স্কুলে নয়, মুখে তালা লাগান

মো. সিদ্দিকুর রহমান |

১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ জানুয়ারি ঢাকায় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশন আন্দোলন প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান বলেছেন, “আন্দোলন গাছের ফল নয়। আন্দোলন মুখ দিয়ে বললেই করা যায় না। আন্দোলনের জন্য জনমত সৃষ্টি করতে হয়। আন্দোলনের জন্য আদর্শ থাকতে হয়। আন্দোলনের নিঃস্বার্থ কর্মী থাকতে হয়। ত্যাগী মানুষ থাকা দরকার। আর সর্বোপরি জনগণের সংঘবদ্ধ ও ঐক্যবদ্ধ সমর্থন থাকা দরকার”। এবারে শিক্ষক আন্দোলন প্রসঙ্গে শিক্ষক আন্দোলনের একজন কর্মী হিসেবে আমার পর্যবেক্ষণে যে সকল চ্যালেঞ্জগুলো প্রতীয়মান হয়েছে, তা হলো তৃণমূলের ত্যাগের মাধ্যমে অধিকাংশ নেতৃত্ব সৃষ্টি হয়নি। তাদের নেতৃত্বের বৈশিষ্ট্য হলো কর্মকর্তা, নেতা ও মন্ত্রীদের তোষামোদির মাধ্যমে নেতৃত্ব দান। তাদের আদর্শ হলো, যখন যে মন্ত্রী বা কর্মকর্তা হবে, তখন তার গুণগানে ব্যস্ত থেকে স্বীয় স্বার্থসিদ্ধ উদ্ধার করা। অধিকাংশ নেতাদের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আদর্শ দৃশ্যমান নয়।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হলো অধিকার বঞ্চিত হলে তীব্র প্রতিবাদ করা ও তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা। নেতারা মন্ত্রী, কর্মকর্তাদের সামনে উপস্থিত হলে তোষামোদি করতে করতে গলা শুকিয়ে ফেলে। নেতৃত্বের ভাষা হবে বজ্রকণ্ঠে প্রতিবাদের। অথচ সে ভাষা তাদের মাঝে লক্ষ করা যায় না। অধিকাংশ নেতা অনেকটা বিড়াল মিউ মিউ করলে সিংহের গর্জন মনে করে ভয় পায়। এক কথায় বলতে গেলে প্রাথমিক শিক্ষকদের প্রতি তাদের ভালোবাসার নিদারুণ অভাব। সকল ভালবাসা স্বীয় স্বার্থসিদ্ধির জন্য। তাদের মাঝে আদর্শ, ত্যাগী মনোভাব, দূরদর্শিতার অভাব বিদ্যমান। তারা ফেসবুকে স্ট্যাটাস, মন্ত্রী, সচিব ও কর্মকর্তাদের প্রিয়ভাজন হিসেবে দেখানোর কাজে অভ্যস্থ। সাধারণ শিক্ষকদের দ্বারে দ্বারে গিয়ে তাদের সংগ্রামী মনোভাব সৃষ্টি করার তেমন কোনো দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যায় না। শুধু ফটোসেশন, বড় বড় লম্প-জম্প করে সব উদ্ধার করবে ভাব দেখায়। ভাবখানা এমন বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সকল বড় বড় নেতা, কর্মকর্তা তাদের সান্নিধ্যে আছে। একটা বাস্তব উদাহরণ উপস্থাপন করছি। ঢাকা শহরের একজন অতি কৌশলী স্বার্থন্বেষী ব্যক্তি প্রচার করে বেড়ায় মন্ত্রী, বড় বড় সরকারি কর্মকর্তা, বিরোধী দলীয় নেতার সাথে প্রায় প্রতিদিন আমার সাথে দেখা হয় এবং আমাদের পার্শ্বের রাস্তা দিয়ে চলাফেরা করে। এ কথায় শুনে কেউ কেউ বিশ্বাস স্থাপন করে তার প্রিয়ভাজন হয়ে পড়ে। আসলে তিনি একেবারে মিথ্যার আশ্রয় নেননি। টেলিভিশন খুললেই বিভিন্ন চ্যানেলের মাধ্যমে দেখা হয়। তাদের গাড়িও ঢাকা শহরের রাস্তার দিয়ে প্রতিনিয়ত যায়।

