আমাদের শিক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তককে সাম্প্রদায়িকীকরণের অভিপ্রায়ে পাঠ্যবই লেখার ব্যাপারে হেফাজতওয়ালাদের সন্তুষ্ট রাখার আশঙ্কার বিষয়টি উল্লেখযোগ্য। স্কুলের শিক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তকে তাদের হস্তক্ষেপটা কিন্তু মোটেই আবছা নেই; বেশ স্পষ্টভাবেই নিজেদের জাহির করে ফেলেছে। পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তন আনার যে দাবিগুলো মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের পক্ষ থেকে করা হয়েছিল, তাদের সবই মেনে নেওয়া হয়েছে। হেফাজত বিবৃতি দিয়ে এতে সন্তোষ প্রকাশ করেছে এবং হেফাজতিকরণের বিরুদ্ধবাদীদের সতর্ক করে দিতে পর্যন্ত ছাড়েনি। আইয়ুব-মোনায়েমের অন্ধকার শাসনামলে এ ধরনের পরিবর্তন আনার কোশেশ করা হয়েছিল। প্রতিবাদের মুখে কর্তাদের সে অভিপ্রায় ভেস্তে গেছে। সেকালে অত্যন্ত পরিচিত একটি কবিতার দুটি পঙ্ক্তি- 'সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি/ সারাদিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি।' পাকিস্তানি সংস্করণ তৈরি করা হয়েছিল এভাবে- 'ফজরে উঠিয়া আমি দেলে দেলে বলি/ তামাম রোজ আমি যেন নেক হয়ে চলি।' দুর্ধর্ষ কাজটা করেছিলেন বিখ্যাত কবি গোলাম মোস্তফা, কিন্তু টেকেনি।
গোলাম মোস্তফা নজরুল কাব্যের 'অপ্রয়োজনীয়' অংশ বাদ দেওয়ার আঞ্জামও করেছিলেন। লোকে হাস্য-পরিহাস করেছে। রেডিও-টেলিভিশন থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীতের নির্বাসন ঘটানোর সরকারি উদ্যোগও পাল্টা প্রতিক্রিয়াই সৃষ্টি করেছে; রবীন্দ্রসঙ্গীতের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের একটি গানই বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গৃহীত হয়েছে। মোনায়েম খান জসীম উদ্দীনের 'নিমন্ত্রণ' কবিতার নাম বদলে নতুন নাম দিয়েছিলেন 'দাওয়াত'। একই প্রক্রিয়ায় শরৎচন্দ্রের 'মহেশ' গল্পের নামকরণ করা হয়েছিল 'গফুর'। ডিমকে 'আণ্ডা' বলার দরুন উৎফুল্ল হয়ে একজন অধ্যাপককে তিনি বাংলা একাডেমির পরিচালকের চেয়ারে বসিয়ে দিয়েছিলেন- এমন জনশ্রুতি আছে। পাকিস্তান : দেশ ও কৃষ্টি নামে ইতিহাসের সাম্প্রদায়িক ব্যাখ্যা-সংবলিত একটি বই পাঠ্য করা হয়েছিল ক্লাস নাইনে; ছাত্রদের প্রবল বিক্ষোভের মুখে সেটিকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।
এখন বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারের শাসনামলে ওইসব ভূতপ্রেত আবার ফেরত এসেছে। অবিশ্বাস্য সব ঘটনা অবিশ্বাস্য প্রক্রিয়ায় সংঘটিত হয়েছে। তথ্যাভিজ্ঞ মহল একটি ঘটনার কথা জানাচ্ছেন। 'হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ এক লিখিত প্রস্তাবে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের পাঠ্যপুস্তকে মোট ২৯টি বিষয় সংযোজন ও বিয়োজনের কথা বলেছিল। এর মধ্যে সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির দুটি পাঠ্যবই ছাপা হওয়ার পর নজরে এলো হেফাজতের নির্দেশনা বা দাবি অনুযায়ী দুটি লেখা বাদ পড়েনি। [...] দুই শ্রেণিতে মোট বইয়ের সংখ্যা প্রায় ২৮ লাখ। এর মধ্যে চার কোটি ১৫ লাখ টাকার বই ছাপা হয়ে গেছে। এগুলো গুদামে রেখে ও লেখা দুটি বাদ দিয়ে নতুন করে বই ছাপা হলো।' (সাপ্তাহিক একতা, ২৯ জানুয়ারি ২০১৭) গুদামে রাখা বইগুলো নাকি রাতের আঁধারে ঢাকার অদূরে নিয়ে বিশাল গর্ত খুঁড়ে মাটিচাপা দেওয়া হয়েছে। একাত্তরের গণকবরগুলোর কথা মনে পড়ে কি?
