আজকে যারা কোটা সংস্কারের জন্য আন্দোলন করছে তাদেরও বুঝতে যে, তারাও এ ক্ষেত্রে কোটা বাস্তবায়নকে এগিয়ে নিতে সহযোগী শক্তি হিসেবে কাজ করেছে বা করছে। তাছাড়া অযোগ্য কোটাধারীরা অত সহজে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারত না। মেধাবী এই ছাত্রদের কিছুটা নিজেদের তৈরি করা ফাঁদে নিজেদের আটকে পড়ার মতো অবস্থা। মানুষ টাকা দিয়ে চাকরি নেওয়াটাকে স্বাভাবিক করে ফেলেছে। প্রক্সি দিয়ে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়াটাকে মানুষ কোনো অন্যায় মনে করছে না। একদল এই অন্যায় কাজটা নিজেরা করতে পেরে আত্মতুষ্টিতে ভুগছে। যারা প্রক্সি নিতে পারছে না তারাও চেষ্টা করছে এই অন্যায় কাজে সফল হওয়ার জন্য। এবার এলাকায় গিয়ে শুনলাম, সম্মানিত কিছু ব্যক্তির স্ত্রীদের চাকরির লিখিত পরীক্ষায় অসাধু উপায় অবলম্বনের অপরাধে বাচ্চাসহ তাদের কিছু দিন হাজত খাটতে হয়েছে। যারা হাজত খাটল, তাদের ফ্যামিলি কি এ অবস্থায় লজ্জিত হয়েছে? না হলেও এখন আর অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
শিক্ষার মান ও পরিবেশ বিবেচনায় না নিয়েই বয়স উত্তীর্ণ অযোগ্য ও অকর্মা অনেক লোক শিক্ষক হিসেবে নিজেরাই নিজেদের মতো বাংলাদেশে প্রচুর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলেছিল বা খুলছে। এই প্রতিষ্ঠানগুলো এখন সস্তা রাজনৈতিক আবেগে জাতীয়করণ হয়েছে বা হচ্ছে। প্রকৃতই কি এই প্রতিষ্ঠানগুলো জাতীয়করণ হয়েছে? না, আমার মতে, জাতীয়করণ হয়েছে মূলত উলিল্গখিত অযোগ্য শিক্ষকমণ্ডলীর চাকরি। ফলে বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো হয়েছে অসম-মানসম্পন্ন। গরিব মানুষের সন্তানদের ভালো মানের শিক্ষা নিয়ে গ্রাম থেকে বের হয়ে আসার সম্ভাবনা একেবারেই কমে গেছে; নেই বললেই চলে। এভাবেই মূলত ভেঙে পড়েছে গ্রামীণ শিক্ষা ব্যবস্থা।
এখনও কিছু মেধাবী ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা কলেজ থেকে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করে এসব গ্রামের স্কুলে চাকরি নিচ্ছেন। কিন্তু স্কুলের এই চাকরিটা তাদের প্রত্যাশিত ছিল না; প্রত্যাশিত চাকরি না পেয়ে অনেকেই বাধ্য হয়ে স্কুলে ঢুকছেন। তাদের মধ্যে একটা অংশ স্কুলের চাকরির পাশাপাশি প্রত্যাশিত চাকরির চেষ্টা করে; সুযোগ পেলেই অন্যত্র চলে যায়। সুযোগ না পাওয়ার কারণে যে অংশটার বাধ্য হয়ে শেষ পর্যন্ত স্কুলেই থাকতে হচ্ছে, তারা যোগ্য হলেও স্কুলের ছাত্রদের প্রতি আন্তরিক না। তারা সকালে টিউশনি করিয়ে তাড়াহুড়ো করে স্কুলে এসে আবার দুপুরের মধ্যে স্কুল পালায়। এখন ছোট বাচ্চারা যতটা না স্কুল পালায়, তার চেয়ে শিক্ষকরাই মনে হয় বেশি পালান। দিনের বাকি সময়টা টিউশনি নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। তাই এখন এলাকাতে গিয়ে কিছু নামিদামি শিক্ষকের নাম শুনি, যারা টাকা উপার্জন করে নাম করেছেন; শুনি নির্দিষ্ট কিছু শিক্ষক টিউশনি করিয়ে মাসে এক-দুই লাখ টাকা আয় করছেন। গরিবের সন্তানরা টাকার অভাবে এদের এই বাণিজ্যিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
আমরা যখন প্রাথমিক-মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়তাম, তখনও স্কুলগুলোতে নিম্নমানের কিছু অযোগ্য শিক্ষক যে ছিলেন না, তা নয়। কিন্তু এদের মাঝে দুই-একজন ভালো, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, আন্তরিক ও নামিদামি শিক্ষক ছিলেন, যারা এই নিম্নমানের শিক্ষকদের ক্ষতি পুষিয়ে ছাত্রদের একটা ভালো দৃষ্টিভঙ্গি দিতেন কিংবা দিতে সক্ষম ছিলেন। আমরা যারা গ্রামে কিংবা মফস্বলে পড়াশোনা করেছি, তারা কিছু ভালো শিক্ষকের নাম জানতাম, যাদের নামে স্কুলগুলো পরিচিত ছিল কিংবা স্কুলের নাম এলে তাদের নাম আসত। তারা শিক্ষকতাকে বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখতেন না; স্কুলের ছাত্রদের জন্য জীবন উৎসর্গ করে দিতেন। চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করার পরও শুনেছি, তারা ভুল করে স্কুলে ঢুকে পড়তেন; স্কুলের সামনের দোকানগুলোতে বসে স্কুলের দিকে তাকিয়ে থাকতেও দেখেছি। তারা স্কুলে ছাত্র পড়ানোটাকে চাকরি হিসেবে নিতেন না, ছাত্রদের তারা নিজের সন্তান মনে করতেন। অবসরে গিয়ে তাদেরকে মানসিকভাবে ভেঙে পড়তে শুনেছি। ভবিষ্যতে যারা অবসরে যাবেন, তাদের অবস্থা নিশ্চয়ই এ রকমটা হবে না! এখনকার শিক্ষকরা শিক্ষকতার পাশাপাশি নিজ মালিকানার ব্যবসা প্রস্তুত রাখেন। তারা অবসরে গিয়ে বরং পেনশনের এই মোটা অঙ্কের টাকা নিজের প্রস্তুত করা ব্যবসার কাজে লাগিয়ে আরও বেশি লাভবান হবেন। মফস্বলের শিক্ষা উন্নয়নের বর্তমান অবস্থা নিয়ে আমার এই উপলব্ধি এলাকাভেদে ভিন্ন ভিন্ন বাস্তবতায় বিভিন্ন রকম হতে পারে।
শিক্ষার উন্নয়নের জন্য যে এ খাতে বাজেট বৃদ্ধি প্রয়োজন, এ নিয়ে সভ্য পৃথিবীতে কোনো বিতর্ক নেই; থাকার কথাও না। কিন্তু ওপরে বর্ণিত এই যদি হয় একটি দেশের গণশিক্ষার প্রকৃত অবস্থা, এতে সরকারি বাজেট বৃদ্ধি করে কী হবে? বাংলাদেশের শিক্ষায় উপরোক্ত উন্নয়ন ও অপ-উন্নয়নের যুগপৎ অবস্থানের বর্তমান বাস্তবতায় এ খাতে বাজেট বৃদ্ধি যে শিক্ষার প্রকৃত উন্নয়নের চেয়ে অপ-উন্নয়নকে বেশি তাড়িত করবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
লেখক : সভাপতি, পরিসংখ্যান বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
সূত্র: সমকাল