প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রথমত, প্রধান শিক্ষকদের ১০ম গ্রেড ও সহকারী শিক্ষকদের ১২তম গ্রেডের প্রস্তাব অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠান। তখন কোনো সংগঠনকে প্রতিবাদের জোরালো ভূমিকা নিয়ে বজ্রকণ্ঠে এগিয়ে আসতে দৃশ্যমান হয়নি। নেতারা তখন চোর গৃহস্তের মতো অর্থ মন্ত্রণালয়ের ১২তম গ্রেডের প্রস্তাব শুধু শুয়ে শুয়ে দেখছে। প্রস্তাব নাকচ করায় সব দোষ নন্দ ঘোষের মতো অর্থ মন্ত্রণালয়কে দোষারোপ করছে। দেখা গেছে, একবারও নিজেদের বা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে দায় নিয়ে সমালোচনা করতে দেখেনি। সচিব ও প্রতিমন্ত্রী ১১ গ্রেড আশ্বাস দিয়ে বিশ্বাস স্থাপন করেনি। হায়রে তোষামোদির নেতাদের ১৪টি সংগঠনের ঐক্য পরিষদ, মহাজোট বিষয়টিকে নিয়ে কেন তাদের মনে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়নি।

নবীন নেতারা হয়তো আমাকে বলবেন, কী করেছেন, এখন তো শিক্ষকতায় নেই, তাই বড় বড় কথা বলতে কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। শিক্ষকতায় থাকাকালীন বহু দুঃসাহসী কাজ করেছি। ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রাথমিক শিক্ষকদের সর্বপ্রথম বেতন বৈষম্য আন্দোলন। সে আন্দোলনে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া প্রধান অতিথি হিসেবে জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহে ভাষণ দিয়েছিলেন। পুরো ওসমানী মিলনায়তনের চারপার্শ্বে ঘিরে ছিল ডিজিএফআই এসবি, এনএসআই দিয়ে নিরাপত্তা বেষ্টিত। সে সময় ভয়ভীতি পরিহার করে বেতন বৈষম্যের লিফলেট বিতরণ করি আমি ও বর্তমান লালবাগ থানার একটি স্কুলে কর্মরত শিক্ষক সেলিমুজ্জামান গ্রেফতার হই। শিক্ষকতায় থাকাকালীন অসংখ্য প্রতিবাদ ও সংগ্রামের কথা মনে পড়ে। চাকুরিচ্যুতি ভয়ে মরহুম নুরুল আবছার, ওহিদুজ্জামান মিয়া, বি.এম আসাদউল্যা গং বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি বিলুপ্তি করে ঘৃণ্য চক্রের কাছে হস্তান্তর করেছেন। চাকুরিচ্যুতির ভয় উপেক্ষা করে এককভাবে সমিতির অস্তিত্ব রক্ষার জন্য কাজ করেছি। আ. আউয়াল তালুকদারকে পরাস্ত করতে সমর্থ হয়েছি। ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে আন্দোলনে ঢাকা শহরের বড় বড় নেতা বি.এম. আসাদউল্যা, ওয়াহিদুজ্জামান গং বেতন পাওয়ার জন্য হাজিরা খাতা, মাসকাবারা নিজেরা তো কর্মবিরতিতে স্বাক্ষর করেছেন ও আমার জানা মতে পুরো ঢাকা শহরের শিক্ষকদেরও স্বাক্ষর করিয়েছেন। কেবলমাত্র আমি ও বর্তমান ঢাকার মতিঝিল থানার আইডিয়াল মুসলিম বালিকা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ফাহমিদা সুলতানা কর্মবিরতি লিখে বেতন নিয়েছি। আমাদের বক্তব্য ছিল ১৫ দিনের বেতন কম নিবো তবুও কর্মবিরতি স্থলে স্বাক্ষর করব না। এবারে প্রাথমিক শিক্ষকদের সংগ্রামের ইতিহাস ও কতিপয় অর্জন তুলে ধরছি।

