ঘোড়া গাড়ি আর টেম্পুর স্ট্যান্ডের হল্লা লেগে থাকে সারাদিন। সদরঘাটের লঞ্চের মানুষের ভিড় এসে যোগ হয় তার সঙ্গে। এরপর যখন মাল টানার ঠেলা গাড়ি এসে যোগ দেয় তখন নরক গুলজার শুরু হয়। বাহাদুর শাহ পার্ক থেকে সদরঘাট পর্যন্ত মানুষের হাঁটাচলাই বন্ধ হয়ে যায়। সদরঘাটের আগে বাংলা বাজারের চার মাথার মোড়ের এই ভিড়, এই টেম্পুর স্ট্যান্ডের আড়ালে ঢাকা পড়ে থাকে অবিভক্ত বাংলার প্রথম সরকারি স্কুল ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল। ১৮৩৫ সালে প্রতিষ্ঠিত এ স্কুলে ১৮৩ বছরের ঐতিহ্যই শুধু মিশে নেই, এর প্রতিটি ইটের ভাঁজে রয়েছে এ অঞ্চলে শিক্ষার গৌরবময় আলো ছড়িয়ে দেওয়ার অহংকার। বুড়িগঙ্গার তীরে অবস্থিত স্কুলটি আহসান মঞ্জিল, বাহাদুর শাহ পার্ক, জগন্নাথ কলেজ এবং ঢাকা সদর ডাকঘর দিয়ে ঘেরা।
ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল ইংরেজ আমলে প্রতিষ্ঠিত উপমহাদেশের সবচেয়ে প্রথম সরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুল। এই স্কুলের বিখ্যাত ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান, বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু, মেঘনাথ সাহা, বিপ্লবী দীনেশ গুপ্ত, কবি বুদ্ধদেব বসু, মুনীর চৌধুরী, মুস্তাফা মনোয়ার, অধ্যাপক কবির চৌধুরী, সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক, এইচ টি ইমামের মতো অনেক স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব। আরো ছিলেন চলচিত্র পরিচালক খান আতাউর রহমান, সতীশ চন্দ্র রায়, আব্দুল হালিম, বিচারপতি মোস্তফা কামাল, অভিনেতা বুলবুল আহমেদ, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ডা. সারোয়ার আলীসহ আরো অনেকেই। ঢাকার নবাব খাজা আব্দুল গণি এ স্কুলের প্রথম ব্যাচের ছাত্র ছিলেন।
প্রখ্যাত কবি, সম্পাদক বুদ্ধদেব বসু ১৯২৫ সালে এই স্কুল থেকেই এন্ট্রান্স বা প্রবেশিকা (বর্তমানে এস.এস.সি) পাস করেছিলেন। নবম ও দশম শ্রেণি এখানেই পড়েছিলেন। তিনি তার ‘আমার ছেলেবেলা’ বইতে এ স্কুলের বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে- ‘ঢাকার কলেজিয়েট স্কুলটি অনেক কালের নামজাদা-কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমল থেকেই মর্যাদাবান। দাঁড়িয়ে আছে ঢাকার প্রধান নাগরিক অঞ্চলে সগৌরবে, গোল মোটা রোমক-থামওলা উন্নতশির অট্টালিকা ... সিঁড়ি, মেঝে, বারান্দা সব তকতকে পরিষ্কার; ক্লাসরুমগুলোতে আলো-হাওয়া প্রচুর খেলে, কিন্তু কম্পাউন্ড পেরিয়ে গাড়ি-ঘোড়ার শব্দ লেশমাত্র পৌঁছায় না।’
বুদ্ধদেব বসুর বর্ণনার সেই স্কুল আজ আর নেই। এই ভিড়ের ফাঁক গলে কীভাবে যে ছোট ছোট বাচ্চাগুলো প্রতিদিন স্কুলে যাওয়া আসা করে সেটাই এক বিস্ময়। তার চেয়ে বড় বিষয় এই হল্লা-হট্টগোলের মধ্যে প্রভাতি ও দিবা শাখার দুই হাজার দুইশ শিক্ষার্থী ক্লাস করে কীভাবে। অবিভক্ত বাংলার সবচেয়ে পুরনো স্কুলটি এখন নানা সমস্যায় জর্জরিত। শ্রেণিকক্ষ অপর্যাপ্ত। প্রায় ২২ শ শিক্ষার্থী ক্লাস করে ২২টি শেণি