সাতক্ষীরা পাবলিক স্কুল, বাইরে চাকচিক্য ভেতরে ফাঁকা!

সাতক্ষীরা প্রতিনিধি |
সাতক্ষীরা সদর আসনের জাতীয় পার্টির সাবেক এমপি আব্দুল জব্বারের কমিউনিটি সেন্টার এখন সাতক্ষীরা পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে! সাইনবোর্ডে ‘পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ’ লেখা থাকলেও বাস্তবতা কিন্তু ভিন্ন।
 
স্থানীয়রা বলছেন, একদিকে প্রতারণার ফাঁদ, অন্যদিকে টাকা হাতানোর মেশিন হিসেবে ‘পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ’ নামটি ব্যবহার করা হচ্ছে।

অভিভাবকদের সরল কথা, ‘টাকা থাকলে ভর্তি করেন এখানে, টাকা না থাকলে অন্য কোথাও নিয়ে বাচ্চাকে ভর্তি করান এখানে শুধু বাইরে চাকচিক্য, ভেতরে ফাঁকা। আছে শুধু স্টাইল, কাজের কিছুই নেই।’ সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বেশ কয়েকজন অভিভাবক এভাবেই তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।

শহরের মিলগেট এলাকার এক অভিভাবক নাম প্রকাশ না করে বলেন, আমার মেয়েকে গত এক বছর আগে এখানে ভর্তি করেছিলাম। মেয়েটাও খুব মেধাবী। এখানকার বাইরের অবস্থা দেখে মনে করেছিলাম ভালো হবে কিন্তু উল্টো হয়েছে। ভালোর থেকে আরও খারাপ হয়েছে। এখানে কোনো বোর্ড বই ফলো করা হয় না, শুধু শিট ধরিয়ে দেয়া হয়। সেই শিট পড়তে হবে। আর শুধু টাকা দাও।
 
‘মেয়ে প্রতিদিন স্কুলে যাবে কিন্তু বাড়িতে মোবাইলে ম্যাসেজ যাবে, মেয়ে স্কুলে আসেনি। ডিজিটাল হাজিরা করেছে সেটাও ভুলভাল। মেয়ে স্কুলে থাকে আর বাড়িতে ম্যাসেজ যায়, মেয়ে স্কুলে আসেনি।’
 
তিনি আরও বলেন, ‘এদের শুধু টাকা দাও, কিন্তু লেখাপড়ার খোঁজ নেই। সেই টাকা দিয়ে বাস কিনবে, চাকচিক্য করবে। প্রত্যেক মাসে বাড়তি দিতে হবে দুই হাজার টাকা। আমি টাকা-পয়সা সব পরিশোধ করে দিয়েছি। এখানে আর মেয়েকে পড়াব না। এ বছর এখান থেকে ২০০ বাচ্চা বের হয়ে যাবে। একবার ভর্তি করলে এক বছর পর আর কেউ এখানে বাচ্চাদের রাখে না। এক কথায়, এখানে ভর্তি করালে বাচ্চার ভবিষ্যৎ শেষ।’
 
শহরের সুলতানপুর এলাকার শেখ আবু তুষার। মেয়ে ফাতেহা কাইয়ুম তোহাকে পড়াচ্ছেন সাতক্ষীরা পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে। তোহা জুনিয়র থেকে এখন স্ট্যান্ডার্ড ওয়ানের শিক্ষার্থী।
 
তোহার বাবা শেখ আবু তুষার জানান, সাত হাজার টাকা দিয়ে মেয়েকে এখানে ভর্তি করেছিলাম। গাড়ি ভাড়া বাবদ মাসে নেয় ২০০ টাকা, বেতন ১২০০ টাকা, ডিজিটাল হাজিরা বাবদ মাসে ১৮০ টাকা। রয়েছে আনুষঙ্গিক খরচ। বিত্তশালী বাবারা ছাড়া তার সন্তানকে এখানে পড়াতে পারবেন না।
 
সাতক্ষীরা পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ নামের ওই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ১০০ গজ দূরে অবস্থিত জেলা শিক্ষা অফিসারের কার্যালয়। তার সামনেই সাতক্ষীরা সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়, টাউন গার্লস হাই স্কুল। একশ গজের মধ্যেই তিনটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। অনেকের অভিযোগ, শিক্ষানীতি উপেক্ষা করে সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একশ গজের মধ্যেই করা হয়েছে বেসরকারি পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজটি। যেখানে শিক্ষা নয়, চলে শিক্ষা নিয়ে ব্যবসা।
 