স্বাধীনতা যুদ্ধে সকল পেশাজীবীদের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষকেরা মুক্তিযুদ্ধে সর্বাধিক সংখ্যক অংশগ্রহণ করেছেন। গভর্নর মোনায়েম খানের সময়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি বঙ্গভবন ঘেরাও করে সর্বপ্রথম শিক্ষকদের বেতন স্কেল ১২০ টাকা, ইনক্রিমেন্ট ২ টাকা, পরবর্তী সময়ে ১৩০ টাকা ও ৩ টাকা আদায় করেন। পরে বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান প্রাথমিক শিক্ষকদের চাকরি সরকারিকরণ করেন। বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির নেতৃত্বে প্রাথমিক শিক্ষকদের থানার বাহিরে বদলি রোধ, আইএ পাস শিক্ষকদের ২টি, বিএ পাস শিক্ষকদের ৪টি ইনক্রিমেন্ট, প্রাথমিক শিক্ষকদের ন্যায্যমূল্যে কাপড়, সার্ভিস বুকের সংকট দূর, প্রাথমিকের সকল কমিটিতে শিক্ষক প্রতিনিধি, ২ বছরের ট্রেনিং বাতিল, উপজেলা পরিষদের ওপর থেকে নিয়োগ ও প্রশাসনিক ক্ষমতা বাতিল, কল্যাণ ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠা, প্রাথমিক শিক্ষকদের পোষ্যের কোটার অধিকার, প্রধান শিক্ষকদের বেতন স্কেল ৩০০ টাকা স্থলে ৩২৫ টাকা উন্নীত, ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দের ১ জুলাইয়ের পূর্বের চাকরির ৫০ শতাংশ গণনা ও সুবিধা প্রদান। এ সুবিধা হাইস্কুল, কলেজ ও মাদরাসা শিক্ষকদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। উপজেলার শাস্তির বিরুদ্ধে আপিলের অধিকার। ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দে প্রাথমিক শিক্ষা বেসরকারিকরণের প্রতিবাদে সকল শিক্ষক পরিবারে সদস্য নিয়ে ঢাকা ৩ লাখ লোকের সমাবেশ, ৩ মাস ১০ দিন বিদ্যালয়ে তালা ঝুলান, তত্ত্ববধায়ক সরকারের আমলে ব্র্যাকবিরোধী আন্দোলনে সফল, ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দে বৈষম্য দূরীকরণ আন্দোলনে নন ট্রেইন্ড বিএ, এমএ পাশস শিক্ষকদের ২৬০০ টাকার ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারীর স্কেল থেকে ৩০০০ টাকা (যা অফিস সহকারীদের) স্কেল ও সহকারী শিক্ষকদের টেইন্ড ৩১০০ ও প্রধান শিক্ষকদের ৩৭০০ টাকা বেতন স্কেল উন্নীত হয়, শ্রান্তি বিনোদন ভাতা ৩ বছর পর পর প্রাপ্তির জন্য গ্রীষ্মের ছুটি ১৫ দিন নির্ধারণ, ঢাকা চট্টগ্রাম শহরের বিদ্যালয়ের সময়সূচি ৭ দশমিক ৩০ থেকে ২ দশমিক ১৫ নির্ধারণ, দুর্নীতি পরায়ন কর্মকর্তা বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ, কোনো শিক্ষক আক্রান্ত হলে উপজেলা, জেলা ও কেন্দ্রীয় সমিতি তাৎক্ষণিক প্রতিরোধের কর্মসূচি গ্রহণ করতেন।

প্রাথমিক শিক্ষক সমিতিসহ সরকারি কর্মচারী সমন্বয় পরিষদের যৌথ আন্দোলনে আজকের উৎসব বোনাস, ৮-১২-১৫ বছর পুর্তিতে টাইমস্কেলসহ অনেক অর্জন ও অনেক আন্দোলন আজ মনে করতে পারছি না। আজ আন্তরিকভাবে প্রাথমিক শিক্ষকদের অভিনন্দন জানাই তাদের ঐক্যবদ্ধভাবে বেতন বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনে এগিয়ে আসার জন্য। আমার কাছে খবর আসছে ঢাকা শহরে কতিপয় স্কুল কর্মবিরতি পালন করে নাই। আমি সরেজমিনে পরিদর্শন করে দেখলাম, কর্মকর্তাদের চাপে তারা ক্লাসে গেলেও সেখানে তারা নিরবভাবে কর্মবিরতি পালন করছেন। নেতাদের উদ্দেশ্য বলছি, আদর্শ, ত্যাগ ভালোবাসা নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হোন। নচেৎ এ নেতৃত্ব শিগগির হোঁচট খাবে। পরিশেষে, যা তা বক্তব্য দিয়ে শিক্ষকদের কাছে হেয় প্রতিপন্ন হবেন না। এবারে স্কুলে তালা লাগানোর আগে ঐক্যবদ্ধ নেতৃত্বের শক্তি সঞ্চয় করুন। এর আগে মুখে তালা লাগান। নেতাদের শিক্ষকদের প্রতি ভালবাসা জাগ্রত হোক।

মো. সিদ্দিকুর রহমান : সভাপতি, বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা গবেষণা পরিষদ; সম্পাদকীয় উপদেষ্টা, দৈনিক শিক্ষাডটকম।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0030958652496338