হিজড়া : অনাদৃত জনসম্প্রদায়

ড. রতন সিদ্দিকী |

হিজড়া। শব্দটি শুনেই এক ধরণের নেতিবাচক ভাবনায় তাড়িত হয় মানুষ। চোখের সামনে ভেসে ওঠে এক দল পুরুষদেহ সদৃশ নারীর রূপধারী, যাদের আচার-আচরণ অস্বাভাবিক। তাদের পোশাক নারীর মতো। তারা দলবদ্ধ হয়ে বসবাস করে। তাদের ভাষা অশিষ্ট। আচরণ ও অঙ্গ-ভঙ্গি অশ্লীল। তারা নবজাতককে স্নেহ-আশীর্বাদ করার নামে উৎপাত করে। পথচারীদেরকে বিরক্ত ও বিব্রত করে।

এই হিজড়াদের নিয়ে আমাদের সমাজে প্রচলিত আছে বিচিত্র কল্পকথা, গল্প-কাহিনি। তাদের দেহাকৃতি, মনস্তত্ত্ব, সংস্কৃতি, যৌনাঙ্গ, যৌনজীবন ইত্যাদি নিয়ে আছে বিভ্রান্তিকর প্রচারণা। সমাজের শিক্ষিত-অশিক্ষিত অধিকাংশ মানুষের কাছে হিজড়ারা মন্দ ও অনাদৃত থাকার কারণে এবং নাগরিক অধিকার বঞ্চিত বলে তারা জনসম্প্রদায় হিসেবে সবচেয়ে প্রান্তিক এবং চরম বৈষম্যের শিকার।

কারো কারো মতে হিজড়া শব্দটি উর্দু শব্দ। সেমেটিক আরবি ধাতুমূল হিজর থেকে (যার অর্থ হলো গোত্র থেকে পরিত্যক্ত) শব্দটির জন্ম হয়েছে। পরবর্তীকালে তা হিন্দি ভাষায় প্রবেশ করেছে। হিন্দিভাষীরা ইংরেজি Enouch (খোজা), Hermaphrodite (উভলিঙ্গ) শব্দের অর্থ হিসেবে হিজড়া শব্দটি ব্যবহার করে। আবার কারো কারো মতে ফারসি শব্দ হিচ্কা (যার অর্থ ঘর থেকে টেনে বের করা) থেকে হিজড়া শব্দের উৎপত্তি। বস্তুত হিজর বা হিচ্কা যাই হোক না কেন, হিজড়া শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হলো পরিত্যাক্ত বা গৃহচ্যুত। অর্থাৎ পরিবারের একজন সদস্য যিনি স্বভাব বা আচরণগত সমস্যা বা অস্বাভাবিক কারণে গৃহচ্যুত বা পরিত্যক্ত হন।

লক্ষ্যণীয়, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী, বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বা অন্য কোন ধরণের প্রতিবন্ধী প্রতিবন্ধিতার কারণে সাধারণত গৃহচ্যুত বা পরিবারের সদস্যদের স্নেহবঞ্চিত হন না। অথচ যারা যৌনপ্রতিবন্ধী বা হিজড়া তারা পরিবারের বা সমাজের মমতাহীন নিষ্ঠুরতায় ক্ষত-বিক্ষত হয়ে পরিত্যক্ত বা গৃহচ্যুত হয়। এদের প্রতি পরিবার ও সমাজের যে স্নেহহীন দৃষ্টি, উপেক্ষা এবং অবিরাম লাঞ্ছনা, তা অযৌক্তিক ও মানবতাবিরোধী। এ অবিচার নিমর্মতাপ্রসূত।

প্রকৃত অর্থে এই যৌন প্রতিবন্ধী বা হিজড়ারা শারীরিকভাবে পুরুষ। পুরুষাঙ্গসহ পুরুষের সকল বৈশিষ্ট্যই এদের দেহে বিরাজমান। তবে এদের মনোজগত সম্পূর্ণরূপে নারী বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। এরা নিজেদেরকে নারী ভাবতে এবং নারীর মতো আচার-আচরণ করতে গর্ব ও আনন্দ অনুভব করে। নারীর পোশাক পরতে সাচ্ছন্দ্যবোধ করে। আসলে তারা পুরুষ দেহবিশিষ্ট মানসিক নারী। এরা কখনো প্রতারকদের দ্বারা বিভ্রান্ত হয়ে প্রতারণার শিকার হয়। প্রতারিত হিজড়ারা শৈ্ল্যচিকিৎসার মাধ্যমে নিজের পুরুষ যৌনাঙ্গ কর্তন করিয়ে নারী যৌনাঙ্গ সৃষ্টির ব্যর্থ চেষ্টা করে। এরা মাতৃত্ববোধ থেকে নবজাতকদের নিয়ে আনন্দ উচ্ছ্বাস করে। এক হিজড়া আরেক হিজড়াকে নারীভাবনা থেকে বান্ধবী, বোন, দিদি, মাসি ইত্যাদি নামে ডাকে। 
 
