সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : আশিতে প্রণতি

পিয়াস মজিদ |

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী (জন্ম :১৯৩৬) যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে অবসর গ্রহণ করেন, সেদিন দেশের নানা পত্রিকায় ছাত্রছাত্রী ও শুভার্থীরা সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে নিয়ে লিখেছেন।

কারও বক্তব্য ছিল, তার শিক্ষকতা থেকে অবসর গ্রহণের মধ্য দিয়ে একটি স্বর্ণযুগের প্রাতিষ্ঠানিক অবসান ঘটেছে; আবার কারও ব্যাখ্যা ছিল, শিক্ষকতা থেকে অবসর নিয়ে তিনি আরও ব্যাপক পরিসরে মানব প্রগতির সংগ্রামে যুক্ত হতে পারবেন।

তখন আমাদের ভাবনায় এসেছে, একজন শিক্ষক সমাজে কতটা প্রভাবসঞ্চারী হলে তার অবসর গ্রহণ একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার উপলক্ষ হতে পারে! হ্যাঁ, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এ দেশে শিক্ষক পদটির সম্মান যেমন বাড়িয়ে দেন অনেকখানি, তেমনি আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতি-সমাজ-রাজনীতি ক্ষেত্রেও সাহসী অবস্থানের মাধ্যমে নিজের প্রভাবকে দৃশ্যগ্রাহ্য করে তুলেছেন।

তিনি মূলত প্রাবন্ধিক। প্রবন্ধের প্রথাবদ্ধ কাঠামোয় তার আস্থা নেই মোটেও; যেমন নেই প্রচলিত সমাজ ও রাষ্ট্র-কাঠামোয়। এ দুই অনাস্থাকে তার লেখার মাধ্যমেই পাঠকের কাছে তুলে ধরেন স্বভাব-সাবলীলতায়।

মার্কসীয় আন্তর্জাতিকতার আলোকে তিনি পরিস্থিতিকে ব্যাখ্যা করেন। একই সঙ্গে অনিবার্যভাবে যুক্ত থাকে জাতীয় মুক্তির প্রসঙ্গ। জাতীয়তাবাদের চটকদার-ভ্রান্ত ব্যাখ্যা ও ব্যবহারের যুগে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সেই বিরল বুদ্ধিজীবী, যিনি ‘বাঙালীর জাতীয়তাবাদ’ ও ‘জাতীয়তাবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও জনগণের মুক্তি’ শীর্ষক দুটি পৃথক বিশালাকার বই লিখে দেখিয়েছেন আমাদের অগ্রগমন ও পশ্চাদ্ধাবনের সমূহ সূত্রসার।

মার্কসীয় ভাবনার আলোকবিন্দুতে স্নাত বলে তিনি উত্তর-আধুনিকতা কিংবা নিম্নবর্গের ইতিহাসচর্চা নিয়ে ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে মোটেও ভোলেন না। তিনি বিশ্বাস করেন, গণতন্ত্র জ্ঞানজাগতিক ক্ষেত্রেও ভীষণভাবে চর্চার বিষয়।

আবার সেই জ্ঞানজগতেরই নানা অবভাস যখন সামন্তবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও শোষণের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে, তখন তিনি সেই জ্ঞানকাণ্ডের গতিবিধি ও গন্তব্য শনাক্ত করেন। সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস তার। এই বিশ্বাস মৌসুমি বুদ্ধিবৃত্তিক বিলাসমাত্র নয়।

তাই বিগত শতকের নব্বই দশকে বিশ্বজুড়ে গর্বাচেভীয় উল্লাসের সঙ্গে তাল মিলিয়ে স্বদেশি বামপন্থি অনেকেই যখন নিজেদের নতুন পরিচয় নির্ধারণে ব্যস্ত, তখন তিনি প্রত্যয়ী কলম ধরেছেন ‘কাস্তে হাতুড়ি থাকবেই’ শিরোনামে।

সমাজতন্ত্র তার কাছে রাশিয়া-চীন-কিউবা-কোরিয়া’সাপেক্ষ কোনো রাষ্ট্রতত্ত্ব নয়, বরং এক বিশ্বব্যাপ্ত প্রায়োগিক দর্শন। সাম্যবাদকে তিনি সমাজ-রাজনৈতিক পরিসর থেকে মনোজাগতিক বিশ্লেষণের পরিপ্রেক্ষিতেও বিবেচনা করেছেন।