এই যে ভূতপ্রেতগুলো ফিরে ফিরে আসে, উত্ত্যক্ত করে; এরা কারা? কী এদের পরিচয়? বলা যাবে, এরা পাকিস্তানের প্রেতাত্মা। সেটা বলা হচ্ছেও। বলাটা সহজও বটে। কিন্তু পাকিস্তান নিজেই তো এখন বিলুপ্তির পথে। তার প্রেতাত্মা কি এতই শক্তিশালী যে, দুস্কর্ম করতে আমাদের দেশে পর্যন্ত চলে আসবে? আসল ব্যাপার অন্য। সেটি হচ্ছে পুঁজিবাদের দৌরাত্ম্য। রামপ্রসাদী গান আছে না- যেমনি নাচাও তেমনি নাচি; তোমার কাজ তুমি করো মা, লোকে বলে করি আমি? ব্যাপারটা অবিকল সেই রকমের। তবে পুঁজিবাদ মাতা নয়, পুঁজিবাদ হচ্ছে পিতা। কিন্তু মূল ঘটনা হচ্ছে, এই যে বিশ্ব এখন পুঁজিবাদের হাতে পুতুল; মহাক্ষমতাধররাও তার হাতে ধরা ও হাত-ধরা পুতুলই। তারা অবশ্য জানে না যে, তারা ক্রীড়নকই, ভাবে তারা স্বাধীন, মনে করে তারাই কর্তা।
বাংলাদেশে আমরা দাবি করে থাকি যে, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন থেকে আমাদের নবযাত্রার সূত্রপাত। দাবিটা সত্য এবং ওই যাত্রাটা ছিল পুঁজিবাদবিরোধী। পুঁজিবাদী ইংরেজ শাসকরা আমাদের ঘাড়ে তাদের ইংরেজি ভাষা চাপিয়ে রেখে চলে গিয়েছিল; আমরা নতুন রাষ্ট্রভাষা চাইছিলাম। পুঁজিবাদী পশ্চিম পাকিস্তানি পাঞ্জাবিরা চাইছিল উর্দু চাপাবে; আমরা রুখে দাঁড়িয়েছিলাম। উর্দু চাপানোর চেষ্টার পেছনে যুক্তিটা ছিল সামন্তবাদী। বলা হচ্ছিল, বাংলার তুলনায় উর্দু বেশি পরিমাণে ইসলামসম্মত। কিন্তু ভাষা-চাপানোর পেছনকার ইচ্ছাটা ছিল পুঁজিবাদী কর্তৃত্ব কায়েম রাখার। পাকিস্তান রাষ্ট্রের চৌহদ্দি ভেঙে আমরা সবেগে বেরিয়ে এসেছি; কিন্তু পুঁজিবাদ আমাদের ছাড়েনি। সে আরও শক্তিশালী হয়ে দৌরাত্ম্য করছে, আমাদের ইচ্ছামতো নাচিয়ে বেড়াচ্ছে। পুঁজিবাদী শাসন বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে তিন ধারায় বিভক্ত করেছে। মাদ্রাসা শিক্ষাকে মূলধারার কাছে আনার কথা মুখে বলছে; কিন্তু হেফাজতিদের চাপের মুখে মূলধারাকেই বরং মাদ্রাসার দিকে ঠেলে দিচ্ছে; নির্দয়ভাবে। এতে শাসক শ্রেণির কোনো ক্ষতি নেই; কারণ তাদের ছেলেমেয়েরা এখন আর মূলধারাতে নেই, তারা ইংরেজি ধারাতে চলে গেছে কিংবা যাওয়ার চেষ্টায় আছে। বঞ্চিত মানুষরাই মাদ্রাসায় পড়ে; তাদের তুলনায় কম বঞ্চিতরা রয়েছে মূলধারাতে। মূলধারা এবং মাদ্রাসা কাছাকাছি চলে এলে বঞ্চিতের সংখ্যা বাড়বে; সুবিধাভোগীদের তাতে অসুবিধা নেই, সুবিধাই আছে, তারা ফুলতে ও ফাঁপতে থাকবে- এখন যেমনটা ফুলছে ও ফাঁপছে।
হাইকোর্ট এলাকা থেকে একটি স্থাপত্য সরিয়ে ফেলা হয়েছে। দাবিটা তুলেছিল হেফাজতে ইসলাম এবং আওয়ামী ওলামা লীগ, একসঙ্গে। এই সংযোগটা মোটেই তাৎপর্যহীন নয়। আওয়ামী লীগ বলেনি যে, ওলামা লীগ তাদের অঙ্গ সংগঠন নয়। বলবে বলে ভরসাও নেই; কেননা, নির্বাচনের একটা আঞ্জাম চলছে। সংবিধান বলছে, একটা নির্বাচন দিতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা আওয়ামী লীগ মুখে সর্বক্ষণ বলে; কিন্তু সেটা ঠিক কী জিনিস, তা বলতে পারে না। কারণ সংবিধানের মূলনীতিতে এখন 'রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম' পর্যন্ত চলে এসেছে এবং ওই বোঝা থেকে সংবিধানকে মুক্ত