১২ ঘণ্টা মানসিক নির্যাতন, পাঁচ আসামি না ধরে মিন্নিকে গ্রেফতার

নিজস্ব প্রতিবেদক |

বরগুনার আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যা মামলার প্রধান সাক্ষী তাঁর স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাঁকে গতকাল মঙ্গলবার সকাল পৌনে ১০টার দিকে শহরের দক্ষিণ মাইঠা এলাকার বাড়ি থেকে পুলিশ লাইনসে আনা হয়। তখন তাঁর সঙ্গে বাবা মোজাম্মেল হোসেন কিশোর ছিলেন। জিজ্ঞাসাবাদের জন্যই তাঁদের আনা হয় বলে শুরুতে পুলিশ জানায়। তবে প্রায় ১২ ঘণ্টা পর রাত ৯টার দিকে মিন্নিকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।

মিন্নির বাবা দাবি করেছেন, পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের নামে তাঁর মেয়েকে মানসিক নির্যাতন করেছে। হয়ত সে কারণেই মিন্নি এমন সব কথা বলেছেন যে তার সূত্র ধরেই তাঁকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। এদিকে মামলার এজাহারভুক্ত পাঁচ আসামিকে এখনো গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।

মিন্নিকে ১২ ঘণ্টা মানসিক নির্যাতন, পাঁচ আসামি না ধরে মিন্নিকে গ্রেফতার বিষয়ে রাত সোয়া ৯টার দিকে বরগুনার পুলিশ সুপার মো. মারুফ হোসেন তাঁর কার্যালয়ে প্রেস বিফ্রিং করেন। তিনি বলেন, মিন্নিকে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। রাত ৯টার দিকে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। পুলিশ সুপার আরো বলেন, ‘দিনব্যাপী জিজ্ঞাসাবাদ শেষে এবং এর আগে দীর্ঘ সময় ধরে প্রাপ্ত তথ্যাদি পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করে এ হত্যাকাণ্ডে মিন্নির সংশ্লিষ্টতা প্রাথমিকভাবে প্রতীয়মান হয়েছে। তাই মামলার মূল রহস্য উদ্ঘাটন ও সুষ্ঠু তদন্তের জন্য তাঁকে ১২ ঘণ্টা মানসিক নির্যাতন, পাঁচ আসামি না ধরে মিন্নিকে গ্রেফতার করা হয়।’

রিফাত হত্যার সঙ্গে মিন্নির সম্পৃক্ততার ব্যাপারে পুলিশ সুপার বিস্তারিত আর কিছু বলেননি। তবে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তদন্তের স্বার্থে মিন্নিকে আদালতে সোপর্দ করে প্রয়োজনে রিমান্ড চাওয়া হবে।

মিন্নির ১২ ঘণ্টা মানসিক নির্যাতন, পাঁচ আসামি না ধরে মিন্নিকে গ্রেফতার বিষয়ে তাঁর পরিবার দাবি করছে, মামলা ভিন্ন খাতে নেওয়ার জন্যই পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে।

মিন্নির বাবা মোজাম্মেল হোসেন কিশোর রাত সাড়ে ৯টার দিকে মোবাইল ফোনে এ প্রতিবেদককে বলেন, রিফাত হত্যা মামলার এক আসামিকে শনাক্তের কথা বলে মিন্নিকে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে বাসা থেকে পুলিশ লাইনসে নিয়ে আসে। তিনিও মিন্নির সঙ্গে পুলিশের পিকআপে করে পুলিশ লাইনসে চলে আসেন। তিনি বলেন, ‘পুলিশ লাইনে আমাকে একটি কক্ষে বসিয়ে রেখে মিন্নিকে পুলিশ ভেতরে নিয়ে যায়। সেই থেকে ১২ ঘণ্টা আমি ওই কক্ষেই ছিলাম। একই সঙ্গে দীর্ঘ সময় মিন্নিকে তারা জিজ্ঞাসাবাদের নামে মানসিক নির্যাতন করে।’

