স্কুলে স্কুলে পৌঁছে গেছে ২৭ কোটি পাঠ্যবই

সাব্বির নেওয়াজ |

জাতীয় সংসদ নির্বাচন ৩০ ডিসেম্বর, আর সারাদেশে পাঠ্যপুস্তক উৎসব ১ জানুয়ারি। নির্বাচনের মাত্র একদিন পর বিনামূল্যের পাঠ্যবই তুলে দিতে হবে সারাদেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের চার কোটি ২৬ লাখ ১৯ হাজার শিক্ষার্থীর হাতে। বিশাল এই চ্যালেঞ্জকে সামনে নিয়ে গত ২৫ আগস্ট থেকে সারাদেশের প্রথম থেকে নবম শ্রেণিপড়ূয়া ছাত্রছাত্রীর জন্য ৩৫ কোটি ২১ লাখ ৯৭ হাজার ৮৮২ কপি পাঠ্যবই ছাপাতে শুরু করে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। মাত্র তিন মাসে ৮৫ ভাগ পাঠ্যবই ছাপা হয়ে পৌঁছে গেছে স্কুলে স্কুলে। তাই ১ জানুয়ারি পাঠ্যবই উৎসব নিয়ে কারও মধ্যে কোনো শঙ্কা নেই। এবার আগেভাগেই বেশিরভাগ পাঠ্যবই ছাপা হয়ে বিদ্যালয়ে পৌঁছে যাওয়ায় অভিভাবক, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের চোখেমুখে এখন খুশির ঝিলিক।

এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা মঙ্গলবার তার কার্যালয়ে বলেন, 'পাঠ্যবই নিয়ে এবারও কোনো শঙ্কা নেই। ৮৫ শতাংশ বই ছাপা হয়ে চলে গেছে জেলা ও উপজেলায়। বিদ্যালয়ে সেগুলো পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। শিশুদের মাঝে বিতরণের জন্য বিদ্যালয়েই সেগুলো সংরক্ষণ করা হচ্ছে।' চেয়ারম্যান জানান, তাদের হাতে যেটুকু সময় এখনও আছে, তাতে বাকি ১৫ শতাংশ বইও যথাসময়ে পৌঁছে যাবে।

এনসিটিবির বিতরণ নিয়ন্ত্রক প্রফেসর মো. জিয়াউল হক জানান, তাদের হিসাব অনুযায়ী ২৭ নভেম্বর পর্যন্ত ৩৫ কোটি পাঠ্যবইয়ের মধ্যে ২৭ কোটি ৭৬ লাখ কপি বই ছাপা হয়ে সারাদেশের বিদ্যালয়গুলোতে পৌঁছে গেছে। বাকি সাড়ে আট কোটি বই আগামী ১০ ডিসেম্বরের মধ্যেই ছেপে পৌঁছানো হবে স্কুলগুলোতে। 

নওগাঁর রানীনগর উপজেলা সহকারী মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, 'মাঠ পর্যায়ে ছাপা হয়ে আসা পাঠ্যবই গ্রহণ করে বিদ্যালয়গুলোতে সেগুলো বিতরণ করছি আমরা। বেশিরভাগ বই-ই এবার আগেভাগে চলে এসেছে।' শরীয়তপুরের ডামুড্যা উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা কাজী আবদুল মুকিম জানান, তার উপজেলাতেও বিনামূল্যের বইয়ের বড় অংশ চলে এসেছে। দু-একজন

শিক্ষা কর্মকর্তা জানান, এবার বেশি আগেভাগেই পাঠ্যবই ছাপা হয়ে চলে আসায় এক ধরনের বিপদেও পড়েছেন তারা- এত বিপুল পরিমাণ পাঠ্যবই সংরক্ষণের জন্য উপজেলা পর্যায়ে কোনো নির্দিষ্ট গুদামঘর নেই। বাধ্য হয়ে বিভিন্ন বিদ্যালয়ে রাখেন তা। অনেক বিদ্যালয়ে আবার ভালো ভবন না থাকায় বই নষ্ট বা চুরির ভয় থাকে। এ ছাড়া বেশিরভাগ বিদ্যালয়েই এখন বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হয়ে চলছে। ক্লাসরুম ফাঁকা নেই তাই। আবার ফাঁকা থাকলেও ৩০ ডিসেম্বরের আগেই ক্লাস রুম ফাঁকা করে দিতে বলেছে নির্বাচন কমিশন। কারণ বিদ্যালয়ে ভোটকেন্দ্র হলে ক্লাসরুমগুলোতে ভোট গ্রহণের বুথ স্থাপন করতে হবে। তাই বই রাখা নিয়ে জেলা ও উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তারা এক ধরনের বিপাকেই পড়েছেন এবার। 

