সেমিস্টার পদ্ধতির জটিলতা নিরসনে কিছু প্রস্তাব

ড. মো. মোস্তাফিজুর রহমান |

একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় জাতীয় সংসদে পাস হওয়া আইনের মাধ্যমে। যেমন টাঙ্গাইল জেলা সদরে অবস্থিত মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (মাভাবিপ্রবি) প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ২০০১ সালের ৩৭ নং আইনের মাধ্যমে।

অবশ্য স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী সময়ে স্থাপিত পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশ দ্বারা পরিচালিত হয়, যেগুলো নিজ নিজ অধ্যাদেশ মোতাবেক নতুন প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনেক বেশি স্বায়ত্তশাসন ভোগ করে।

বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উদ্দেশ্যে প্রণীত আইনে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার সাংগঠনিক কাঠামো ও মৌলিক বিষয়াবলীর উল্লেখ থাকে। প্রায় সব ক্ষেত্রে আইনের সঙ্গেই প্রথম সংবিধি প্রণয়ন করে দেয়া হয়, যেখানে আইন-পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়ের উল্লেখ থাকে, যা চ্যান্সেলর মহোদয়ের অনুমোদন ছাড়া সংশোধন বা বাতিল করা যায় না।

একইসঙ্গে একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যাবলী সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের লক্ষ্যে সংবিধি, বিধান ও প্রবিধান প্রণয়নের দিকনির্দেশনাও আইনে বলা থাকে। একাডেমিক কার্যক্রম, গবেষণা পরিচালনা ও তত্ত্বাবধান, পরীক্ষা গ্রহণ, মূল্যায়ন পদ্ধতি এবং পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ তথা ডিগ্রি/ডিপ্লোমা প্রদানের লক্ষ্যে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে যে বিধান প্রণীত হয় তাকে একাডেমিক অর্ডিন্যান্স বা একাডেমিক রুলস বলা হয়।

সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি অনুষদ ও প্রোগ্রামের জন্য পৃথক পৃথক একাডেমিক অর্ডিন্যান্স থাকে। তবে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্ডিন্যান্সগুলোর মৌলিক বিষয়াদির মধ্যে মিল থাকে।

মূল আইন ও প্রথম সংবিধির সংশ্লিষ্ট ধারা-উপধারার আলোকে একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনার পূর্ণাঙ্গ বিধানই একাডেমিক অর্ডিন্যান্স, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিল কর্তৃক সুপারিশকৃত এবং রিজেন্ট বোর্ড/সিন্ডিকেট দ্বারা অনুমোদিত হয়ে থাকে।

পড়ালেখা ও পরীক্ষা পদ্ধতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত হওয়ায় এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কাছে সবচেয়ে পরিচিত একটি অনুষঙ্গ। তাই মাঝে মাঝে একাডেমিক অর্ডিনেন্স পরিবর্তনের বা এর ধারা শিথিল করার জন্য শিক্ষার্থীদের দাবি বা আন্দোলনের খবর পত্রিকায় দেখা যায়।

গত বছর রাজশাহী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে এমনটি দেখা গিয়েছিল। মাস দুই আগে পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে একাডেমিক অর্ডিনেন্সের কতিপয় ধারা পরিবর্তনের জন্য ছাত্র আন্দোলনের খবর আমরা পত্রিকায় দেখেছি।

মাভাবিপ্রবি’র মূল আইনের ৪৬ ধারার (২) উপধারায় বলা হয়েছে- ‘সম্পূর্ণ পাঠ্যসূচি কয়েকটি সেমিস্টারে বিভাজিত হইবে এবং ডিগ্রি/ডিপ্লোমা বিশেষের জন্য নির্ধারিতসংখ্যক কোর্স একক (ক্রেডিট আওয়ারস) প্রাপ্তির ভিত্তিতে ডিগ্রি লাভে সর্বোচ্চ সময় নির্ধারিত থাকিবে এবং প্রত্যেক পাঠ্যক্রমের সফল সমাপ্তি এবং উহার উপর পরীক্ষা গ্রহণের পর পরীক্ষার্থীকে গ্রেড প্রদান করা হইবে।’

একাডেমিক অর্ডিনেন্স প্রণয়নের সময় পরীক্ষা পদ্ধতি সংক্রান্ত উপর্যুক্ত উপধারাসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ধারা-উপধারার দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা হয়। ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশ দ্বারা পরিচালিত পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনেক আগে প্রতিষ্ঠিত বিভাগগুলোতে এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত কলেজগুলোতে এখনও সনাতন নিয়মে বার্ষিক ভিত্তিতে পরীক্ষা নেয়া হয়।