মোজাম্মেল হোসেন আরো বলেন, ‘আমার মেয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তার স্বামীকে রক্ষার চেষ্টা করেছিল। একই সঙ্গে ঘটনার সময় উপস্থিত লোকজনের সহযোগিতা চেয়েছিল। কিন্তু রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে থাকা নয়ন বন্ড ও রিফাত ফরাজির ভয়ে কেউ এগিয়ে আসেনি। শুরু থেকেই প্রভাবশালীরা আমার মেয়ের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপপ্রচার চালিয়ে আসছিল। সেই অপপ্রচারের সূত্র ধরেই পুলিশ প্রভাবশালীদের বাঁচাতেই আমার মেয়েকে গ্রেপ্তার করেছে।’

মিন্নিকে পুলিশ লাইনসে নেওয়ার বিষয়ে বরগুনার পুলিশ সুপার নিজ কার্যালয়ে দুপুরের দিকে সংবাদ সম্মেলন করেন। তিনি বলেন, মিন্নি এই মামলার এক নম্বর সাক্ষী। তাই তাঁর জবানবন্দি নেওয়ার জন্য স্বজনসহ তাঁকে পুলিশ লাইনসে আনা হয়েছে। তিনি জানান, রিফাত হত্যার পর থেকেই মিন্নি ও তাঁর পরিবারের নিরাপত্তার জন্য তাঁদের বাড়িতে পুলিশ পাহারা বসানো হয়। তা এখনো রয়েছে।

নয়ন বন্ডের বাসায় পুলিশ

রিফাত হত্যা মামলার প্রধান আসামি, ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত সাব্বির আহমেদ নয়ন ওরফে নয়ন বন্ডের বাসায় পুলিশ অভিযান চালিয়েছে। সোমবার রাতে ওই অভিযান চালানো হয় বলে একটি সূত্র জানিয়েছে। অভিযানের সময় নয়ন বন্ডের মা সাহিদা বেগম পুলিশকে সহযোগিতা করেছেন। তবে পুলিশের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছে, বরগুনা সরকারি কলেজের দেয়াল ঘেঁষেই নয়ন বন্ডের বাসা। নয়নের সঙ্গে ওই বাসাতেই তার মা সাহিদা বেগম বসবাস করতেন। কিন্তু ঘটনার পর থেকেই নয়ন বন্ডের মা ওই বাসায় তালা ঝুলিয়ে অন্যত্র চলে যান। নয়ন বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার পর তার লাশ গ্রহণ করেন সাহিদার ভাই। নয়নের মা তাঁর ভাইয়ের গৌরীচন্নার বাসায় অবস্থান করছিলেন।

সোমবার রাত ১০টার দিকে পুলিশের একটি দল নয়নের বাসার সামনে আসেন। তখন নয়ন বন্ডের মা তাদের সঙ্গে ছিলেন। তিনি তালা খুলে দিলে পুলিশ প্রশাসনের সদস্যরা ঘরে প্রবেশ করেন। ঘণ্টা দেড়েক পর পুলিশ সদস্যরা বাসা থেকে চলে যান। তাঁরা আলামত হিসেবে বেশ কিছু জিনিস নিয়ে যান।

হঠাৎ আলোচনায় নয়নের মা

ঘটনার পর থেকে নয়নের মা সাহিদা অনেকটা আত্মগোপনে ছিলেন। এরই মধ্যে তাঁকে উদ্ধৃত করে অনলাইন পোর্টালে সংবাদ পরিবেশন করা হয়। সেখানে নয়নের গডফাদারের নাম প্রকাশ করা হয়। পরে বরগুনার সংবাদকর্মীরা নয়নের মাকে খুঁজে বের করেন। প্রথম দিকে তিনি নয়নের ব্যাপারে কোনো বক্তব্য দেননি। কিন্তু হঠাৎ করেই নয়নের মা দুটি ঘটনার জন্য মিন্নিকে দায়ী করে বক্তব্য দিয়ে আলোচনায় আসেন। বলেন, মিন্নির ব্যবহারের অনেক কিছু তাঁর ঘরে রয়েছে।

