সাধারণ ক্যাডারে এত বিশেষায়িত ডিগ্রিধারী কেন? প্রশ্ন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিবের

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

দীর্ঘ তিন বছর প্রচেষ্টা চালিয়ে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) ৩৮তম বিসিএস পরীক্ষার ভিত্তিতে সরকারের বিভিন্ন ক্যাডার পদে ২ হাজার ২০৪ জন প্রার্থীকে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করেছে। তাঁদের মধ্যে ৬১৩ জন সাধারণ ক্যাডার পদের জন্য: যেমন প্রশাসন, পররাষ্ট্র, পুলিশ, শুল্ক, কর, তথ্য ইত্যাদি। অবশিষ্ট পদগুলোর মধ্যে আছে প্রকৌশল, চিকিৎসা, শিক্ষা, কৃষিসহ সব বিশেষায়িত ক্যাডার। সাড়ে তিন লাখ প্রার্থীর মধ্য থেকে বাছাই করে তাঁদের নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে। সুপারিশপ্রাপ্তদের অভিনন্দন। রোববার (৫ জুলাই) প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও জানা যায়, এই বিসিএস পরীক্ষার একাধিক ভিন্নমাত্রার কথা এখানে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক। এক বছরের মধ্যে চাকরির বিজ্ঞপ্তি থেকে নিয়োগ, সবটাই শেষ হওয়ার কথা থাকলেও স্বাধীনতার পর থেকে কয়েকটি বিশেষ বিসিএস ব্যাচ ছাড়া তা হয়নি। প্রায় তিন-চার বছরই লাগত। তবে গত কয়েক বছরে সময়টা কমে দুই থেকে সোয়া দুই বছরে নেমে এসেছিল। ৩৮তম বিসিএস থেকে পিএসসি লিখিত পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নের জন্য দ্বৈত পরীক্ষকের নিয়ম চালু করেছে। এ ব্যবস্থা শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে চালু আছে। তা–ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত কলেজগুলোর হাজার হাজার শিক্ষার্থীর অনার্স ও এমএ পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন করছেন একজন পরীক্ষক। এ ধরনের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য উপমহাদেশের ঐতিহ্যের সঙ্গে দ্বৈত পরীক্ষক ব্যবস্থা সংগতিপূর্ণ নয়। এতে স্বভাবতই মূল্যায়ন বিলম্বিত হবে।

তা ছাড়া বিলম্বিত হয়েছে আকস্মিক করোনাভাইরাসের দীর্ঘমেয়াদি চলমান সংক্রমণে। ৩৮তম বিসিএসের আরেকটি মাত্রা প্রাধিকার কোটাভিত্তিক নিয়োগ কার্যক্রমের শেষ পর্ব এটি। অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ মাত্রা হচ্ছে সাধারণ ক্যাডারের পদগুলোতে অনেক বেশি সংখ্যক প্রকৌশলী, চিকিৎসক, কৃষিবিদসহ বিশেষায়িত ক্ষেত্রের প্রার্থী মনোনীত হয়েছেন। এ উপমহাদেশে এ ধরনের সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় যেকোনো বিষয়ের স্নাতক প্রতিযোগিতা করতে পারেন। সফলও হন কেউ কেউ। তাঁদের মধ্যে বেশ কয়েক জন চাকরিজীবনে সফল হয়েছেন। শীর্ষ পদেও ছিলেন কেউ কেউ। ফলে এ ধরনের যেসব প্রার্থী এবারের পরীক্ষায় সফল হলেন, তাঁরা কিংবা পিএসসি কোনো অসংগত কাজ করেছে এমনটা বলার সুযোগ নেই। তবে দেখার থাকে অন্যদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় তারা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডে ছিলেন কি না। দেখতে হবে পরীক্ষার সিলেবাস।

