করোনা মহামারিতে বিশ্বের অসংগতিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা উদগ্রভাবে কঠিন নগ্নতায় প্রকাশ পেয়েছে। বাংলাদেশে সর্বগ্রাসী করোনা ত্রুটিপূর্ণ সমাজব্যবস্থাপনা স্পষ্ট করেছে। সাধারণ শ্রমজীবী সীমিত আয়ের মানুষের জীবন-জীবিকা কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন। একদিকে জীবন, অন্যদিকে জীবিকা। দুটিই চ্যালেঞ্জের মুখে। বেঁচে থাকার সংগ্রাম। জীবিকার সংগ্রাম। বিপর্যস্ত মানবতা, মানবিকতা। এক দিন মৃত্যুর হার কম, অন্য দিন বেশি। অসংখ্য মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী কেউ বাকি নেই। সরকারি হাসপাতালে আক্রান্ত চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী ন্যূনতম হলেও সেবা পাচ্ছেন। বেসরকারি ক্লিনিক, হাসপাতালের আক্রান্ত নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীদের অবস্থা বর্ণনাতীত। মঙ্গলবার (৭ জুলাই) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত উপসম্পাদকীয়তে এ তথ্য জানা যায়।
উপসম্পাদকীয়তে আরও জানা যায়, কবে কোন পথে এই মহামারি থেকে বিশ্ব মুক্ত হবে সুনির্দিষ্ট হিসাব কোনো সংস্থা বা বিজ্ঞ বিশেষজ্ঞ কারো কাছে নেই। সর্বগ্রাসী দুশ্চিন্তা সব শ্রেণি-পেশার মানুষের জীবনীশক্তি ধ্বংস করছে। করোনার নগ্ন আক্রোশে ‘শহরে থাকে কিন্তু শহরে নয়’ এমন মানুষের দুঃখ-দুর্দশা বর্ণনাযোগ্য নয়। মানুষ শহর থেকে গ্রামে যেতে বাধ্য হচ্ছে বেঁচে থাকার শেষ আশা নিয়ে। ঢাকা শহরে অসংখ্য বাড়িতে ঝুলছে বাড়িভাড়ার নোটিশ। তিন মাসের ব্যবধানে বাড়িভাড়া কমেছে। বাড়িভাড়া পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়ে বাড়ির আসবাব ফেলে গ্রামে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা কারো হৃদয়কে আহত করে না। করোনা মহামারিতে ঢাকার বাড়ির মালিক শিক্ষার্থীদের সার্টিফিকেটসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছেন, এমন খবরও প্রকাশিত হয়েছে।
করোনা মহামারিতে ১৭ মার্চ থেকে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ। প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন, পরিস্থিতির উন্নতি না হলে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। সীমিত আকারে স্কুল-কলেজে অনলাইন ক্লাস চলছে। সরকারি ও এমপিওভুক্ত স্কুল-কলেজের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের করোনা দুর্যোগে জীবিকায় প্রভাব পড়েনি। স্বায়ত্তশাসিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষা কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বেসরকারি ও নন-এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিদারুণ দুঃখ-দুর্দশা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। তাঁদের সংখ্যা একেবারে কম নয়, প্রায় ১০ লাখ। রাজশাহী শহরের নর্থ পয়েন্ট স্কুলের সামনে দিয়ে মাঝেমধ্যে আসা-যাওয়া করি।
স্কুলের ছোট মাঠে বাচ্চাদের খেলতে দেখি। ১৭ মার্চ থেকে স্কুল বন্ধ। স্কুলের মাঠে ঘাস বড় হয়েছে। বাচ্চাদের খেলার উপকরণগুলোতে মরিচা পড়েছে। স্কুল কর্তৃপক্ষ অনলাইনে ক্লাস নিয়ে বাড়িভাড়া ও শিক্ষকদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করে স্কুলটি বাঁচিয়ে রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করছে। রাজশাহীর উপশহরে অবস্থিত গোল্ডেন সান স্কুলটি ভিন্ন পদ্ধতিতে টিকে থাকার লড়াই করে যাচ্ছে। শিফটিং পদ্ধতিতে অভিভাবকরা স্কুলে আসেন এবং প্রয়োজনীয় প্রশ্নপত্র নিয়ে যান। বাড়িতে বসেই শিক্ষার্থীরা উত্তরপত্র তৈরি করে। অভিভাবকরাই সেই উত্তরপত্র স্কুলে নিয়ে আসেন এবং স্কুলশিক্ষকরা উত্তরপত্র দেখে সংশোধন করে দেন। কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুসারে দেশে ৬০ হাজার কিন্ডারগার্টেন স্কুলে প্রায় ছয় লাখ শিক্ষক কর্মরত। কিন্ডারগার্টেন স্কুলের শিক্ষকদের বেতন-ভাতা খুবই কম।
