মাদরাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির জবানবন্দি ভিডিও ধারণ এবং অনলাইনে ছড়িয়ে দেয়ার মামলায় সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনকে তিন ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
জিজ্ঞাসাবাদে তিনি এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। মামলার আলামত হিসেবে তার (ওসি মোয়াজ্জেম) দুটি মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়েছে। ফোনগুলো পরীক্ষার জন্য ফরেনসিক ল্যাবে পাঠানো হবে।
মঙ্গলবার দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে সাড়ে ৩টা পর্যন্ত ঢাকার পিবিআই সদর দপ্তরে ওসি মোয়াজ্জেমকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ওসির মোবাইল ফোনের ফরেনসিক পরীক্ষায় অনেক তথ্য বেরিয়ে আসবে। রাফিকে জিজ্ঞাসাবাদের সময় ওসির সঙ্গে যারা ছিলেন তাদের সবার মোবাইল ফোন জব্দ করে ফরেনসিক পরীক্ষা করা হবে।
যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে ভুক্তভোগীকে জিজ্ঞাসাবাদ, ভিডিও ধারণ ও ছড়িয়ে দেয়ার অভিযোগ এনে দায়ের করা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলাটি তদন্ত করছে পিবিআই। এদিকে রাফির মরদেহের ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন আগামীকাল বৃহস্পতিবার দেয়া হতে পারে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. সোহেল মাহমুদ।
মামলার তদন্ত সংস্থা পিবিআইয়ের প্রধান ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার মঙ্গলবার বলেন, সোনাগাজীর সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনকে মামলার অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা ডেকে কথা বলেছেন। অনুসন্ধানের প্রয়োজনে যা যা করণীয় তা করা হবে। অর্থাৎ কোনো আলামত জব্দ করার প্রয়োজন হলে তা করবেন। আমরা সর্বোচ্চ পেশাদারিত্ব বজায় রেখে তদন্ত কার্যক্রম চালিয়ে যাব। এ মামলায় আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী তদন্ত করে প্রতিবেদন দেব।
রাফি হত্যা মামলার তদন্তের বিষয়ে তিনি বলেন, রাফি হত্যার রহস্য এরই মধ্যে উদ্ঘাটন করা হয়েছে। হত্যার সঙ্গে জড়িত সবাইকে চিহ্নিত করার পাশাপাশি আইনের আওতায় আনা হয়েছে। তদন্ত শেষ করে শিগগির প্রতিবেদন জমা দেয়া হবে।
এদিকে সোনাগাজী সিনিয়র ফাজিল মাদরাসার আলিম পরীক্ষার্থী রাফি হত্যার ঘটনায় অবৈধ লেনদেনের বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এ ঘটনায় মানি লন্ডারিংয়ের কোনো ঘটনা ঘটেছে কিনা, তদন্ত করতে সোমবার রাতে সিআইডির একটি টিম ফেনীতে যায়। মঙ্গলবার মাঠপর্যায়ে তারা অনুসন্ধান শুরু করেছে।
সংস্থাটি বলছে, সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা, ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন, সোনাগাজী উপজেলা আ’লীগের সভাপতি রুহুল আমিনসহ অভিযুক্তদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খতিয়ে দেখতে কাজ শুরু করেছে সিআইডি। মাঠপর্যায়ের প্রাথমিক অনুসন্ধান শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে অভিযুক্তদের অ্যাকাউন্টের বিস্তারিত তথ্য সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর কাছে চাওয়া হবে।
সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. ফারুক হোসেন বলেন, রাফি হত্যার ঘটনায় অবৈধ লেনদেনের বিভিন্ন তথ্য গণমাধ্যম ও বিভিন্ন মাধ্যমে উঠে আসা তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছে।
সোনাগাজীর বিভিন্ন ব্যাংকে সন্দেহভাজনদের আর্থিক লেনদেনের বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছে। এসব তথ্য যাচাই-বাছাই চলছে। আর্থিক বিষয়ে পাওয়া তথ্য প্রমাণিত হলে মানি লন্ডারিং আইনে দোষীদের বিরুদ্ধে মামলা করা হবে।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ করার পর গত ২৭ মার্চ রাফিকে থানায় ডেকে নেন সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন। থানায় রাফির জবানবন্দি নেন তিনি।
এ সময় পুরো জবানবন্দির ভিডিও ধারণ করেন তিনি। জবানবন্দি রেকর্ডের সময় তিনি যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেননি। একজন নারী ভুক্তভোগীকে স্পর্শকাতর বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার সময় অবশ্যই নারী পুলিশ সদস্য রাখা উচিত ছিল। এমনকি রাফি মারা যাওয়ার পর রাফিকে জিজ্ঞাসাবাদের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া হয়।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন মঙ্গলবার দুপুর সাড়ে ১২টায় পিবিআই সদর দপ্তরে আসেন। এরপর অনুসন্ধান কর্মকর্তা তাকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন। তাকে বিভিন্ন প্রশ্ন করা হয়।
তিনি কোনো কোনো প্রশ্নের উত্তর দেন। আবার কোনো কোনো প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। রাফির জবানবন্দি গ্রহণের ভিডিও রেকর্ড ও ছড়ানোর বিষয়টি অস্বীকার করেন। এরপরই ওসির কাছে থাকা দুটি ফোন সেট জব্দ করা হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ওসির বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলার অনুসন্ধান কর্মকর্তা আজ ফেনীতে ঘটনাস্থলে যাবেন।