অন্য প্রায় সব ক্ষেত্রেই বর্তমানে সেমিস্টার পদ্ধতি চালু আছে। তবে দেশের সব পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ই উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের পুরনো শ্রেণী/বিভাগের পরিবর্তে গ্রেড প্রদান করছে। সেমিস্টারের ব্যাপ্তি ছয় মাস।

কিছু প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় চার মাসের সেমিস্টার চালু রেখেছে, তবে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন তাদের ছয় মাসের সেমিস্টার চালুর তাগিদ দিয়েছে।

সেমিস্টার পদ্ধতির একাডেমিক অর্ডিনেন্সের নমুনা হিসেবে মাভাবিপ্রবি’র একটি অর্ডিনেন্স বিবেচনায় নিয়ে আমরা আলোচনা করব। প্রতিটি বিভাগে সিলেবাস প্রণয়নের জন্য পাঠ্যক্রম কমিটির গঠন ও কার্যপদ্ধতি অর্ডিন্যান্সে বলা থাকে।

একটি পূর্ণাঙ্গ সিলেবাসে যত রকম কোর্স থাকবে এবং সেগুলোর নম্বরের বিভাজন ও মূল্যায়ন পদ্ধতি বিস্তারিতভাবে বলা থাকে। চার বছর মেয়াদি স্নাতক প্রোগ্রামের প্রতিটি শিক্ষাবর্ষ ছয় মাসের দুটি সেমিস্টার নিয়ে গঠিত। সেমিস্টারের একাডেমিক ক্যালেন্ডার তৈরির জন্য অর্ডিন্যান্সে নির্দেশনা দেয়া থাকে।

ছয় মাসের একটি সেমিস্টারে ক্লাস হয় ১৪ সপ্তাহ, পরীক্ষার প্রস্তুতিমূলক ছুটি ২ সপ্তাহ, সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা চলে ৩ সপ্তাহ এবং পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের জন্য ৪ সপ্তাহ বরাদ্দ থাকে। মোট ২৩ সপ্তাহ, দুই সেমিস্টারের জন্য ৪৬ সপ্তাহ।

বছরের বাকি ৬ সপ্তাহের মধ্যে দুই ঈদের ছুটি ৪ সপ্তাহ এবং শীতকালীন ও গ্রীষ্মকালীন ছুটি ১ সপ্তাহ করে। একেবারে টাইট সিডিউল। øাতক পর্যায়ে ভর্তি পরীক্ষার জন্য অন্তত এক সপ্তাহ সময় ব্যয় করতে হয়। সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা ৩ সপ্তাহে শেষ করা যায় না, সাপ্তাহিক ছুটির দিনসহ পরীক্ষা নিলেও কমপক্ষে ৪ সপ্তাহ সময় লাগে।

এ ছাড়াও আন্তঃবিভাগ/আন্তঃহল ক্রীড়া প্রতিযোগিতা কিংবা বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা উপলক্ষেও কমপক্ষে সপ্তাহখানেক সময় যায়। তাছাড়া একটি সেমিস্টার শেষ হলে পরবর্তী সেমিস্টার শুরুর আগে শিক্ষার্থীরা কয়েকদিন অবকাশ চায়, বিভাগীয় শিক্ষকদের মধ্যে নতুন সেমিস্টারের কোর্স বণ্টন ও রুটিন প্রস্তুত করতেও বিভাগীয় শিক্ষকদের কয়েকদিন সময় লাগে।

দুই সেমিস্টারের মাঝে শিক্ষকদেরও কয়েকদিন অবকাশের প্রয়োজন আছে বৈকি। এখন প্রশ্ন আসতে পারে, তাহলে একাডেমিক ক্যালেন্ডার পরিপালন করা হয় কীভাবে? এর সহজ উত্তর হল, একাডেমিক ক্যালেন্ডারে পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের জন্য যে ৪ সপ্তাহ বরাদ্দ থাকে, বিভাগীয় শিক্ষকরা এই সময়টুকু শুধু পরীক্ষার ফলাফল প্রস্তুতির কাজে ব্যয় করেন না, তারা পরীক্ষার ফলাফল প্রস্তুতির সঙ্গে সঙ্গে নতুন সেমিস্টারের ক্লাসসহ আনুষঙ্গিক কার্যক্রম শুরু করেন।