পুরুষ যৌনাঙ্গের হিজড়ারাও কখনোই অন্য কোনো হিজড়ার সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন বা হিজড়ার প্রতি যৌনাকর্ষণ অনুভব করে না। তারা সক্ষম সুদর্শন পুরুষের প্রতি যৌনাকর্ষণ অনুভব করে। তাদের সান্নিধ্য ও স্পর্শ গভীর অনুরাগে উপভোগ করে। কোনো কোনো হিজড়া আবার পুরুষের নিষ্ক্রিয় যৌন সঙ্গী হয়। এই বৈচিত্র্যময় মনস্তত্ত্বের ও বিচিত্র সংস্কৃতির হিজড়ারাই বাংলাদেশের অন্যতম অনাদৃত জনসম্প্রদায়। এরা সমাজে থেকেও সমাজবিচ্ছিন্ন, রাষ্ট্রে থেকেও রাষ্ট্রচ্যুত। এরা লাঞ্ছিত ও নিপীড়িত, পরিবার ও সমাজে নিগৃহীত। এরা অন্যায় অপমানে বিবর্ণ ও বিধ্বস্ত। পরিবার ও সমাজে অবহেলিত এই অনাদৃত জনসম্প্রদায়ের প্রতি আমাদের রয়েছে মানবিক কর্তব্য। এই কর্তব্য ব্যক্তি পর্যায় থেকে রাষ্ট্র পর্যায় পর্যন্ত বিস্তৃত। অথচ সে কর্তব্য পালনে রাষ্ট্র আইনি দায়িত্বটুকু কেবল পালন করেছে। বাকি পুরোটাই শূন্য। এই শূন্যতা পূরণে প্রয়োজন সামাজিক মানুষের মানস পরিবর্তন এবং রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রায়োগিক কর্তৃত্ব।

উল্লেখ্য, ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে সরকারি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে হিজড়াদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে এবং তারপর তাদের জন্য যে সকল সরকারি কর্মসূচি নেয়া হয়েছে। তার মধ্যে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে জীবনমান উন্নয়নে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৬৪ জেলায় বরাদ্দ করা অর্থের পরিমাণ ১১ কোটি ৪০ লাখ টাকা। সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে এখন স্কুলগামী তৃতীয় লিঙ্গের শিক্ষার্থীদের শিক্ষিত করে গড়ে তোলার লক্ষ্যে চার স্তরে (প্রাথমিকে জনপ্রতি মাসিক ৭০০, মাধ্যমিকে ৮০০, উচ্চ মাধ্যমিকে ১০০০ ও উচ্চতর ১২০০ টাকা হারে) উপবৃত্তি দেয়া হচ্ছে। তৃতীয় লিঙ্গের লোকজনের যাদের বয়স ৫০ বা এর বেশি, এমন অক্ষম ও অসচ্ছল ব্যক্তিদের মাসিক ৬০০ টাকা করে বিশেষ ভাতা দেয়া হচ্ছে। বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মক্ষম তৃতীয় লিঙ্গের লোকজনের দক্ষতা বৃদ্ধি ও আয়বর্ধনমূলক কাজে সম্পৃক্ত করে তাঁদের সমাজের মূল স্রোতোধারায় আনার কাজ চলছে। এছাড়া তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকে প্রশিক্ষণ পরবর্তী সময়ে ১০ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা দেয়া হচ্ছে। 