সেখানেও তিনি মামলার প্রয়োজনে যেসব আলামত জব্দ করার তা করবেন। ওসি ছাড়াও আরও বিভিন্ন ব্যক্তির মোবাইল ফোন সেট জব্দ করা হতে পারে। এসব আলামত ফরেনসিক ল্যাবে পাঠানো হবে পরীক্ষার জন্য। এদিকে যোগাযোগ করা হলে মামলার বাদী ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন বলেন, তদন্ত কর্মকর্তা আমাকে ফোন দিয়েছিলেন, আমি বলেছি, মামলার তদন্তে আপনার তথ্য-উপাত্ত সংক্রান্ত যে ধরনের সহযোগিতা লাগে, আমি সব করব।
জনপ্রতিনিধি ও সাংবাদিকদের মতামত নিল পুলিশের তদন্ত কমিটি : রাফি হত্যার ঘটনায় পুলিশ ও প্রশাসনের গাফিলতি তদন্ত করতে আসা পুলিশ সদর দপ্তরের তদন্ত কমিটি মঙ্গলবার স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় সাংবাদিক এবং শিক্ষার্থীদের মতামত নিয়েছে। মঙ্গলবার সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত তদন্ত দল তাদের লিখিত মতামত নেয়।
পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সম্রাট মো. আবু সুফিয়ান সাংবাদিকদের বলেন, ‘পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি এসএম রুহুল আমিনের নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি এরই মধ্যে ঘটনাস্থল পরিদর্শন, রাফির পরিবার, শিক্ষক, পুলিশ ও গভর্নিং বডির সদস্যদের মতামত গ্রহণ করেছে। এখন নতুন করে বেশ কিছু তথ্য আসায় স্থানীয় সাংবাদিক, ইউপি চেয়ারম্যান এবং পরীক্ষার্থী ছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলেছি।’
পুলিশের গাফিলতির বিষয়ে কোনো প্রমাণ পাওয়া গেছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ ব্যাপারে তদন্ত কমিটির প্রধান পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি আনুষ্ঠানিকভাবে গণমাধ্যমকে জানাবেন। এরই মধ্যে অনকে তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে। এগুলো যাচাই-বাছাই চলছে। প্রতিবেদন প্রস্তুত করতে আরও কয়েক দিন সময় লাগতে পারে।
রাফি হত্যায় কেউ ছাড় পাবে না : রাফি হত্যার ঘটনায় জড়িত কেউ ছাড় পাবে না বলে জানান ফেনী-৩ আসনের সংসদ সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী। মঙ্গলবার বিকালে রাফির পরিবারের সঙ্গে দেখা করে তিনি এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, যদি কোনো অপরাধীর রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক পরিচয়ও থাকে তদন্তে অপরাধ প্রমাণ হলে ছাড় পাওয়ার সুযোগ নেই।
এ ঘটনা ধামাচাপা পড়বে কিংবা রাজনৈতিক কারণে অন্য খাতে প্রবাহিত হয়ে যাবে- এটা আমি বিশ্বাস করি না। এর আগে তিনি রাফির কবর জিয়ারত করেন, পরিবারের জন্য সমবেদনা প্রকাশ করেন, রাফির আত্মার মাগফিরাত কামনা করে কবরে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন।
থামছে না রাফির মায়ের বিলাপ : একমাত্র মেয়েকে হারিয়ে এখনও বিলাপ করছেন রাফির মা শিরিন আক্তার। মঙ্গলবার রাফিদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, রাফির মা বিলাপ করতে করতে বলছেন, ‘তোরা আমার রাফিকে আনি দে, ও আমার বুকের মণি রাফি, ও আমার চোখের মণি রাফি, আমার শূন্য বুকে ফিরে আয়, ও আমার রাফি তুই কই, ও আল্লাহ আমাকে নিয়ে আঁর নুসরাতকে ফিরিয়ে দাও। চোখে ঘুম এলে আর নুসরাতে দেখি। আঁই ঘুম যাইতান্ন, তোরা আঁর নুসরাতকে ফিরিয়ে দে।’
মানববন্ধন : রাফি হত্যার প্রতিবাদে মঙ্গলবার সকালে ফেনী সদর উপজেলার কালিদহ এসসি উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনের সড়কে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
মাদরাসায় ৫ সদস্যের এডহক কমিটি গঠনের প্রস্তাব : সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি হত্যার ঘটনার পর গত বৃহস্পতিবার মাদরাসা র গভর্নিং কমিটি বাতিল করা হয়। এখন নতুন এডহক কমিটি গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী, এ কমিটি অনুমোদনের জন্য মঙ্গলবার আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারের কাছে প্রেরণ করা হয়েছে।
৬ মাস মেয়াদী প্রস্তাবিত এই এডহক কমিটির সভাপতি হলেন ফেনীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) সুজন চৌধুরী, সদস্য সচিব ওই মাদরাসার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মাওলানা মোহাম্মদ হোসাইন, শিক্ষানুরাগী সদস্য উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. নূরুল আমিন, শিক্ষক প্রতিনিধি মাওলানা শেখ ফরিদ ও দাতা সদস্য ডা. মোহাম্মদ শাহ আলম। মাদরাসার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মাওলানা মোহাম্মদ হোসাইন এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
প্রসঙ্গত ৬ এপ্রিল সকালে আলিম পরীক্ষা দিতে সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসায় যান নুসরাত জাহান রাফি। কয়েক জন তাকে কৌশলে ছাদে ডেকে নিয়ে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে করা শ্লীলতাহানির মামলা তুলে নিতে চাপ দেয়।
অস্বীকৃতি জানালে তার গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। এ ঘটনায় অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা, পৌর কাউন্সিলর মাকসুদ আলমসহ আটজনের নাম উল্লেখ করে সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা করেন রাফির বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান।
১০ এপ্রিল রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে মারা যান অগ্নিদগ্ধ রাফি। এর আগে ২৭ মার্চ ওই ছাত্রীকে নিজ কক্ষে নিয়ে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ওই ঘটনার পর থেকে তিনি কারাগারে আছেন।