স্কুলের স্লিপ ফান্ডের টাকা নানা কৌশলে আত্মসাতের অভিযোগ

রানীনগর (নওগাঁ) প্রতিনিধি |

প্রতিবছর প্রায় একই উপকরণ দেখিয়ে অথবা নিজেদের তৈরি একটু ভিন্ন ধরনের ক্রয় ভাউচার দেখিয়ে নওগাঁর রানীনগর উপজেলায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চলছে স্লিপ ফান্ডের লাখ লাখ টাকা আত্মসাতের মহোৎসব। চলতি অর্থবছরসহ গত দুই-তিন বছরের পিইডিপি-৩ এর আওতার স্লিপ ফান্ডের বরাদ্দকৃত অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ ওঠেছে বিভিন্ন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও ম্যানেজিং কমিটির সভাপতিদের বিরুদ্ধে।

এ ছাড়াও প্রতিটি বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দাবি, তারা প্রতি বছরই বিদ্যালয়ের চাহিদা মতো বিভিন্ন উপকরণ ক্রয় করেন তারা এবং আগের উপকরণ নষ্ট হলে পরিত্যক্ত করা হয়। কিন্তু বাস্তবে উপজেলার অধিকাংশ স্কুলেই পাওয়া যায়নি পরিত্যক্ত উপকরণগুলো! এ নিয়ে উপজেলার বেশ কয়েকটি বিদ্যালয়ে দিধা-দ্বন্দ্ব ও দফায় দফায় চলছে শিক্ষক বনাম ম্যানেজিং কমিটির মধ্যে সমঝোতা বৈঠক! রানীনগর সদরের সিম্বা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এমনি একটি বৈঠক চলাকালীন সময়ে জানা যায় ‘কাজির গরু কিতাবে আছে, গোয়ালে নেই’।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ৩য় প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচির (পিইডিপি-৩) আওতায় চলতি বছর রানীনগর উপজেলার ১০০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মোট ৫৪ লাখ ১৫ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এর আগে ২০১৭-১৮ইং অর্থবছরেও একই কর্মসূচির আওতায় শিক্ষা উপকরণ ও বিদ্যালয়ের অতি প্রয়োজনীয় টুকিটাকি উপকরণ কেনার জন্য সরকার পর্যায় থেকে প্রতিটি বিদ্যালয়ে ৪০ হাজার টাকা করে বরাদ্দ দেয়া হয়। এসব টাকায় স্ব-স্ব বিদ্যালয়গুলোতে উপকরণ হিসেবে আয়না, পানির ফিল্টার, ফুটবল, ঘড়ি, বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান, কাবদলের ছাত্র-ছাত্রীর ড্রেস, ডায়েরি, খাতা, ঘর সজ্জিত, ঘর অঙ্কন, দরজা, জানালাসহ বিভিন্ন উপকরণ ক্রয়ের কথা থাকলেও এসব ক্রয় না করে প্রতিবছরই শিক্ষক ও সভাপতিদের যোগসাজসে নিজেদের তৈরি করা ভুয়া ভাউচারের মাধ্যমে বরাদ্দকৃত টাকা আত্মসাৎ করা হচ্ছে। তবে এই কর্মসূচির শুরুর দিকে অর্থাৎ ২০১৫-১৬ইং অর্থবছরে বরাদ্দের টাকা দিয়ে বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষ সজ্জিতকরণ, প্রয়োজনীয় উপকরণ ক্রয়, প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণির জন্য মাদুর, সাউন্ডবক্স, সিটিজেন চার্টার, ইতিহাস সংবলিত বই ক্রয় করার কথা থাকলেও তা পরিপূর্ণভাবে না করে নয়ছয় করা হয়। চলতি বছরেও বরাদ্দের টাকা দিয়ে কাঙ্ক্ষিত সেই কাজগুলো না করে অধিকাংশ বিদ্যালয়েই ভুয়া ভাউচার করে অর্থ আত্মসাৎ চলছে। এ যেন ‘কাজির গরু কিতাবে আছে, গোয়ালে নেই’ এমন অবস্থা। প্রতি বছর প্রায় একই উপকরণ ক্রয় দেখিয়ে বা একটু অদল-বদল করে বিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ স্লিপ ফান্ডের টাকা আত্মসাৎ করায় ভেস্তে যেতে বসেছে শিক্ষার মান উন্নয়ন ও কাঙ্ক্ষিত উদ্দেশ্য।

উপজেলার বিভিন্ন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ঘুরে দেখা যায়, গতবছর কিছু উপকরণ ক্রয় করা হলেও বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের চাহিদা মতো কাঙ্ক্ষিত কাজ করা হয়নি। এ ছাড়াও পুরাতন কাজগুলোকে নতুন কাজ বলে ভুয়া ভাউচার তৈরি করে বিল উত্তোলন করা হচ্ছে। শিক্ষকদের বক্তব্য অনুযায়ী তারা প্রতিবছরই স্কুলের চাহিদামতো উপকরণ ক্রয় করে কিন্তু অধিকাংশ স্কুলেই পাওয়া যায়নি পরিত্যক্ত হওয়া সেই উপকরণগুলো!