এসব শিক্ষকের জীবিকা চলে টিউশন দিয়ে। অনেকে ব্যাচ করে পড়ান, আবার অনেকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে পড়ান। দেশে নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে সাত হাজার। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ৮০ হাজার শিক্ষক। এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অস্থায়ী ও খণ্ডকালীন শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী রয়েছেন কয়েক লাখ। এ ছাড়া রয়েছেন অসংখ্য কোচিং সেন্টারের সঙ্গে যুক্ত বহু শিক্ষাকর্মী। কেজি স্কুল, প্রাইভেট স্কুল-কলেজ ও মাদরাসার শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অনিশ্চিত জীবিকায় জীবন স্তব্ধ। রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা এমনিতেই কোনো বেতন-ভাতা পান না। উৎসব বোনাসের প্রশ্নই আসে না।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে আয় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অনেক শিক্ষক বেঁচে থাকার জন্য জীবিকা পরিবর্তন করতে বাধ্য হচ্ছেন। কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে দেখা যায়, খুলনার পাইকগাছার দুর্গম অঞ্চলের ডেলুটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকসহ অন্য শিক্ষকরা মাছ বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। একটি জাতির জন্য এমন নির্মম সত্য আর কী হতে পারে। মানুষ গড়ার কারিগরের জীবন চলে রাতের অন্ধকারে মাছ ধরে তা বিক্রি করার অর্থ দিয়ে। শিক্ষকদের কেউ সবজি বিক্রি করছেন, কেউ পরিবারের শেষ সম্বলটুকু বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করার চেষ্টা করছেন। ধারদেনা তো রয়েছেই। দু-একটি খবর মিডিয়ায় আসে। খবরের বাইরে থেকে যায় শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত অসংখ্য শিক্ষকের দুর্বিষহ জীবন। এসব শিক্ষকের কাছে শিক্ষা নিয়েই কেউ প্রশাসন ক্যাডার, শিক্ষা ক্যাডার, ফরেন ক্যাডারসহ রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন।
মফস্বলের প্রাইভেট স্কুল-কলেজ ও মাদরাসার শিক্ষকদের বেতন-ভাতা সামান্যই। সামান্য সম্মানী ও শিক্ষার্থীদের দেওয়া শ্রদ্ধা নিয়ে শিক্ষকের জীবন চলে। তিনি শিক্ষক, এটাই তাঁর অহংকার। করোনা দুর্যোগের সময় জীবিকা হারালেও ত্রাণ সহায়তার লাইনে নাম লেখাতে শিক্ষকদের আত্মমর্যাদা, আত্মসম্মান বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ফলে অভুক্ত পরিবারের দিকে তাকিয়ে পাল্টা দৃষ্টির শিক্ষকের শেষ সম্মান আত্মমর্যাদা ও আত্মসম্মানের শেষরক্ষা রইল না। আত্মমর্যাদাহীন শিক্ষক দিয়ে যাই হোক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে সুফল পাওয়া যায় না। দুর্বল-পুষ্টিহীন শিক্ষার্থী জাতি গঠনে সক্ষমতা অর্জন করতে সক্ষম হয় না। ফলে উন্নয়নের গতিধারা ব্যাহত হয়। জাতি কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য থেকে দূরে সরে যায়।
ঈদ আসছে। সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারী উৎসব বোনাস পাবেন। কেজি স্কুল ও ব্যক্তিমালিকানাধীন স্কুল-কলেজ ও মাদরাসার শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতন-ভাতা অনিশ্চিত। দেনার দায়ে ব্যক্তিমালিকানাধীন স্কুল-কলেজ বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। ঈদের আগে কেজি স্কুল ও ব্যক্তিমালিকাধীন ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল ও মাদরাসার দরিদ্র শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তালিকা করে সামান্য বোনাসের ব্যবস্থা করা হলে শিক্ষকদের আত্মমর্যাদা কিছুটা রক্ষা হবে। উপজেলা পর্যায় থেকে তালিকা প্রণয়ন করা মোটেই কঠিন কোনো কাজ নয়। সুর্দিষ্ট তালিকা প্রণয়ন করে বিকাশের সাহায্যে ঈদ বোনাস পাঠানো যায়। এ জন্য হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন নেই। আন্তরিকতাই যথেষ্ট।
লেখক : ড. মো. আনিসুজ্জামান, সহযোগী অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়