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, 'এগুলো হলো উন্নয়নের যন্ত্রণা। শিশুদের শিক্ষার স্বার্থে, জাতির বৃহত্তর স্বার্থে এটুকু কষ্ট সবাইকে তো স্বীকার করে নিতেই হবে।'

রাজধানীর কয়েকজন প্রেস মালিক জানান, বই ছেপে ছাড়পত্র নেওয়ার পরও তাদের তা পাঠাতে বিলম্ব হচ্ছে। কারণ, দিনের বেলায় রাজধানীতে ট্রাক চলে না। বিষয়টি এনসিটিবিকে জানিয়েছেন তারা। এনসিটিবির দায়িত্বশীল দু'জন কর্মকর্তা এ বিষয়ে বলেন, এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী একটি আধা-সরকারি পত্র লিখেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে। সেখানে দিনে ও রাতে উভয় সময়েই পাঠ্যবইবাহী ট্রাক চলাচল করতে দেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে। পাঠ্যবই পরিবহনের সঙ্গে সম্পৃক্ত বেশ কয়েকজন ট্রাকচালক জানান, দেশের উত্তরাঞ্চলে ঘন কুয়াশার কারণেও বই পৌঁছতে বিলম্ব হচ্ছে। আর মাওয়া ঘাটে পদ্মা নদীতে একটি মাত্র চ্যানেল চালু থাকায় দেরি হচ্ছে ফেরি পারাপারে। ট্রাক নিয়ে ঘাটে দু-তিন দিন অপেক্ষা করতে হচ্ছে কখনও কখনও। 

জানা গেছে, ৩৫ কোটি ২১ লাখ বই ছেপে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে পৌঁছে দিতে কাজ করছে ১৬ হাজার ৪০০টি ট্রাক। দেশজুড়ে পাঠ্যবই মুদ্রণ ও পরিবহন কাজের তদারকি করতে কাজ করছেন জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) ২২টি টিমের ৬৬ কর্মকর্তা। এর বাইরেও এনসিটিবির চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় মনিটরিং টিম, এনসিটিবির কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং টিম মিলিয়ে আরও ২১২ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী শ্রম দিচ্ছেন এই মহাযজ্ঞে। 

আর মাত্র মাসখানেক পরই ফুরোবে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের প্রতীক্ষার পালা। ২০১৯ খ্রিস্টাব্দের ১ জানুয়ারি নতুন শিক্ষাবর্ষের প্রথম দিনে বিদ্যালয়ে গিয়ে তারা হাতে পাবে ঝকঝকে নতুন পাঠ্যবই। তার সোঁদা গন্ধে মাতোয়ারা হবে তারা। উল্লাস করে ফিরবে বাড়িতে। 

মানসম্মত বই ছাপতে এবার কঠোর অবস্থানে এনসিটিবি। সংস্থার চেয়ারম্যান, সদস্য ও অন্য কর্মকর্তারা নিয়মিত সারাদেশের ছাপাখানা পরিদর্শন করছেন। কোথাও কোনো বিচ্যুতির খবর পেলে ত্রুটি সারাতে ছুটে যাচ্ছেন সেখানে। এনসিটিবি চেয়ারম্যান বলেন, 'এবার বইয়ের মান আরও ভালো হচ্ছে। উপজেলা পর্যায়ে এরই মধ্যে সরবরাহ হচ্ছে। মান রক্ষায় কোনো ছাড় নয়।'

এনসিটিবির অন্য এক কর্মকর্তা বলেন, 'এটা নির্বাচনের বছর। শিক্ষার্থীদের ভালোমানের বই উপহার দেওয়া হবে। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ নিজেও নিয়মিত পাঠ্যবই ছাপার কার্যক্রমের খোঁজখবর রাখছেন।'

এনসিটিবি জানায়, ২০১৯ শিক্ষাবর্ষে মোট ৩৫ কোটি ২১ লাখ ৯৭ হাজার ৮৮২ কপি পাঠ্যবই বিতরণ করা হবে। এর মধ্যে প্রাথমিক স্তরের বই ১১ কোটি ছয় লাখ এক হাজার ৫২১ কপি। এসব বই ছাপাতে দেশি-বিদেশি প্রায় ৪০০ ছাপাখানার সঙ্গে চুক্তি করে কার্যাদেশ দিয়েছে এনসিটিবি। এর মধ্যে মাধ্যমিক (বাংলা ও ইংরেজি ভার্সন) এবং এসএসসি ভোকেশনাল স্তরের পাঠ্যবই মুদ্রণ, বাঁধাই ও সরবরাহ করতে কাগজ ছাড়া ৩৪০টি লটে কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে।