তার আগে আলোচনা করতে হয় এরূপে আসলে ক্ষতিটাই বা কি? সে ক্ষেত্রে বলা হচ্ছে এসব বিশেষায়িত বিষয়ে শিক্ষাদান অনেক ব্যয়বহুল। সরকারকে অনেক টাকা ব্যয় করতে হয় তাঁদের তৈরি করতে। মূল উদ্দেশ্য দেশের জনগণের চিকিৎসাসেবা, উন্নয়নমূলক কাজে কারিগরি দক্ষতা, কৃষি গবেষণা বা সম্প্রসারণের জন্য কিংবা এ ধরনের বিশেষায়িত জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে জনগণের সেবা দেওয়া। এসব ক্ষেত্রে যে জনশক্তি দেশে তৈরি হচ্ছে তার এখনকার মতো চাহিদা আছে কি না, সেটা দেখার বিষয় রয়েছে।

বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোও ডাক্তার তৈরি করছে অনেক। বেসরকারিভাবে তৈরি হচ্ছেন কিছু প্রকৌশলীও। আর সরকার উদারভাবে প্রকৌশল ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেডিকেল কলেজ স্থাপন করে চলেছে। অবশ্য স্বয়ংসম্পূর্ণতা পায়নি অনেকগুলো। মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করে শিক্ষার্থী বের হয়ে গেছে কিন্তু হাসপাতাল নেই, এমন সরকারি স্থাপনাও রয়েছে আমাদের। সুতরাং এসব প্রতিষ্ঠানের অনেকগুলো থেকে গুণগত মানসম্পন্ন স্নাতক আমরা পাচ্ছি এমন দাবি করা যাবে না। আর তাঁরা পাস করেও পাচ্ছেন না কোনো চাকরি বা আয়ের নিশানা।

ডাক্তারি পেশা সিনিয়র বিশেষজ্ঞদের হাতে। কৃষিতে বেসরকারি পর্যায়ে নিয়োগের সুবিধাদি খুব কম। আর সরকারের পদসংখ্যা তো একটি সীমায় রাখতে হয়। তাই তাঁরা যাবেন কোথায়? ব্যাংকের কর্মকর্তা নিয়োগ পরীক্ষায়ও তাঁদের সাক্ষাৎ মেলে। দোষ দেওয়া যাবে না তাঁদের। নিয়ম মেনে প্রতিযোগিতা করেই চাকরিতে আসছেন তঁারা। তবে দেখতে হবে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের অবস্থা।

বিসিএস পরীক্ষার সূচনায় ২০০ নম্বরের একটি প্রিলিমিনারি পরীক্ষা নেওয়া হয়। এর প্রশ্ন ও উত্তর নৈর্ব্যক্তিক। এর মাধ্যমে বড় ধরনের বাছাই হয়ে যায়। ৩৮তম বিসিএসে সাড়ে ৩ লাখ থেকে ১৬ হাজার টিকেছে প্রিলিমিনারিতে। এর প্রশ্ন মূলত ভাষা, সাহিত্য, সাধারণ জ্ঞান, সাধারণ গণিত ও বিজ্ঞান, রাষ্ট্র, ইতিহাস, ভূগোলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। এ সিলেবাসকে বৈষম্যমূলক বলা যাবে না। আর এ পর্যায়ে টিকে থাকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলেও এর নম্বর মেধাক্রম মূল্যায়নে বিবেচনায় নেওয়া হয় না। যেসব বিষয়ে প্রশ্ন হয়, সেগুলো বুদ্ধিমান ও মেধাবী পরীক্ষার্থীদের মোটামুটি জানা উচিত। মনে হয়, এ অংশটি যেমন আছে, তেমনি থাকতে পারে।

এরপর আসছে লিখিত পরীক্ষা। লিখিত পরীক্ষায় বাংলা ও ইংরেজি এবং বাংলাদেশ বিষয়গুলোতে ২০০ নম্বর করে, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি (এতে সাধারণ বিজ্ঞান, কম্পিউটার সায়েন্স, ইলেকট্রনিক বিষয়াদি থাকে) ১০০ নম্বর করে রয়েছে। আর থাকে ৫০ নম্বর করে গাণিতিক যুক্তি ও মানসিক দক্ষতা বলে দুটো বিষয়। মোট ৯০০ নম্বরের পরীক্ষা। হালকাভাবে গণিত, সাধারণ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তির বিষয়টি প্রিলিমিনারিতে থাকে। তাই এ–জাতীয় বিষয়গুলো লিখিত পরীক্ষায় আবশ্যক বিষয় হিসেবে অন্তর্ভুক্তি প্রতিযোগিতাটিকে বিজ্ঞান বা এর সঙ্গে সম্পর্কিত পরীক্ষার্থীদের অনুকূল করে ফেলতে পারে। ব্যাপকভাবে এমনটাই ধারণা করা হচ্ছে।