২০১২-১৩ অর্থবছর হতে পাইলট কর্মসূচি হিসেবে দেশের ৭টি জেলায় সরকারি কর্মসূচি শুরু হয়। ৭টি জেলা হচ্ছে ঢাকা, চট্টগ্রাম, দিনাজপুর, পটুয়াখালী, খুলনা, বগুড়া এবং সিলেট। ২০১২-১৩ অর্থ বছরে বরাদ্দ ছিল ৭২ লাখ ১৭ হাজার টাকা। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে নতুন ১৪টি জেলাসহ মোট ২১টি জেলায় এ কর্মসূচি বাস্তবায়িত হয়েছে এবং জেলাগুলো হচ্ছে ঢাকা, গাজীপুর, নেত্রকোনা, ফরিদপুর, রাজবাড়ি, চট্টগ্রাম, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, বগুড়া, জয়পুরহাট, নওগাঁ, সিরাজগঞ্জ, খুলনা, ঝিনাইদাহ, কুষ্টিয়া, দিনাজপুর, পিরোজপুর, পটুয়াখালী ও সিলেট। ২০১৩-২০১৪ অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ৪ কোটি ৭ লাখ ৩১ হাজার ৬০০ টাকা। ২০১৪-২০১৫ অর্থবছরে ৬৪ জেলায় বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমাণ ১১ কোটি ৪০ লাখ টাকা।

লক্ষ করা যায়, সরকার তার সীমিত সামর্থ্য নিয়ে সরকারি স্বীকৃতি ও আর্থিক সাহায্য প্রদান করছে। এ ধারা বিনা ব্যতিক্রমে অব্যাহত থাকবে বলে আশা করা যায়। তবে হিজড়া প্রসঙ্গে পরিবার ও সমাজ দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন তো রাষ্ট্র বা সরকার করে দিতে পারবে না। সে পরিবর্তনের জন্য পরিবার ও সমাজের প্রাগ্রসর মানুষের ঐকান্তিক ও নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টা থাকতে হবে।
বস্তুত পরিবারের সদস্যদের এবং সমাজের মানুষের এক ধরনের মানস সংস্কৃতি আছে। যাকে সাধারণ অর্থে পরিবার ও সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি, ভাবনা, ধারণা বা বিশ্বাসজাত আচার-আচরণ বলা যায়। আমাদের এই অনাদৃত জনসম্প্রদায় হিজড়া পরিবার ও সমাজের যে নেতিবাচক মানস সংস্কৃতি আছে, যার প্রেক্ষিতে হিজড়ারা পরিবার ও সমাজে অবহেলিত, নিন্দিত, ঘৃণিত, উপেক্ষিত এবং পরিত্যক্ত। এই ধারণাজাত বিভ্রান্তিমূলক মানস সংস্কৃতির পরিবরর্তনের জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন হিজড়া সর্ম্পকে সঠিক ও সুস্পষ্ট ধারণা। তাদের মনস্তত্ত্ব উপলব্ধি করে দৃষ্টিভঙ্গিতে তাদের বিচার করা। হিজড়ারা মানুষ এ প্রত্যয় নিয়ে তাদের পরিবারের প্রাপ্য মর্যাদা দিয়ে বসবাস করার সুযোগ প্রদান করা। সমাজে মানুষ হিসেবে সামাজিক প্রাপ্য সম্মান প্রদান করা।

পরিবার ও সমাজের মানুষদের মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিজাত প্রীতিময় অন্তরঙ্গ বন্ধনে তাদের বন্দি করা। হিজড়াদের স্কুল-কলেজে স্বাভাবিক শিক্ষালাভের অধিকার নিশ্চিত করা। এরকম নানাবিধ মানবিক দায়িত্ব পালন ও আচরণে তাদের আপন ও স্বজন করে নিলে তারা আর অনাদৃত জনসম্প্রদায় থাকবে না। তারা সম্মান নিয়ে পরিবার ও সমাজে মানুষ হিসেবে বসবাস করতে পারবে। সমাজের আর দশটা মানুষের মতো তারাও হয়ে উঠবে দেশের মূল্যবান জনসম্পদ। এখন তাই প্রয়োজন অনাদৃত জনসম্প্রদায় হিজড়াদের কল্যাণে সরকারের পাশাপাশি জনসাধারণের মহৎ ও মানবিক উদ্যোগ।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন - dainik shiksha ছুটি না বাড়ালে বাড়ি যেতে হতে পারে ঈদের দিন হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে - dainik shiksha জালিয়াতি করে পদোন্নতি শিক্ষা ক্যাডার গ্যাঁড়াকলে রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা - dainik shiksha রুয়েটের সাবেক উপাচার্য-রেজিস্ট্রারের বিরুদ্ধে মামলা উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সংখ্যালঘু কোটার তথ্য চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী - dainik shiksha হাইস্কুলে কমেছে দশ লাখের বেশি শিক্ষার্থী please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0047719478607178