তাই তার বইয়ের শিরোনাম হয়ে যায় বাঙালি মধ্যবিত্তের যুগপৎ সাম্যভীতি ও আকাঙ্ক্ষার পরিচয়বহ ‘সাম্যের ভয় স্বাধীনতার স্পৃহা’। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ তার অনন্ত প্রেরণার উৎস।

মুক্তিযুদ্ধকালে লেখক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবীদের প্রতিবাদী তৎপরতায় নিবিড়ভাবে যুক্ত ছিলেন বলেই পাকিস্তানি দোসরদের সম্ভাব্য বুদ্ধিজীবী হত্যা-তালিকায় তার নাম খুঁজে পাওয়া যায়।

পূর্ব পাকিস্তান লেখক শিবির ১৯৭১-এর ২৩ মার্চ বাংলা একাডেমি মিলনায়তনে ‘ভবিষ্যতের বাংলা’ শীর্ষক এক সেমিনারের আয়োজন করে। তাতে পঠিত সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর প্রবন্ধের মূল বক্তব্য ছিল ‘ভবিষ্যতের বাংলা হবে ধর্মনিরপেক্ষ বাংলা এবং বাঙালিকে শুধু বাঙালি নয় বরং মানুষকে বাঁচাতে হবে।’

মুক্তিযুদ্ধকে কেবল ভৌগোলিক পরিবর্তন হিসেবে বিবেচনা করেননি তিনি। প্রয়োজনীয় যুদ্ধ-তৎপরতাকে আমরা দীর্ঘস্থায়ী রূপ দিতে পারলাম না বলেই আজ নানাভাবে মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা ভূলুণ্ঠিত বলে তার ধারণা।

 রঙবেরঙের শত্রুকবলিত এই বিদ্যমান বাস্তবে যুদ্ধের ময়দান থেকে পশ্চাদপসরণকে তিনি আঘাত করেন ‘কেউ যায় যুদ্ধে, কেউ চলে ভিক্ষায়’ বলে। একাত্তরের ঘাতক-দালালদের বিচারের দাবিতে শুরু হওয়া আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন তিনি।

সেই সঙ্গে এ বিষয়ে তার গভীর বিশ্লেষণধর্মী প্রবন্ধ-নিবন্ধ আন্দোলনের তাত্তি্বক ভিত্তি দৃঢ় করেছে। তার রচিত নিবন্ধ ‘যে রোগের নাম আলবদর’ যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়ার সময়কালে নানা মাধ্যমে পুনর্মুদ্রিত হতে দেখেছি আমরা; দেখে অনুভব করেছি যে রাজনৈতিক নিবন্ধও সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর অনন্য পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনার গুণে কী করে ধ্রুপদী রচনার মর্যাদা পেতে পারে।

বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, নজরুলকে নিয়ে পূর্ণাঙ্গ বই লিখেছেন তিনি। তার বিশ্লেষণে আমরা বাংলা সাহিত্যের স্মরণীয়দের সম্পর্কে নতুন মূল্যায়ন পেয়েছি। সাহিত্য সমালোচনায় তার সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব বোধ করি সাহিত্যকে শুধু সাহিত্য দিয়ে ব্যাখ্যা না করে জীবন ও জগতের বৃহৎ প্রেক্ষিতে প্রতিস্থাপনে।

মহাকাব্যের মতো সাহিত্যিক রূপকল্পের জন্মকে তিনি সমুদ্রের অনিবার্যতা দিয়ে ব্যাখ্যা করেন। ইবসেনের ‘নোরা’ নাটক নিয়ে লিখতে গিয়ে দেখান ঘর থেকে নোরার দরজা ধাক্কা দিয়ে বেরিয়ে যাওয়া শুধু পুরুষতন্ত্রের নিকুচি করা নয়, বরং ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতে নোরার এই ধাক্কা ওয়াটারলুর কামানের ধ্বনির চেয়েও তাৎপর্যপূর্ণ।