করার কোনো ইচ্ছা আওয়ামী লীগ সরকারের নেই। আশঙ্কা করার কারণ আছে যে, হেফাজত ও আওয়ামী ওলামা লীগ মিলেমিশে তাদের কণ্ঠকে আরও বুলন্দ করবে এবং পাঠ্যপুস্তকগুলো আরও বেশি সাম্প্রদায়িক হবে, ভাস্কর্য অপসারণ আন্দোলনেরও বিস্তার ঘটতে থাকবে। অর্থাৎ ধর্মনিরপেক্ষতাকে কবর দিয়ে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র নির্মাণে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মনস্তাত্ত্বিক ধর্মান্ধের পথে ঠেলে দেওয়ার অভিপ্রায়ে সরকার এবং হেফাজতের মধ্যে মিল ও অমিল বলে কিছু যে আছে- তেমন ধারণা করা যাবে না। আখেরাত পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকতে আওয়ামী লীগ-হেফাজতের মধ্যে বাস্তবে কোনোই অমিল নেই। পরস্পর যেন হয়ে গেছে হরিহর-আত্মা।
এসব ঘটনাই ঘটবে, যদি প্রতিরোধ গড়ে তোলা না যায়। কিন্তু প্রতিরোধ তো নেই। পাকিস্তান আমলে ছিল, এখন নেই। কারণ কী? মূল কারণটা কিন্তু মোটেই অস্পষ্ট নয়। সেটা হলো এই যে, পাকিস্তান আমলে যারা রাষ্ট্রীয় দৌরাত্ম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলন করত, তাদেরই একাংশ এখন রাষ্ট্রের শাসক হয়ে বসে গেছে। আর যারা ওই সুযোগটা এখনও পায়নি তারাও আশায় আছে; কেউ কেউ উচ্ছিষ্টের প্রত্যাশায় প্রহর গুনছে। সহজ ও দৃষ্টিগ্রাহ্য একটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে।
১৯৭০ সালে পূর্বে উল্লিখিত 'পাকিস্তান:দেশ ও কৃষ্টি' বইয়ের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন হয়েছিল, তাতে একটা বড় ভূমিকা ছিল মস্কোপন্থি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের এবং ছাত্র সংগঠনটির তখনকার সভাপতি ছিলেন নুরুল ইসলাম নাহিদ। আন্দোলনের একেবারে সামনের সারিতেই তাকে দেখা যেত। এখন তিনি শিক্ষামন্ত্রী এবং তার মন্ত্রণালয়ই পাঠ্যপুস্তকের হেফাজতিকরণের জন্য দায়ী। তিনি নিশ্চুপ। যেন অসহায়।
ছাত্র ইউনিয়ন ততদিনে, আসলে ওই আন্দোলনের আগেই দুই ভাগ হয়ে গেছে; এক ভাগ মস্কোপন্থি, অন্যভাগ চীনপন্থি। মস্কোপন্থিদের ডাক নাম ছিল মতিয়া গ্রুপ; পিকিংপন্থিদের ডাক নাম মেনন গ্রুপ। মস্কোপন্থি মতিয়া চৌধুরী ও পিকিংপন্থি রাশেদ খান মেননের এখন কিন্তু বিরোধ তো পরের কথা, কোনো দূরত্বই নেই। তারা একত্র হয়ে গেছেন; তারা দু'জনেই এখন মন্ত্রী। পাকিস্তান আমলে এমন অত্যাশ্চর্য ঐক্য সম্ভব বলে কল্পনা করাও দুঃসাধ্য ছিল। এখন, সশস্ত্র যুদ্ধে পাকিস্তানকে পরাভূত করে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশে সেটাই ঘটেছে। কৃতিত্বটা কিন্তু তাদের নিজেদের নয়, আওয়ামী লীগেরও নয়। সব কৃতিত্ব ও প্রশংসা একজনেরই প্রাপ্য; তার নাম পুঁজিবাদ। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ফলে সহজলভ্য সুযোগ-সুবিধা আরও অনেকের মতো এদেরকেও পুঁজিবাদী করে ছেড়েছে। পুঁজিবাদ তো নাচাবেই, নাচাচ্ছেও। যারা নাচতে চান, তারা নাচছেন। জাতীয়তাবাদীরা সব সময় পুঁজিবাদী ছিলেন, একদা সমাজতন্ত্রীদের অনেকেই ওই পথ ধরেছেন। তাহলে? কে করবে আন্দোলন? নৃত্যব্যস্তদের পক্ষে কি আন্দোলন করা সম্ভব?
শিক্ষাবিদ ও সমাজ বিশ্নেষক