সিরাজগঞ্জের নয়টি উপজেলার পাঁচটিরই অবস্থান যমুনার চরাঞ্চলে। এর মধ্যে চৌহালী মূল ভূখণ্ড থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন। এ দুর্গম চরের একটি ইউনিয়নের নাম ‘স্থল’। ১৬টি গ্রাম নিয়ে গঠিত ইউনিয়নে কোনো মাধ্যমিক বিদ্যালয় নেই। ফলে নিম্ন মাধ্যমিক পাস করার পর পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হলে শিক্ষার্থীদের কমপক্ষে ১০ কিলোমিটার দূরের কোনো বিদ্যালয়ে যেতে হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, স্থল ইউনিয়নের বসন্তপুরে একটি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে। সেখানে চার শতাধিক শিক্ষার্থীকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পাঠদান করা হয়। দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের শিক্ষাগ্রহণ এখানেই থেমে যায়। আর মোটামুটি সামর্থ্যবানদের সন্তানরা ১০ কিলোমিটার দূরে এনায়েতপুরে পড়তে যায়। এ শিক্ষার্থীদের প্রতিদিন ধু-ধু বালুচর ও নদীপথ পাড়ি দিয়ে যেতে হয়। এতে খরচ হয় প্রায় ৬০ টাকা।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চৌহালী উপজেলার স্থল ইউনিয়নে ১৮৬৪ সালে পাকড়াশী জমিদারের উদ্যোগে স্থল পাকড়াশী ইনস্টিটিউশন নামে একটি বিদ্যাপীঠ স্থাপিত হয়। নদীভাঙনের কারণে প্রায় ৫৫ বছর আগে প্রতিষ্ঠানটি পার্শ্ববর্তী শাহজাদপুর উপজেলার রূপসীতে স্থানান্তর করা হয়। এরপর ১৯৬৫ সালে স্থানীয় বিদ্যানুরাগী আব্দুল কুদ্দুসের উদ্যোগে ও এলাকাবাসীর আর্থিক সহযোগিতায় বসন্তপুর চরে একটি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। সেটিও দফায় দফায় ভাঙনের কবলে পড়ায় সর্বশেষ ছোট চৌহালীতে স্থানান্তর করা হয়েছে। ফলে বর্তমানে স্থল ইউনিয়নের মালিপাড়া, নওহাটা, তেঘুরী, হাটবয়রা, নয়াপাড়া, গোসাইবাড়ী, গোয়ালবাড়ী, চালুহারাসহ প্রায় ১৬টি গ্রামের শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে একমাত্র বসন্তপুর নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়। এখান থেকে প্রতি বছর প্রায় ২০০ শিক্ষার্থী জেএসসি পাস করে।
অষ্টম শ্রেণী পাসের পর যেসব অভিভাবক সন্তানদের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে চান, তারা ভর্তি করান ১০ কিলোমিটার দূরে এনায়েতপুরের মেহের-উন-নেছা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, এনায়েতপুর ইসলামিয়া বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয় অথবা বেতিল বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে।
এসব বিদ্যালয়ে যেতে তিন-চার কিলোমিটার বালিপথ পাড়ি দিয়ে নৌকা ঘাটে যেতে হয়। এরপর নৌকায় যমুনা পার হয়ে আরো দু-তিন কিলোমিটার ভ্যান বা রিকশায় চড়ে যেতে হয়। এভাবে প্রতিদিন দুর্ভোগ নিয়ে পড়তে যায় শিক্ষার্থীরা। চরম ক্লান্তি নিয়ে বাড়ি ফেরে তারা। প্রতিকূল আবহাওয়ার দিনে স্কুলে যেতে পারে না। ফলে এ শিক্ষার্থীরা সাধারণত আশানুরূপ ফল করতে পারে না।
বেতিল উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ছাত্রী সোনিয়া খাতুন জানায়, হাট বয়ড়া চরে তাদের বাড়ি। ভোরে ঘুম থেকে উঠে খেয়াঘাটে গিয়ে নৌকার জন্য অপেক্ষা করতে হয়। এরপর ভ্যান বা রিকশায় করে স্কুলে যায়। বাড়ি ফেরে সন্ধ্যায়। রাতে লেখাপড়া করার মতো শক্তি আর থাকে না।
তবে স্থল ইউনিয়নের বাসিন্দাদের বেশির ভাগেরই আর্থিক সচ্ছলতা নেই। তাদের সন্তানরা এনায়েতপুরের কোনো মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও অনেক সময় টাকার অভাবে স্কুলে যেতে পারে না। আর যারা বেশি গরিব, তারা তো অষ্টম শ্রেণী থেকেই ঝরে পড়ে।
গোয়ালবাড়ী গ্রামের খোকন হোসেন বলেন, তার ছেলে সুজন দুই বছর আগে জেএসসি পাস করেছে। এরপর আর পড়াতে পারেননি। সে এখন তার সঙ্গে মাছ ধরে।
এছাড়া বিস্তীর্ণ চরের মধ্য দিয়ে হেঁটে কয়েক কিলোমিটার পথ যেতে হয় বলে বিশেষ করে মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়ে খুব শঙ্কায় থাকেন অভিভাবকরা। স্থল ইউনিয়নের গোয়ালবাড়ী গ্রামের নবম শ্রেণীর ছাত্রী আঁখি খাতুন ও দশম শ্রেণীর ছাত্রী সাবেকুন্নাহার জানায়, দূরের রাস্তা, এ কারণে চার-পাঁচজন ছাত্রী একসঙ্গে না হলে সেদিন মা-বাবা স্কুলেই যেতে দেন না।
এ পরিস্থিতিতে বসন্তপুর নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়টিকেই মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে উন্নীত করার দাবি জানিয়েছেন স্কুলের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি হাতেম আলী মাস্টার ও প্রধান শিক্ষক সাইফ উদ্দিন ইয়াহিয়া।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে সিরাজগঞ্জ জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. শফী উল্লাহ বলেন, চৌহালীর ওই এলাকায় একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা খুবই জরুরি। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে ।
তিনি আরো বলেন, এরই মধ্যে আমরা ওই এলাকায় একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপনের জন্য জায়গা নির্ধারণের কাজ অনেকটা এগিয়ে নিয়েছি। প্রাথমিক কাজ শেষ হয়েছে, এখন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের অপেক্ষা।