সাহিত্যতত্ত্ব ও সাহিত্যিক নিয়ে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর রচনাপাঠ মানেই সমাজ-সংস্কৃতির ভিন্নতর অবলোকন। ‘ঝরা পালক’ বইয়ে তিনি দেখেন প্রাথমিক জীবনানন্দের পূর্ণ প্রতিশ্রুতি, শামসুদ্দীন আবুল কালামের ‘পথ জানা নাই’ গল্পে দেখেন আত্মঘাতী উন্নয়নের সতর্কাভাস কিংবা ঢাকার মুসলিম সাহিত্য সমাজের তরুণ লেখকবৃন্দের রচনায় দেখেন অঙ্গীকারের আভায় রাঙানো বুদ্ধিবৃত্তিকতা।

অমর একুশ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি উল্লেখ করতে ভোলেন না এ দেশের পাড়া-মহল্লা থেকে প্রকাশিত একুশের সংকলনের কথাও।

 সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বহু সাক্ষাৎকারে বলেছেন, বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে তার মতাদর্শিক দূরত্ব দুস্তর; কিন্তু বুদ্ধদেবের ভাষার লাবণ্যরীতির তিনি ভীষণ অনুরাগী।

তাই উচ্চশিক্ষা নিয়ে বিদ্যাসাগরের অবস্থানে দ্বিমত পোষণ করতে গিয়ে তিনি যখন লেখেন ‘মায়ের আদেশে নিশুতি রাতে ভয়ঙ্কর দামোদর নদী পার হওয়া অনেক কঠিন, কিন্তু তারও চেয়ে কঠিন শ্রেণিবিন্যাসের নিষ্ঠুর নদী পার হওয়া’; তখন বক্তব্যের স্পষ্টতার সঙ্গে যুক্ত হয় ভাষার স্বচ্ছসলিলা প্রবাহ, যাতে পাঠক সহজেই বিষয়বস্তুর সঙ্গে একাত্ম হয়ে পড়েন।

সাহিত্য-সমাজ-সংস্কৃতি-রাজনীতি বিষয়ে প্রায় শতখানি গ্রন্থের লেখক যে মানুষটি, তিনি প্রবলভাবে বিশ্বাসী সাহিত্যের সামাজিকতায়। তার লেখক-জীবনের শুরু থেকে দেখা যায় পত্রিকা সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি সব সময়।

ব্যক্তি একক ছাপিয়ে সামাজিক ‘বহু’র প্রকাশকে তিনি গুরুত্বপূর্ণ জ্ঞান করেন। আশি-নব্বই দশকের বহু বিশিষ্ট লেখক স্বীকার করেন, তাদের লেখক-জীবনে প্রণোদনা হিসেবে কাজ করেছে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর ‘সাহিত্যপত্র’ পত্রিকায় কবিতা কিংবা গল্পের প্রকাশ।

 এক যুগেরও বেশি সময় ধরে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে তিনি নিয়মিতভাবে প্রকাশ করছেন ত্রৈমাসিক ‘নতুন দিগন্ত’। আমাদের সাময়িকপত্রের দুষ্কালের ইতিহাসে এ এক স্মরণীয় ঘটনা বটে।

তরুণদের প্রতি তার পক্ষপাত বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। এ দেশের অনেক তরুণ লেখকের প্রাথমিক উন্মেষলগ্নে তাদের বই নিয়ে সবিস্তার আলোচনা লিখেছেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।

ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজে পুরস্কৃত বোধ করেছি, যখন বছর সাতেক আগে বিশ্ববিদ্যালয়-পড়ূয়া আমাকে একদিন ফোন করে তিনি বললেন, ‘তোমাকে আমার একটি বই উৎসর্গ করতে চাই। আপত্তি নেই তো?’

এই সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে আমরা দেখি তরুণদের আহ্বানে পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনে, লালন আখড়া রক্ষার কর্মসূচিতে, শিক্ষার অধিকার আদায়ের সংগ্রামে।

প্রজ্ঞা ও পরিমিতি, আদর্শ ও অঙ্গীকার, চিন্তা ও সক্রিয়তায় সুষম সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী আমাদের পথ দেখিয়ে চলেছেন বলে এই সমসময়ের ডানায় আরও একটু বেশি দিগন্ত স্পর্শের সাহস সঞ্চারিত হয়ে যায়।

আশিতম জন্মবর্ষে আপনাকে অশেষ শ্রদ্ধা, প্রিয় সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী স্যার।

কবি ও প্রাবন্ধিক


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ - dainik shiksha প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার - dainik shiksha তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার - dainik shiksha স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন - dainik shiksha নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.004321813583374