উপমহাদেশের অপর দুটো দেশের চিত্র আলোচনা করা এখানে প্রাসঙ্গিক। ভারতে ৪০০ নম্বরের প্রিলিমিনারি বাছাই পরীক্ষা আছে। এ নম্বর মূল্যায়নের সঙ্গে যুক্ত হয় না। তেমনি লিখিত পরীক্ষায় ইংরেজি ও সংবিধান স্বীকৃত একটি ভারতীয় ভাষায় ৩০০ নম্বর করে দুটো পরীক্ষা দিতে হয়। এতেও উত্তীর্ণ হলেই হলো। মূল্যায়নে বিবেচনায় নেওয়া হয় না। মূল্যায়নের জন্য থাকছে রচনা, চার পেপারের জেনারেল স্টাডিজ এবং ঐচ্ছিক দুই পেপার। সবই ২৫০ নম্বরের। মোট ১ হাজার ৭৫০ নম্বর আর মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে চূড়ান্ত মূল্যায়ন হয়।

জেনারেল স্টাডিজে মূলত থাকে ইতিহাস, ভূগোল, রাজনীতি, অর্থনীতি, সংবিধান, সরকার, ঐতিহ্য থেকে অনেক কিছু। পাকিস্তানে কেন্দ্রীয় সুপিরিয়র সার্ভিস পরীক্ষায় লিখিত অংশে ইংরেজি রচনা, ইংরেজি কম্পোজিশন, সাধারণ বিজ্ঞান, চলতি বিষয়াবলি, পাকিস্তান বিষয়াবলি, ইসলাম বা নিজ ধর্ম। প্রতিটি বিষয়ে ১০০ নম্বর করে। আর তিনটি বিষয়ে ৬০০ নম্বর ঐচ্ছিক যা প্রার্থী বাছাই করে নেয়। এগুলোর কোনোটিই একতরফাভাবে হেলে আছে এমন বলা যাবে না।

বিসিএস লিখিত পরীক্ষার সিলেবাস অপরিবর্তনীয় কোনো বিষয় নয়। স্বাধীনতার পর থেকে পরিবর্তন এসেছে অনেক। সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। এসব বিষয় নিয়ে পিএসসিতে গবেষণাও হয়। আলোচনা হয় কমিশন সভায়। তারা নিশ্চয়ই পরীক্ষার ফলাফল বিশ্লেষণ করে। প্রতিযোগিতার মাঠটি যেন সমতল থাকে, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা তাদের দায়িত্ব।

বিশেষায়িত ক্ষেত্র থেকে কারও কারও বিসিএস সাধারণ ক্যাডারে চলে আসা কোনো অভিনব বিষয় নয়। পাকিস্তান আমলেও এমনটা হয়েছে। হয়ে চলছে বাংলাদেশ সময়কালে। কিন্তু হাল আমলে এ চলে আসার হার চমকে দেওয়ার মতো বেশি। প্রতিযোগিতা করে তারা যোগ্য ঈপ্সিত অবস্থান নিক, এতে কারও আপত্তি থাকার কথা নয়। তবে সেটা হওয়া সংগত সমতল ক্ষেত্রে। তাই যেদিকে অসমতল রয়েছে বলে জোর দাবি, তা অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে দেখা দরকার। প্রয়োজন সংশোধন।

বিশেষায়িত ক্ষেত্রগুলোতে কাজ করার জন্য যঁাদের সরকার তৈরি করেছে, তাঁরা যেন নিজ ক্ষেত্রেই মর্যাদা ও সন্তুষ্টির সঙ্গে কাজ করতে পারেন, সেদিকেও নজর দেওয়া এখন সময়ের দাবি। নিজস্ব বলয়ের প্রতি আকর্ষণ বাড়াতে না পারলে এ প্রবণতা কমবে না। উপেক্ষিত হতে থাকবে অতি প্রয়োজনীয় বিশেষায়িত ক্ষেত্রগুলো।

লেখক : আলী ইমাম মজুমদার, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0030539035797119