একটি প্রোগ্রামের সিলেবাসে সাধারণত থিওরি, ল্যাব/প্রাকটিক্যাল/সেশনাল, ভাইভা, থিসিস/রিসার্চ প্রোজেক্ট/ইন্টার্নশিপ, ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যাটাচমেন্ট ইত্যাদি ধরনের কোর্স থাকে। থিওরি কোর্স ছাড়া অন্য কোর্সগুলো অন্তঃপরীক্ষক ও পরীক্ষা কমিটি (বহিঃসদস্যসহ) সহযোগে মূল্যায়নের কাজ সমাধা করা যায়।

থিওরি কোর্সের ক্ষেত্রে অন্তঃপরীক্ষক উত্তরপত্র মূল্যায়নের পর বহিঃপরীক্ষকের কাছে প্রেরণ করতে হয়। বহিঃপরীক্ষক কর্তৃক উত্তরপত্র মূল্যায়নের পর মূল্যায়িত উত্তরপত্র ও মার্কসশিট ফেরত আসতে প্রায়ই বিলম্ব হয়। ফলে একাডেমিক ক্যালেন্ডারের নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে ফলাফল প্রকাশ করা সম্ভব হয় না।

মাভাবিপ্রবি আইনের ৪৬(৪) উপধারায় বলা হয়েছে- ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো বিভাগে প্রদত্ত প্রতিটি কোর্স, যাহা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ডিগ্রি প্রদানের জন্য নির্ধারিত পাঠ্যক্রমের অংশবিশেষ, উহা পরীক্ষণের জন্য নিযুক্ত পরীক্ষকগণের একজন অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয়ের বহিরাগত হইবেন।’

আইনের উপর্যুক্ত ধারা পরিপালনে থিওরি কোর্সের জন্য একজন বহিঃপরীক্ষক নিযুক্ত করতে হয়। থিসিস বা অনুরূপ কোর্সের বহিঃপরীক্ষক থাকলেও রিপোর্টের একাধিক কপি থাকার কারণে একইসঙ্গে বহিঃপরীক্ষক ও অন্তঃপরীক্ষককে প্রেরণ করা হয়। ফলে সময় কিছুটা সাশ্রয় হয়।

মাভাবিপ্রবিতে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর উভয় প্রোগ্রামই চালু আছে এমন অনেক বিভাগেই ৬-১০ জন শিক্ষক কর্মরত আছেন। এক সেমিস্টারে একজন শিক্ষককে ৩-৫টি থিওরি কোর্স নিতে হয়। প্রতিটি কোর্সের পরীক্ষার্থী থাকে সাধারণত ৬৫-৭০ জন।

অর্ডিন্যান্স মোতাবেক প্রতিদিন একজন শিক্ষক ১০টি উত্তরপত্র মূল্যায়ন করবেন। গড়ে একজন শিক্ষক ৪টি থিওরি কোর্স নিলে তার উত্তরপত্র মূল্যায়ন করতে ৪৫-৫০ দিন সময় লাগে। অন্তঃপরীক্ষকের মূল্যায়নের পর বহিঃপরীক্ষকের কাছে উত্তরপত্র প্রেরণ করতে হয়।

তিনি মূল্যায়নের পর উত্তরপত্র ও নম্বরফর্দ প্রেরণ করলে ফলাফল প্রস্তুতির পালা। অথচ একাডেমিক ক্যালেন্ডারে পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের জন্য ৪ সপ্তাহ সময় বরাদ্দ আছে, যা পরিপালন করা কোনোভাবেই সম্ভব হয় না। ১৯৯৯ সালের পর প্রতিষ্ঠিত সব বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা মোটামুটি একইরকম।

বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এক সেমিস্টারের পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ না করেই পরবর্তী সেমিস্টারের ক্লাস শুরু করতে হয়। এতে করে অনেক জটিলতার সৃষ্টি হয়। যেমন, একজন শিক্ষার্থী নতুন সেমিস্টারে ক্লাস শুরুর ২-৩ মাস পর ফলাফল প্রকাশিত হলে জানতে পারে যে সে পূর্ববর্তী সেমিস্টারে ফেল করেছে।

তখন তাকে পূর্ববর্তী সেমিস্টারে পুনঃভর্তি হয়ে পুরনো সেমিস্টারের পরীক্ষা দিতে হয়। এরকম একজন শিক্ষার্থী পরীক্ষা প্রস্তুতির জন্য ১৫-২০ দিনের বেশি সময় পায় না, ফলে আবার তার ফলাফল খারাপ হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

এভাবে নানারকম জটিলতার সৃষ্টি হয় এবং ক্রমঃপুঞ্জীভূত সমস্যা একসময় ছাত্র অসন্তোষের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শত চেষ্টা করেও সেশনজট কমাতে পারে না বরং বেড়েই চলে।