তিনি অভিযোগ করেন, প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক আলাউদ্দীন ফারুকী প্রিন্স প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই চালিয়ে যাচ্ছেন শিক্ষা নিয়ে দুর্নীতির এ কার্যক্রম। পরিচালক প্রিন্সের এক ভাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক অপর ভাই হোস্টেল সুপার। অভিভাবকদের জিম্মি করেই চলে জুনিয়র শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার নামে টাকা উত্তোলনের ব্যবসা।
 
সাতক্ষীরা বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সমরেশ কুমার দাশ বলেন, সাতক্ষীরা পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ পরিচালনার অনুমতির জন্য আমার কাছে লিখিত নিতে এসেছিল। তবে আমি তাদের ফিরিয়ে দিয়েছি। কীভাবে সরকারি একটা প্রতিষ্ঠানের পাশেই আরেকটি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে, আমি জানি না।
 
গড়ে তোলার পর আপনি কোনো পদক্ষেপ নিয়েছেন কি-না, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘না কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষই ব্যবস্থা নিতে পারেন। আমি কী ব্যবস্থা নেব?’
 
সাতক্ষীরা পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের পরিচালক আলাউদ্দীন ফারুকী প্রিন্সের কাছে জানতে চাওয়া হয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে উঠে আসা বিভিন্ন অভিযোগের কথা। তিনি সাফ বলেন, পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে ৫০০ শিক্ষার্থী রয়েছে। একেক জনের কাছ থেকে একেক রকম টাকা নেয়া হয়। বাকি অভিযোগের বিষয়ে কোনো উত্তর না দিয়ে তিনি অফিসে আসতে বলেন। সেখানে বিস্তারিত জানাবেন বলে এ প্রতিবেদককে জানান।
 
সামনে সাতক্ষীরা বালক উচ্চ বিদ্যালয় পেছনে পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ কীভাবে হলো- এ প্রশ্নের উত্তর নেই জেলা শিক্ষা অফিসার এস এম আব্দুল্লাহ আল মামুনের কাছেও। তিনিও সরল ভাষায় জানালেন, শিক্ষা বোর্ড কীভাবে পাঠদানের অনুমতি দিয়েছে, সেটা আমি বলতে পারব না।
 
আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘আমার কাছেও এসেছিল, শিক্ষকদের ট্রেনিংয়ে জন্য। তবে আমি না করে দিয়েছি। সেখানে কীভাবে শিক্ষক নিয়োগ হয়, সেটা আমাদের জানা নেই। তাদের নিজস্ব কোনো জমি আছে কি-না, সেটাও জানি না। একটা সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আড়াই কিলোমিটার দূরে আরেকটি হওয়ার কথা কিন্তু শহরের ঘনবসতির কারণে দূরত্ব একটু কম হতে পারে। তবে এত কাছে কী করে হলো, আমার জানা নেই।’
 
তিনি বলেন, তাদের কলেজের কোনো অনুমোদন বা স্বীকৃতি নেই। চলতি বছর দশম শ্রেণির অনুমোদন পেয়েছে। এর আগে বাইরের স্কুল থেকে ওই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা দেওয়ানো হতো। সরকারি-বেসরকারি সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য একটি সেশন চার্জ নির্ধারণ করা রয়েছে। তারা যদি এর বাইরে কোনো টাকা উত্তোলন করেন তবে বিষয়টি তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নেয়া হবে।
 
পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ নামের ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমের বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা হবে বলেও জানান তিনি।

পাঠকের মন্তব্য দেখুন
নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha নারীদের আইসিটিতে দক্ষ হতে হবে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল - dainik shiksha ডিগ্রি তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির সভা ৩০ এপ্রিল সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি - dainik shiksha সনদের কাগজ কীভাবে পায় কারবারিরা, তদন্তে নেমেছে ডিবি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ - dainik shiksha বুয়েটে সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়লো হিজবুত তাহরীরের লিফলেট বিতরণ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা - dainik shiksha ফাঁসপ্রশ্নে প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ, নজরদারিতে যারা এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস - dainik shiksha এইচএসসির ফল জালিয়াতির অডিয়ো ফাঁস please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0053169727325439