সড়কের হত্যাকাণ্ড আর কত দিন?

মিল্টন বিশ্বাস |

গত ১৯ মার্চ মঙ্গলবার রাজধানীর প্রগতি সরণিতে বেপরোয়া বাস পিষে মেরেছে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালের মেধাবী ছাত্র আবরার আহমেদ চৌধুরীকে। মর্মস্পর্শী এ ঘটনা ঘটেছে সকালে জেব্রা ক্রসিং দিয়ে রাস্তা পারাপারের সময়। সড়কের ওই হত্যাকাণ্ডের পর যমুনা ফিউচার পার্কের সামনের রাস্তা আবরারের সহপাঠীরা অবরোধ করে রাখে। পরে মেয়র আতিকুল ইসলামের আশ্বাস ও পুলিশ প্রশাসনের অনুরোধে তারা অবরোধ তুলে নেয়। কিন্তু দ্বিতীয় দিন আবার ঢাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে চলতে থাকে প্রতিবাদ ও দাবিনামা উপস্থাপন। ২০১৮ সালে একই ধরনের ঘটনা ঘটেছিল। যার প্রভাব ছিল বেশ কয়েক দিন। সে সময় নিরাপদ সড়ক আন্দোলন বাংলাদেশে কার্যকর সড়ক নিরাপত্তার দাবিতে ২৯ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত সংঘটিত হয় একটি আন্দোলন। ঢাকায় ২৯ জুলাই এক সড়ক দুর্ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নিহত দুই কলেজ শিক্ষার্থীর সহপাঠীদের মাধ্যমে শুরু হওয়া ওই বিক্ষোভ পরবর্তী সময় সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং নৌমন্ত্রীর পদত্যাগসহ ৯ দফা দাবিতে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে এসেছিল। কিন্তু সেই বিক্ষোভ-আন্দোলনের পরও রাজধানীর পরিবহন সেক্টরের নৈরাজ্য দূর হয়নি। বরং আগের মতোই নিয়ম ভঙ্গের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত বাসের চালকরা।

১৯ মার্চ ১২ দফা দাবি দিয়েছে শিক্ষার্থীরা। তাদের দাবিগুলো যৌক্তিক। সেগুলো হলো—পরিবহন সেক্টরকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে হবে এবং প্রতি মাসে বাসচালকের লাইসেন্সসহ সব প্রয়োজনীয় কাগজপত্র চেক করতে হবে। দুর্ঘটনার পর আটক চালক ও সম্পৃক্ত সবাইকে দ্রুত সময়ের মধ্যে সর্বোচ্চ শাস্তির আওতায় আনতে হবে। ফিটনেসবিহীন বাস ও লাইসেন্সবিহীন চালককে দ্রুত সময়ে অপসারণ করতে হবে। ঝুঁকিপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় সব স্থানে আন্ডারপাস, স্পিডব্রেকার এবং ফুট ওভারব্রিজ নির্মাণ করতে হবে। চলমান আইনের পরিবর্তন করে সড়ক হত্যার সঙ্গে জড়িত সবাইকে সর্বোচ্চ শাস্তির আওতায় আনতে হবে। দায়িত্ব অবহেলাকারী প্রশাসন ও ট্রাফিক পুলিশকে স্থায়ী অপসারণ করে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। প্রতিযোগিতামূলক গাড়ি চলাচল বন্ধ করে নির্দিষ্ট স্থানে বাস স্টপেজ এবং যাত্রী ছাউনি করার জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং ছাত্রদের হাফ পাস (অর্ধেক ভাড়া) অথবা আলাদা বাস সার্ভিস চালু করতে হবে। এসব দাবি উত্থাপনের পর আগামী তিন মাসের মধ্যে বসুন্ধরা আবাসিক বা যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে নিহত আবরারের নামে ফুট ওভারব্রিজ তৈরি করার আশ্বাস দেন ঢাকা উত্তরের মেয়র। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এতগুলো বছর চুপ করে বসে থাকার কারণ কী? এ এলাকার একটি সুপারমার্কেটে প্রতিদিন হাজার হাজার লোক যাওয়া-আসা করে। সম্প্রতি সেখানে ভারতের ভিসা অফিস চালু হয়েছে। প্রতিদিন কয়েক হাজার মানুষ ভিসার জন্য যাচ্ছে। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার বাসিন্দাদেরও চলাচলের প্রধান পথ এই সড়কটি। অথচ গত ১০ বছরে রাস্তা পারাপারের জন্য ফুট ওভার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তৈরি করল না কেন? এর জবাব কে দেবে?

শুধু ঢাকা শহরের কয়েকজন শিক্ষার্থীর মৃত্যু নয়, চালকের বেপরোয়া বাস চালনায় হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। অথচ হত্যার দায়ে দোষীকে শাস্তি দিলে পরিবহন ধর্মঘট ডাকা হয়। যেমন—২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিন থেকে হঠাৎ ধর্মঘটের ডাক দেওয়ার কারণে চরম ভোগান্তিতে পড়ে সারা দেশের মানুষ। আর ভোগান্তির মধ্যেই পরিবহন শ্রমিকরা তাঁদের ধর্মঘট চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। উল্লেখ্য, মানিকগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় পরিচালক তারেক মাসুদ ও চিত্রগ্রাহক মিশুক মুনীর নিহতের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় জামির হোসেন নামের এক পরিবহন শ্রমিককে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আদালত। ওই রায়ের পর খুলনা বিভাগের ১০ জেলায় দুদিন পরিবহন ধর্মঘট চলে। পরে প্রশাসনের আশ্বাসে কর্মসূচি প্রত্যাহারের ঘোষণা দেওয়া হলেও পরে শ্রমিক নেতারা কর্মসূচি বহাল রাখার কথা বলে। এরই মধ্যে ঢাকার সাভারে ট্রাকচাপায় এক নারী হত্যার দায়ে ২০১৭ সালেরই ২৭ ফেব্রুয়ারি ট্রাকচালক মীর হোসেনের ফাঁসির রায় হয়। ফলে ওই রাতে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন সারা দেশে অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতির কর্মসূচি ঘোষণা দেয়।