আর মাধ্যমিক বাংলা ও ইংরেজি ভার্সন, ইবতেদায়ি, দাখিল, এসএসসি ও দাখিল ভোকেশনাল এবং কারিগরি (ট্রেড বই) স্তরের বিনামূল্যের পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ, বাঁধাই ও সরবরাহের জন্য কাগজসহ ৩২০টি লটে কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। ছাপাখানাগুলোতে পুরোদমে চলছে বইয়ের কাজ।

এনসিটিবির বিতরণ নিয়ন্ত্রক প্রফেসর জিয়াউল হক জানান, ৩৫ কোটি ২২ লাখ কপি বই ছাপাতে এবার প্রায় ৮৫ হাজার টন কাগজ ব্যবহূত হচ্ছে। এর মধ্যে এনসিটিবি কিনে দিয়েছে প্রায় ১৫ হাজার টন। বাকি কাগজ মুদ্রণকারীরা বাজার থেকে কিনে বই ছাপিয়ে সরবরাহ করবে।

এনসিটিবির সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, গেল সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মাধ্যমিক ও প্রাক-প্রাথমিক স্তরের দুই কোটি ৭৬ লাখ ৭১ হাজার ৩৪ কপি বই উপজেলা পর্যায়ে সরবরাহ করেছে ছাপাখানাগুলো। এনসিটিবির নিয়োগ করা দুটি প্রতিষ্ঠানের বিশেষজ্ঞ কর্মকর্তারা বইয়ের মান যাচাই করে রিপোর্ট দেওয়ার পরই বই সরবরাহে ছাড়পত্র দেওয়া হচ্ছে। মানহীন বই সরবরাহের কোনো সুযোগ নেই। প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যবইয়ের মান যাচাই করছে এবার 'কন্টিনেন্টাল' নামের একটি প্রতিষ্ঠান। আর মাধ্যমিক স্তরের বইয়ের মান যাচাই করছে 'ব্যুরো ভেরি টাচ' নামের একটি প্রতিষ্ঠান। এনসিটিবির উপসচিব সৈয়দ মোস্তাফিজুর রহমান লিখন বলেন, 'মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে দুটি রয়েছে ভারতে- কৃষ্ণা ট্রেডার্স ও স্বপ্না প্রিন্টার্স। বাকিগুলোর সবই দেশের। রাজধানী ঢাকা ছাড়াও এবার পাঠ্যবই ছাপানো মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলো বগুড়া, রংপুর, টাঙ্গাইল, চট্টগ্রাম, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর ও নরসিংদীতে অবস্থিত।

২০১৯ শিক্ষাবর্ষের মোট পাঠ্যপুস্তকের মধ্যে প্রাক-প্রাথমিক স্তরের বই ৬৮ লাখ ৫৬ হাজার ২০ কপি। আর প্রাথমিক স্তরের ৯ কোটি ৮৮ লাখ ৮২ হাজার ৮৯৯ কপি, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ভাষার বই দুই লাখ ৭৬ হাজার ৭৮৪ কপি, ইবতেদায়ির দুই কোটি ২৫ লাখ ৩১ হাজার ২৮৩ কপি এবং দাখিলের তিন কোটি ৭৯ লাখ ৫৮ হাজার ৫৩৪ কপি ছাপা হচ্ছে।

মাধ্যমিক (বাংলা ভার্সন) স্তরের ১৮ কোটি ৫৩ হাজার ১২২ কপি এবং একই স্তরের ইংরেজি ভার্সনের ১২ লাখ ৪৭ হাজার ৮২৬ কপি বই ছাপা হচ্ছে।

এ ছাড়া কারিগরি শিক্ষা স্তরের ১২ লাখ ৩৫ হাজার ৯৪৮ কপি ছাপা হচ্ছে, আর এসএসসি ভোকেশনাল স্তরের এক লাখ ৪৩ হাজার ৮৭৫ কপি, ব্রেইল পাঠ্যপুস্তক ৫ হাজার ৮৫৭ কপি এবং সম্পূরক কৃষি (ষষ্ঠ-নবম) স্তরের এক লাখ ২৪ হাজার ২৬১ কপি।

 

সূত্র: সমকাল


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0027508735656738