নয়ন বন্ডের মায়ের বক্তব্যের সূত্র ধরেই রিফাতের বাবা মিন্নির বিরুদ্ধে খুনের ঘটনার সম্পৃক্ততার অভিযোগ তোলেন। শনিবার রাতে রিফাতের বাবা বরগুনা প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে মিন্নির গ্রেপ্তার দাবি করেন। তিনি অভিযোগ করেন, এ হত্যার সঙ্গে মিন্নি জড়িত। কারণ হিসেবে তিনি সংবাদ সম্মেলনে নয়ন বন্ডের মায়ের বক্তব্যের উদ্ধৃতি দেন। ওই সংবাদ সম্মেলনের আগে ও পরে প্রেস ক্লাবে এমপিপুত্র সুনাম দেবনাথের উপস্থিতি আলোচনার জন্ম দেয়।

সংবাদ সম্মেলনের পরের দিন রবিবার রিফাত শরীফকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় স্ত্রী মিন্নির গ্রেপ্তারের দাবিতে বরগুনা প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন হয়। মানববন্ধনে স্থানীয় সাংসদের ছেলে ও বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক সুনাম দেবনাথ বক্তব্য দেন। ‘বরগুনার সর্বস্তরের জনগণ’-এর ব্যানারে আয়োজিত মানববন্ধনে সুনামের অনুসারীরা অংশ নেয়। মানববন্ধনে বক্তারা অভিযোগ করেন, রিফাত হত্যায় তাঁর স্ত্রী মিন্নি জড়িত। তাঁকে গ্রেপ্তারের দাবি করেন তাঁরা।

ওই ঘটনার পর রবিবার দুপুরে মিন্নি তাঁর বাড়িতে এক সংবাদ সম্মেলন করেন। লিখিত বক্তব্যে তিনি অভিযোগ করেন, যাঁরা বরগুনায় ‘বন্ড ০০৭’ নামে সন্ত্রাসী গ্রুপ সৃষ্টি করিয়েছিলেন, তাঁরা খুবই ক্ষমতাবান এবং অর্থবিত্তশালী। নেপথ্যের এই ক্ষমতাবানরা বিচারের আওতা থেকে দূরে থাকার জন্য হত্যা মামলাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে তাঁর শ্বশুরের ওপর বিভিন্নভাবে চাপ প্রয়োগ করে সংবাদ সম্মেলন করিয়েছেন।

উল্লেখ্য, গত ২৬ জুন সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে প্রকাশ্যে রিফাত শরীফকে তাঁর স্ত্রী মিন্নির সামনে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। রিফাতকে কোপানোর ঘটনার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। ওই ভিডিওতে দেখা যায়, দুজন রাম দা দিয়ে রিফাতকে কোপাচ্ছে। মিন্নি তাদের প্রতিহত করার চেষ্টা করছেন। একজনকে ঠেলে সরিয়ে দিলে অন্যজন এসে রিফাতকে কোপাচ্ছে। স্বামীকে বাঁচাতে তিনি বারবার চিৎকার করছিলেন। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনি।

দুর্বৃত্তরা রিফাতকে কুপিয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় ফেলে রেখে চলে যায়। বিকেলে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়। ওই দিন রাতেই রিফাতের বাবা আবদুল হালিম শরীফ বরগুনা থানায় ১২ জনকে আসামি করে একটি মামলা করেন। এ ছাড়া সন্দেহভাজন হিসেবে অজ্ঞাতপরিচয় আরো চার-পাঁচজনকে আসামি করেন। মামলায় মিন্নিকে প্রধান সাক্ষী করা হয়। খুনের মামলার প্রধান আসামি নয়ন বন্ড ২ জুলাই পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়।

মামলার এজাহারভুক্ত ছয় আসামিসহ ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ১০ জন আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে। মামলার দুই নম্বর আসামি রিফাত ফরাজীসহ বাকি তিন আসামি এখনো রিমান্ডে আছে। মামলার এজাহারভুক্ত পাঁচ আসামি এখনো গ্রেপ্তার হয়নি। পুলিশ বলছে, তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ - dainik shiksha আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0036869049072266