এ দেশের শ্রমিকরা যাত্রীসেবা না দিয়ে হয়রানি করে কুৎসিত আনন্দ উপভোগ করে থাকে। রাজধানীর বাস ড্রাইভারদের বেপরোয়া আচরণ আর যাত্রীদের দুর্ভোগের কথা বলে শেষ করা যায় না। অব্যবস্থাপনার কারণে আমরা নিত্যদিনের দুর্ভোগের শিকারে পরিণত হয়েছি। যোগাযোগমন্ত্রী ও প্রশাসনের নানা তৎপরতা, আর নানা ব্যবস্থা গ্রহণের পরও দুর্ভোগ কমেনি। বরং দুর্ঘটনায় প্রাণহানির ঘটনা ক্রমাগত বাড়ছে।  দুর্ঘটনার জন্য দায়ী যারা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় কি? হয়তো কিছু কিছু ক্ষেত্রে সড়ক-হত্যায় অভিযুক্তকে জেলহাজতে পাঠানো হয়। আবারও ঘটে নতুন ধরনের দুর্ঘটনা। ড্রাইভার দীর্ঘ পথ ট্রাক চালনার পর ঘুমিয়ে পড়ে রাস্তার পাশের চায়ের দোকানে আতঙ্কিত যানটি ঢুকিয়ে মানুষকে চাপা দিয়ে মারে। মহাসড়ক দিয়ে দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছানোর তাড়নায় ওভারটেক করতে গিয়ে সামনের গাড়ির সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়ে মৃত্যু ঘটে অনেকের। শুধু মৃত্যু নয়, পঙ্গু হয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রের যে ব্যাপক ক্ষতি করা হয় তা থেকে রক্ষা পাওয়ার কথা বারবার ভাবা হলেও কোনো উদ্যোগই কার্যকর হচ্ছে না।

বুয়েটের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ সেন্টারের (এআরসি) গবেষণা অনুযায়ী আমাদের দেশে প্রতিবছর গড়ে ১২ হাজার মানুষের মৃত্যু এবং আহত হয় ৩৫ হাজার। অন্যদিকে বিশ্বব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশে প্রতি ১০ হাজার যানবাহনে মৃত্যুর হার ৮৫ দশমিক ৬ শতাংশ। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু ছাড়াও আহত ও স্থায়ীভাবে পঙ্গুত্ববরণের হারও কম নয়। এ সমস্যা একটি সোশ্যাল বা সামাজিক ট্র্যাজেডিতে পরিণত হয়েছে। মানুষকে প্রয়োজনে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যেতেই হয়, যানবাহনে চড়তেই হয়। কিন্তু প্রতিনিয়ত যদি লাশ হয়ে যাওয়ার ভয়ে শঙ্কিত থাকতে হয়, তাহলে এটি কোনো স্বাভাবিক পরিস্থিতি হতে পারে না। সড়ক দুর্ঘটনা এখন শুধু সামাজিক ট্র্যাজেডি নয়, এর পেছনে রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় রয়েছে। উপরন্তু বিচারহীন, প্রতিকারহীন ঘটনা ঘটতে থাকলে মানুষ নিজের হাতে আইন তুলে নেবে এটাই স্বাভাবিক। এ জন্য দুর্ঘটনার পর ড্রাইভার পালিয়ে যায়। কিংবা অনেক ড্রাইভারের নিজের প্রাণও বিনষ্ট হয়। এ ছাড়া সড়ক দুর্ঘটনাসংক্রান্ত আইনটি দুর্বল হওয়ায় অভিযুক্তরা সহজে পার পেয়ে যাচ্ছে।

জনগণ নিরাপদ সড়কের নিশ্চয়তা চায়, নিরাপদে ভ্রমণ করতে চায়। দুর্ঘটনাকে প্রতিরোধে জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে প্রচার-প্রচারণা ছাড়া মুক্তি সহজে আসবে বলে মনে হয় না। সড়কের উন্নয়ন, চালকের প্রশিক্ষণ ও পথচারীদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি—এ তিনটি কাজকে প্রাধান্য দিলে দুর্ঘটনা রোধ করা সম্ভব। এটা করার মূল দায়িত্ব নিতে হবে সরকারকে। তবে এগিয়ে আসতে হবে জনগণকেও। সচেতন হতে হবে যানবাহনের চালক, মালিক ও পথচারীদেরও। সড়ক দুর্ঘটনার ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ দুর্ঘটনাস্থলেই মারা যায়। আমরা সেই চিন্তার আগে দুর্ঘটনার মূলোৎপাটন করতে চাই। জাতিসংঘ ২০১১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ‘সড়ক নিরাপত্তা দশক’ ঘোষণা করেছে। প্রতিটি সদস্য দেশকে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করার কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশে পরিকল্পনা তৈরি ও বাস্তবায়নের কার্যক্রম হাতে নিয়ে শিক্ষার্থীসহ সব মানুষের চলাচলকে নির্বিঘ্ন করবে বলে আমরা মনে করি।

লেখক : অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

 

সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.006760835647583