স্কুলছাত্রকে ডাকাত সাজিয়ে পায়ে পুলিশের গুলি

ইকবাল হাসান ফরিদ |

ইমন, সাকিব ও আবু নাঈম। তিন সহপাঠী। দরিদ্র পরিবারের সন্তান। সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করে দারিদ্র্যের কাছে হার মানে আবু নাঈম। আর ইমন ও সাকিব জীবনযুদ্ধের পাশাপাশি চালিয়ে যাচ্ছিল লেখাপড়া। নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ের পঞ্চমীঘাট উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণীতে পড়ত। ঘুরতে গিয়ে তারা পড়ে পুলিশের পাল্লায়। গায়ে লেগেছে ডাকাত তকমা। এখন দু-দুটি মামলার আসামি তারা। তিন মাসের বেশি সময় কারাভোগের পর সম্প্রতি জামিনে ছাড়া পেয়েছে সাকিব। আর পুলিশের গুলিতে প্রায় পঙ্গু ইমন ও আবু নাঈম। জামিন নিয়ে আবু নাঈম রয়েছে নানাবাড়িতে, চিকিৎসা বন্ধ। ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে পুলিশি পাহারায় চলছে ইমনের চিকিৎসা। কিন্তু খরচ বহন করতে হচ্ছে দরিদ্র মা-বাবাকেই। ধারদেনা আর সুদে ঋণ নিয়ে বিপর্যস্ত হয়ে তারা হাত পাতছেন মানুষের কাছে। ইমন জানায়, দিনটি ছিল ২২ মে ২০১৮। দিনভর রাজমিস্ত্রির জোগালির কাজ করি। সন্ধ্যায় ইফতার করি পঞ্চমীঘাট বাজারে। দেখা হয় সহপাঠী সাকিব ও আবু নাঈমের সঙ্গে। পরিচিত হৃদয় হাসান শান্তও আসে বাজারে। শান্ত সিএনজিতে (অটোরিকশা) ঘুরতে যাওয়ার প্রস্তাব দেয়। আমরা রাজি হই। চেপে বসি শান্তর পরিচিত এক সিএনজিতে।

Caption

ইমন জানায়, ‘রাত তখন প্রায় সাড়ে ৮টা প্রায়। পাশের গ্রাম দরিকান্দি যাওয়ামাত্রই পুলিশের টহল ভ্যান আমাদের অটোরিকশা আটকায়। চালককে ছেড়ে দিয়ে পুলিশ আমাদের কাছে ৪ লাখ টাকা দাবি করে। টাকা না দিলে গুলি করে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। কিন্তু আমরা টাকা দিতে পারব না জানালে আমাদের গাড়িতে নিয়ে ঘুরতে থাকে পুলিশ। বাড়িতেও যোগাযোগ করতে দেয়নি। গভীর রাতে আমাদের দূরে কোনো এক জঙ্গলে নিয়ে যায়। আমার ও আবু নাঈমের চোখ বাঁধে। এরপর পায়ে বন্দুকের নল ঠেকিয়ে গুলি করে। পরে আমাদের হাসপাতালে নিয়ে আসে।’ কেন গুলি করেছে? জানতে চাইলে ইমন বলে, ‘আমি জানি না, পুলিশ জানে, আর আল্লায় জানে। আমি কোনো অপরাধ করিনি। কোনো অপরাধের সঙ্গে জড়িতও নই।’

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সোনারগাঁও থানার এসআই আবদুল হক শিকদার এ চারজনকে আটক করে থানায় নেন। ৪ লাখ টাকা দাবি করেন। কিন্তু দরিদ্র এ কিশোররা টাকা দেয়ার মতো সামর্থ্য নেই জানালে রাতেই তাদের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সোনাখালী এলাকায় নির্জন স্থানে নিয়ে যান আবদুল হক শিকদার। এরপর ইমন ও আবু নাঈমের ডান হাঁটুতে শটগান ঠেকিয়ে গুলি করা হয়। তাদের প্রথমে সোনারগাঁও হাসপাতাল ও পরে ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আর সাকিব ও শান্তকে পাঠানো হয় আদালতের মাধ্যমে কারাগারে। চারজনের বিরুদ্ধে ডাকাতি ও পুলিশের ওপর হামলার মামলা করা হয়। চারজনেরই বয়স ১৪ বছর হলেও মামলায় দেখানো হয় ১৮ ও ১৯। আর ‘ডাকাতি’র আলামত হিসেবে দেশীয় অস্ত্র জব্দ দেখানো হয়।