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা জানান, এই বরাদ্দের টাকা থেকে সহকারী শিক্ষা অফিসারদের কিছু দিতে হয়। এ ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে নানা অজুহাতে সাধারণ শিক্ষকদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করে থাকেন তারা, যা দাপ্তরিকভাবে সুষ্ঠু তদন্ত হলে থলের বিড়াল বেরিয়ে আসবে।

এ ব্যাপারে সিম্বা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির পক্ষ থেকে জানানো হয় যে, প্রতি বছর স্লিপের টাকা প্রধান শিক্ষিকা মনোয়ারা বেগম ও সভাপতি উত্তোলন করে তিন ভাগের এক ভাগ খরচ করে আর বাকি টাকা আত্মসাৎ করে। প্রয়োজনীয় উপকরণ ক্রয় সংক্রান্ত কোনো প্রকার মিটিং ছাড়াই ও কমিটির সদস্যদেরকে না জানিয়ে জাল স্বাক্ষর করে রেজুলেশন জমা দিয়ে টাকা তুলে আত্মসাৎ করছে।

সিম্বা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালেয়র প্রধান শিক্ষিকা মনোয়ারা বেগম বলেন, আত্মসাতের বিষয়টি ভিত্তিহীন। প্রতি বছরের বরাদ্দ বিদ্যালয়ের কাজেই ব্যয় করা হয়। তবে যেসব উপকরণ প্রয়োজন হয় তা প্রায় একই রকম হওয়ার কারণে অনেকেই এ ব্যাপারে সন্দেহ করে।

সিম্বা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালেয়র ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি রাজা প্রাং ভরা বৈঠকের মধ্যে বলেন, গতবছর স্লিপের টাকা উত্তোলনের বিষয়টি আমার জানা নেই। পরে জানতে পারি, আমার স্বাক্ষর প্রধান শিক্ষিকা জাল করে টাকা উত্তোলন করেছেন!

কসবা-বড়বড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তোতা মিঞা বলেন, সব অর্থবছরের বিল-ভাউচার জমা দেয়া হয়েছে। আর গতবছরের টাকা দিয়ে ফুটবলসহ বিভিন্ন উপকরণ ক্রয় করা হয়েছে। এ বছরও ফুটবল কেনা হয়েছে! ফুটবল কিনেই সব টাকা শেষ? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, প্রয়োজনীয় উপকরণ ক্রয় শেষে কিছু টাকা অবশিষ্ট থাকে তা স্কুলের আনুসাঙ্গিক কাজে ব্যবহার করা হয়।

কৃষ্ণপুর-মালঞ্চি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান মাহমুদুল হকের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, কত টাকা বরাদ্দ পেয়েছি তা সবাই জানে! আর মোবাইলে এই সব প্রশ্ন করার কতটুকু সঠিকতা আছে আপনার? মোবাইলে এই সব বলা যাবে না! প্রতি মাসে উপজেলা সদরে আমাদের মিটিং হয় সেখানে আমরা সবাই ওখানে থাকি সেইদিন আসেন সাক্ষাতে কথা হবে।

রানীনগর সরকারি প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও লোহাচূড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এমদাদুল হক বলেন, আমার স্কুলে আগের ক্রয়কৃত জিনিসপত্র সংস্কার করতেই এ বছরের টাকা শেষ। এ বছর উপজেলার প্রতিটি স্কুলে ভাল কাজ হচ্ছে। কোনো প্রকার অনিয়ম হচ্ছে না।

এ ব্যাপারে রানীনগর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার (চলতি দায়িত্ব) মো. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, এ বছর উপজেলার ১০০টি বিদ্যালয়ে মোট ৫৪ লাখ ১৫ হাজার টাকা বরাদ্দ এসেছে। ‘অত ব্যাখ্যা দিতে পারবো না! শিক্ষক ও সভাপতিরা কি কি কাজ করছেন বা করেছে তা আমার জানা নেই! জানার দরকারও নেই! কেউ যদি স্লিপের টাকা আত্মসাৎ করেও থাকে সেক্ষেত্রে আমাদের করণীয় কিছুই নেই!’


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
প্রাথমিকে ১০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ জুনের মধ্যে: প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha প্রাথমিকে ১০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ জুনের মধ্যে: প্রতিমন্ত্রী পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা দাবি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের - dainik shiksha পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা দাবি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের ঝরে পড়াদের ক্লাসে ফেরাতে কাজ করছে সরকার - dainik shiksha ঝরে পড়াদের ক্লাসে ফেরাতে কাজ করছে সরকার প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি, ভাইবোন গ্রেফতার - dainik shiksha প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি, ভাইবোন গ্রেফতার ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি - dainik shiksha ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন প্রায় শূন্যের কোটায় - dainik shiksha শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন প্রায় শূন্যের কোটায় ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে - dainik shiksha ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0027120113372803