আবার মাভাবিপ্রবি আইনের ২৮(২) উপধারায় বলা হয়েছে- ‘সেমিস্টার অনুয়ায়ী নির্ধারিত বেতন ও ফিস সেমিস্টার শুরু হওয়ার পূর্বেই পরিশোধ করিতে হইবে।’ যেহেতু এক সেমিস্টারের পরীক্ষার ফল প্রকাশ না করেই পরবর্তী সেমিস্টারের ক্লাস শুরু করতে হয়, তাই কোনোভাবেই উপর্যুক্ত ২৮(২) উপধারা পরিপালন করা সম্ভব হয় না।

সেমিস্টার পদ্ধতিতে মানসম্পন্ন শিক্ষাদান ও সেশনজট নিরসনের লক্ষ্যে নিুলিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ আশু প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি। প্রথমত, শিক্ষক সংখ্যা বৃদ্ধি। পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগ বিভাগে কমপক্ষে ২৫-৩০ জন শিক্ষক কর্মরত আছেন, যেখানে মাভাবিপ্রবিতে প্রায় সব বিভাগেই কর্মরত শিক্ষকের সংখ্যা ৬-১০ জন।

নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সিনিয়র শিক্ষক পাওয়া যায় না। এজন্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রভাষক পদে নিয়োগ দিতে হয়, যাদের প্রায় সবারই উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের জন্য দেশের বাইরে যাওয়ার প্রবণতা থাকে। দক্ষ ও মানসম্পন্ন শিক্ষক তৈরির জন্য এর প্রয়োজন অনস্বীকার্য, তবে এটি শিক্ষক সংকট আরও প্রকট করে তোলে। একজন শিক্ষককে ৩-৫টি থিওরি কোর্সের পাশাপাশি প্রায় সমসংখ্যক ল্যাব/প্রাকটিক্যাল/সেশনাল কোর্স নিতে হয়।

অর্ডিন্যান্স মোতাবেক ল্যাব কোর্সের ক্রেডিটভিত্তিক ক্লাস সংখ্যা থিওরি কোর্সের দ্বিগুণ। সব মিলিয়ে একজন শিক্ষকের ক্লাসলোড অনেক বেশি। এছাড়াও স্নাতক শেষ সেমিস্টারে রিসার্চ প্রজেক্ট/ইন্টার্নশিপ এবং স্নাতকোত্তর পর্যায়ে থিসিস/প্রজেক্টের গবেষণাকর্মও তত্ত্বাবধান করতে হয়।

এতে করে মানসম্পন্ন ক্লাস নেয়া কিংবা গবেষণা পরিচালনা করা দুরূহ হয়ে পড়ে। এর পাশাপাশি পরীক্ষা গ্রহণ, মূল্যায়ন, ফলাফল প্রস্তুতির কাজও যুগপৎভাবে চলে। এমনও দেখা যায়, প্রায়ই একজন শিক্ষককে একই সেমিস্টারে একাধিক পরীক্ষা কমিটির সভাপতি, সদস্য ও টেবুলেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে হয়।

শিক্ষক সংখ্যা বাড়ানো ছাড়া এসব সমস্যার সমাধান কোনোভাবেই সম্ভব নয়। সরকার জেলা পর্যায়ে নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করছে। দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠনের জন্য এটি বর্তমান সরকারের যুগান্তকারী পদক্ষেপ।

পাশাপাশি নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মানসম্পন্ন শিক্ষাদান ও গবেষণা পরিচালনা করার ন্যূনতম সুবিধা অবশ্যই নিশ্চিত করা প্রয়োজন। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর উভয় প্রোগ্রাম চালু আছে এমন বিভাগে অন্তত ২০-২৫ জন শিক্ষক নিয়োগের অনুমোদন প্রদানের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জরি কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হল।

দ্বিতীয়ত, পর্যাপ্তসংখ্যক ক্লাসরুম, ল্যাবরেটরি, সেমিনার লাইব্রেরি তথা দ্রুতগতির ইন্টারনেট সংযোগসহ ডিজিটাল লাইব্রেরি এবং ল্যাবরেটরিতে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও উপকরণ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।

আশার কথা হল, গত ৩-৪ বছরে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জরি কমিশনের বিভিন্ন প্রজেক্টের মাধ্যমে এসব সমস্যা অনেকাংশেই দূর হয়েছে। এছাড়াও হেকেপ (হ্যায়ার এডুকেশন কোয়ালিটি এনহেন্সমেন্ট প্রজেক্ট)-এর মাধ্যমেও ল্যাবরেটরিতে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ও উপকরণ সরবরাহসহ বিভাগগুলোতে শিক্ষার পরিবেশ অনেকটাই উন্নত হয়েছে।