ইমন সোনারগাঁওয়ের নানাখী দক্ষিণপাড়া গ্রামের দিনমজুর আবদুল বাতেনের ছেলে। সাকিবের বাবা জাহাঙ্গীর হোসেনও দিনমজুর। আবু নাঈমের বাবা মো. রাশেদ ঝালমুড়ি বিক্রেতা। মজুরিভিত্তিক কাজ করার কারণে ছেলে আবু নাঈমের পাশে থাকতে পারেন না বাবা আবদুল বাতেন। চার মাস ধরে ঢামেক হাসপাতালে ছেলের পাশে রয়েছেন মা জায়েদা খাতুন। তিনি বলেন, ইমনের চিকিৎসায় লক্ষাধিক টাকা খরচ হয়ে গেছে। ৫০ হাজার টাকা সুদে এনে খরচ করেছি। এলাকার বিভিন্ন মানুষের সহযোগিতায় এতদিন চলছিল চিকিৎসা। এখন আর কারও কাছ থেকে ধারদেনা করারও সুযোগ নেই। নিরুপায় হয়ে হাসপাতালের আশপাশের দোকানপাট ও সাধারণ মানুষের কাছে হাত পাতি। কখনও কখনও ডাক্তার-নার্সরাও সহযোগিতা করেন। পাহারায় থাকা পুলিশ সদস্য কেউ কেউও সহযোগিতা করেন।

জায়েদা বলেন, অভাবের সংসারে স্কুলের খরচ জোগাতে পারতাম না আমরা। ইমন তাই কখনও কখনও বাবার সঙ্গে দিনমজুরের কাজ করত। যা পেত তা দিয়ে স্কুলের বেতন ও আনুষঙ্গিক খরচ চালাত। এছাড়া সে সেলাইয়ের কাজ শিখত পঞ্চমীঘাট বাজারের তানিয়া মডার্ন টেইলার্সে। পঞ্চমীঘাট উচ্চ বিদ্যালয়ে ৮ম শ্রেণীতে পড়ে সে। মামলা আর গুলির কারণে অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে ওর লেখাপড়াও।

পঞ্চমীঘাট এলাকায় গিয়ে ইমনের বাবাকে পাওয়া যায়নি। প্রতিবেশীরা জানান, তিনি কাজে গেছেন। তার মোবাইল ফোনও নেই। পঞ্চমীঘাট স্কুলের পাশে দেখা হয় আবু নাঈমের বাবা ঝালমুড়ি বিক্রেতা রাশেদ মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, ছেলে আমার যদি অপরাধী হতো তাহলে কথা ছিল। আমার নিরপরাধ ছেলেকে গুলি করে পুলিশ পঙ্গু করে দিল। এরপর ডাকাতির মামলা দিল। তিনি বলেন, সুদে নেয়া টাকা নিয়ে ছেলের চিকিৎসা করাইছি। এখনও সে সুস্থ নয়। চিকিৎসা খরচ দিতে না পেরে তাকে বাড়ি নিয়ে এসেছি।

রাশেদ বলেন, ‘আবু নাঈম পঞ্চমীঘাট উচ্চ বিদ্যালয়ে ইমন-সাকিবদের সঙ্গে পড়ত। সেভেন পর্যন্ত পড়ানোর পর খরচ দিতে না পেরে ছেলের লেখাপড়া বন্ধ করে দিই। এরপর থেকে সে আমার সঙ্গে কাজ করে। কেউ বলতে পারবে না, ছেলে আমার কোনো অসৎ কাজে জড়িত।’ আবু নাঈম এখন কোথায়? জবাবে তার বাবা জানান, জামিন করানোর পর তাকে তার নানার বাড়িতে রাখা হয়েছে।

নানাখি গ্রামে নানা আফছার উদ্দিনের বাড়িতে গিয়ে দেখা মিলে পায়ে রড লাগানো আবু নাঈমের। বিছানায় তাকে বসিয়ে রাখা হয়েছে। চিকিৎসা ব্যয় বহন করতে না পেরে তার কবিরাজি চিকিৎসা করা হচ্ছে। তার পায়ে ইনফেকশন হয়ে গেছে। আফছার উদ্দিন জানান, তিন লাখের বেশি টাকা খরচ হয়ে গেছে। তার বাবা সুদে টাকা এনে দিয়েছে। আমিও ধারকর্য করে দিয়েছি। এখন চিকিৎসা চালানোর সামর্থ্য নেই। তাই বাড়িতেই রেখেছি।

সেদিনের ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে আবু নাঈম জানায়, পুলিশ যখন আমাদের ধরে তখন আমি ভয়ে অজ্ঞান হয়ে যাই। যখন জ্ঞান ফিরে তখন দেখতে পাই আমি হাসপাতালের বিছানায়। আমার পায়ে গুলি। আবু নাঈম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে, কাকে দোষ দেব! এ আমার কপালের লিখন। সেদিন যদি ঘুরতে না যেতাম, তবে পঙ্গুও হতাম না, আর ডাকাতির তকমা গায়ে লাগত না।

কথা হয় সাকিবের বাবা জাহাঙ্গীরের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘কি করব, নসিবে ছিল। এইটে পড়ে ছেলে আমার নাকি ডাকাতি করতে গেছে। সেই ছেলে আমার এখন হাজত খাটতাছে।’ রোববার মুঠোফোনে তিনি জানান, ক’দিন আগে সাকিবের জামিন হয়েছে, সে এখন বাড়িতেই আছে।

তানিয়া মডার্ন টেইলাসের্র মালিক মজিবুর রহমান বলেন, ইমন খুবই নিরীহ ছেলে। আমার দোকানে দর্জির কাজ শিখত। সে চা, পান, সিগারেট কিছুই খায় না। ধমক দিলে এখনও কেঁদে ফেলে। ওই ছেলে ডাকাতি করতে যাবে! পঞ্চমীঘাট স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রধান শিক্ষক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ইমন ও সাকিব এ বছর জেএসসি পরীক্ষার্থী ছিল। কিন্তু তাদের পরীক্ষা দেয়া অনিশ্চিত হয়ে গেছে। তিনি বলেন, যতটুকু জানি, এরা একদম গরিব এবং খুবই নিরীহ। এরা ডাকাতির সঙ্গে জড়িত থাকার কথা নয়। এদের হাজিরা খাতায় নাম আছে। এরা স্কুলের নিয়মিত ছাত্র।

মামলায় যা আছে : ২৩ মে সোনারগাঁও থানার এসআই আবদুল হক শিকদার বাদী হয়ে দুটি মামলা করেন। নং ৬২/৩৭৮ ও ৬৩/৩৭৯। মামলাগুলোর এজাহারে প্রায় অভিন্ন বর্ণনাই দিয়েছেন তিনি। লিখেছেন, ২২ মে দিনগত রাতে ডিউটি করাকালীন রাত পৌনে ২টায় মোগড়াপাড়া চৌরাস্তায় অবস্থান করাকালে গোপন সংবাদে জানতে পারি সোনারগাঁও থানাধীন সোনাখালী গ্রামস্থ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে চট্টগ্রামগামী লেন সংলগ্ন বাংলা ফুড কোম্পানি লিমিটেডের প্রবেশের কাঁচা রাস্তার মধ্যবর্তী স্থানে অজ্ঞাতনামা ১০-১২ জনের সংঘবদ্ধ একটি ডাকাত দল মহাসড়কে ডাকাতির উদ্দেশে দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রসহ সমবেত হয়ে শলাপরামর্শ করছে। বিষয়টি অফিসার্স ইনচার্জ সোনারগাঁও থানা ও কিলো-৭ ডিউটিরত এসআই মো. জুবায়ের হোসেন ও টাইগার-৭৭ ডিউটিরত এএসআই নারায়ণ ভৌমিককে জানালে তারা সঙ্গীয় ফোর্সসহ রাত ২টায় ঘটনাস্থলে পৌঁছেন। পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে ডাকাতরা দা, চাপাতি, ছোরা, লাঠিসোটা ইত্যাদি অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে বেআইনি জনতাবদ্ধে হত্যার উদ্দেশ্যে আমাদের ওপর অতর্কিত হামলা করে। ডাকাতদের হামলায় কনস্টেবল আওলাদ হোসেন, কনস্টেবল বাহাউদ্দিন গুরুতর জখম হয়। আমি সঙ্গীয় ফোর্সসহ সামান্য আহত হই। তখন আমাদের জানমাল এবং সরকারি অস্ত্রগুলো রক্ষার্থে কনস্টেবল নুর মোহাম্মদের নামে ইস্যুকৃত শটগান থেকে ৩ রাউন্ড রাবার বুলেট ফায়ার করলে ওই রাবার বুলেট দু’জন ডাকাতের ডানপায়ে বিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। তখন অন্য ডাকাতরা পালানোর চেষ্টা করলে আমি সঙ্গীয় ফোর্সসহ আহত দু’জনসহ চার ডাকাতকে দেশীয় অস্ত্রসহ ধরে ফেলি।

যোগাযোগ করা হলে সোনারগাঁও এএসআই নারায়ণ ভৌমিক  বলেন, ‘এ ব্যাপারে হক স্যারের (এসআই আবদুল হক) সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তিনি ভালো বলতে পারবেন। আমাকে দিয়ে আহতদের হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। এর বাইরে আমি কিছু বলতে পারব না।’ যোগাযোগ করা হলে এসআই জুবায়ের হোসেন বলেন, ‘খবর পেয়ে আমি যখন ঘটনাস্থলে গেছি, তখন অভিযান শেষ। আপনি হক সাহেবের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।’ যোগাযোগ করা হলে এসআই আবদুল হক সিকদার বলেন, ওরা ডাকাত, ওদের আমি দেশীয় অস্ত্রসহ ধরেছি। সাকিব ও ইমন যে স্কুলছাত্র সে বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে, তিনি বলেন, আমি এখন গাড়ি ড্রাইভ করছি। এখন এ বিষয়ে কথা বলতে পারছি না। পরে কথা বলব। এরপর বেশ কয়েকবার ফোন দেয়া হলেও তিনি আর রিসিভ করেননি।

 

সৌজন্যে: যুগান্তর


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ - dainik shiksha আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0036170482635498