এখনও মাভাবিপ্রবিতে ক্লাসরুম ও ল্যাবরেটরির তীব্র সংকট রয়েছে। তবে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ভৌত ও অবকাঠামো উন্নয়ন খাতে প্রায় সাড়ে তিনশ’ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। বরাদ্দকৃত অর্থে একাডেমিক ভবন, প্রশাসনিক ভবন, ছাত্র-ছাত্রীদের হলসহ বিভিন্ন অবকাঠামোর নির্মাণকাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে।

এ প্রকল্পের কাজ সমাপ্ত হলে আগামী ১৫-২০ বছর মাভাবিপ্রবিতে অবকাঠামোগত সমস্যা থাকবে না। বর্তমান সরকারের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো হওয়ার কারণে প্রায় সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অবকাঠামো উন্নয়নের অনুরূপ প্রকল্প চলমান আছে।

তৃতীয়ত, বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের লক্ষ্যে প্রণীত আইনের কিছু ধারা-উপধারা সংশোধন করা প্রয়োজন। যেমন, ৪৬(৪) উপধারায় বলা হয়েছে- ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো বিভাগে প্রদত্ত প্রতিটি কোর্স, যাহা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ডিগ্রি প্রদানের জন্য নির্ধারিত পাঠ্যক্রমের অংশবিশেষ, উহা পরীক্ষণের জন্য নিযুক্ত পরীক্ষকগণের একজন অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয়ের বহিরাগত হইবেন।’

উপধারাটি পরিপালনের জন্য থিওরি কোর্সের উত্তরপত্র একজন বহিঃপরীক্ষকের কাছে প্রেরণ করা হয়, যা পরীক্ষার ফলাফল যথাসময়ে প্রকাশের সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। উপধারাটি সংশোধনপূর্বক বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলের এখতিয়ারভুক্ত করা হলে বিশ্ববিদ্যালয় বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।

আবার মাভাবিপ্রবি আইনের ২৮(২) উপধারা বলছে- ‘সেমিস্টার অনুয়ায়ী নির্ধারিত বেতন ও ফিস সেমিস্টার শুরু হওয়ার পূর্বেই পরিশোধ করিতে হইবে।’ যেহেতু উপধারাটি পরিপালন করা সম্ভব হয় না, সেহেতু এর সংশোধন বা বিয়োজন অপরিহার্য।

এরূপ কিছু ধারা-উপধারা সংশোধন সংযোজন বা বিয়োজনের জন্য ইতিপূর্বে মাভাবিপ্রবি থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর ও মহামান্য রাষ্ট্রপতি বরাবর প্রস্তাব প্রেরণ করা হয়েছিল। কিন্তু অদ্যাবধি কোনো ফল হয়নি।

বিষয়টি একটু জটিলই বটে; কারণ বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা শেষে আইনটি সংশোধনের জন্য জাতীয় সংসদে উত্থাপিত হতে হবে। বর্তমান সরকার সরকারি কলেজগুলো সংশ্লিষ্ট এলাকার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

এ লক্ষ্যে ইতিমধ্যেই সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে অতিরিক্ত জনবল ও অবকাঠামোর চাহিদাপত্র গ্রহণ করা হয়েছে। ঢাকা শহরের সরকারি কলেজগুলো এর মধ্যেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়েছে।

এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করার জন্য ১৯৯৯ সালের পর প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আইন সংশোধন করতে হবে; কারণ এ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আইনে কলেজ অধিভুক্তি করার ধারা নেই।

কলেজ অধিভুক্তির ধারা সংযোজন করে যখন আইন সংশোধন করা হবে তখন সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি সহযোগে গঠিত কমিটির মাধ্যমে আইনের অসঙ্গতিপূর্ণ ধারা-উপধারাগুলো পর্যালোচনাপূর্বক সংশোধন, সংযোজন বা বিয়োজনের প্রস্তাবনা গ্রহণ করা যেতে পারে।

প্রয়োজনীয়সংখ্যক মানসম্পন্ন শিক্ষক থাকলে এবং সুষ্ঠু নিয়মনীতি, বিধি-বিধান সঠিকভাবে পরিপালিত হলে বিশ্ববিদ্যালয়ে একাডেমিক ও প্রশাসনিক কাজে গতি বাড়ে।

ফলে জ্ঞান সৃজন ও বিতরণের পরিবেশ উন্নত হয়। এভাবেই জ্ঞানভিত্তিক দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির মাধ্যমে স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ বিনির্মাণ সম্ভব হবে।

 

লেখক : পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, টাঙ্গাইল

 

সূত্র: যুগান্তর


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0071830749511719