কক্ষে। নেই খেলার মাঠ। পাঠাগারে আছে অনেক পুরানো দুর্লভ বই, তবে তা নষ্ট হচ্ছে ভালো মানের কক্ষ না থাকার কারণে। মূল পুরনো ভবনটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে ১৯৯৩ সালে। সেই ভবনে ক্লাস না হলেও পুরনো ভবনের ভেতর দিয়ে দুই নতুন ভবনের সংযোগ করিডোর। সেই পথেই শিক্ষার্থীদের যাতায়াত হুটোপুটি। যে কোনো সময় ঘটতে পারে দুর্ঘটনা। কিন্তু তা নিয়ে মাথাব্যথা নেই কর্তৃপক্ষের। নতুন একটি পাঁচতলা ও একটি তিনতলা ভবনে পাঠদান ও দাপ্তরিক কাজ চলছে।
কলেজিয়েট স্কুলের মূল ফটকের দেওয়ালে একটি স্মৃতিফলক। প্রধান শিক্ষক রত্নামণি গুপ্তের (১৮৮৮-১৮৯৬) নয় বছরের দায়িত্বকালে স্কুলটি আটবার প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিল। এখন পর্যন্ত সেই ধারা বজায় রয়েছে। গত দশ বছরে এ স্কুলের পাসের হার ৯৮ শতাংশের বেশি। ১৯২৬ সালে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্ররা সংবর্ধনা দেয়। সেই অনুষ্ঠানের মানপত্রের কপি সংরক্ষিত আছে স্কুল দপ্তরে। বাংলার গভর্নর লর্ড লিটনের উপহার দেওয়া শতবর্ষী এক বুকশেলফ রাখা আছে প্রধান শিক্ষকের কক্ষে। আছে ‘হিজ মাস্টার্স ভয়েজ’ কোম্পানির একটি গ্রামোফোন, চাবি দিয়ে চালানো একটি পুরোনো পেন্ডুলাম ঘড়ি। ঐতিহ্যের সাক্ষ্য হয়ে রয়েছে এসব। কিন্তু স্কুলের বর্তমান অবস্থা অত্যন্ত নাজুক।
স্কুলের প্রধান শিক্ষক মো: আবু সাইদ ভুঁইয়া বললেন, অবকাঠামো সমস্যা সবচেয়ে বেশি। খুব কম জায়গায় অনেক ছাত্র পড়াতে হয়। ছাত্রদের এক্সট্রা কারিকুলাম কিছুই করাতে পারি না। হল রুম নেই, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও করতে পারি না। শহীদ মিনারও নেই। শুধু কাটখোট্টা লেখাপড়ায় ছাত্রদের উজ্জীবিত করা যায় না। রয়েছে শিক্ষক সংকট। সবমিলিয়ে প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী স্কুলটি অবহেলিত অবস্থায় রয়েছে। তিনি বললেন, অনেক ঘোরাঘুরি করে জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে দেখা করেও স্কুলের গেট থেকে টেম্পু স্ট্যান্ডটা সরানো যায়নি। এই ঝঞ্ঝাটের মধ্যে ২২শ ছাত্র প্রতিদিন আসা যাওয়া করে, অভিভাবকরা বাইরে দাঁড়াতে পারেন না।
তিনি জানান, নতুন ভবন নির্মাণের অনুমোদন হয়ে রয়েছে। কিন্তু পুরানো ভবনটা ভেঙে ফেলে নতুন ভবন করা হবে কি না এ নিয়ে সিদ্ধান্তে আসতে পারছে না কর্তৃপক্ষ। প্রাক্তন ছাত্ররা এটা না ভাঙার পক্ষে। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি। এ বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়ার জন্য তার কাছে আবেদন করা হয়েছে। তিনি উদ্যোগ নেবেন বলে আশ্বস্ত করছেন।
শুরুর কথা
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে কোন শিক্ষানীতি ছিল না। শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল সনাতনী প্রথায়। মুসলমানেরা বিশেষ করে অভিজাত পরিবারের সন্তানেরা বাড়িতে না হলেও মসজিদের সাথে সংযুক্ত মক্তবে পড়াশোনা করত। হিন্দুরা পাঠশালা এবং টোলে পড়ত। জমিদার, ব্যবসায়ী, মহল্লার পঞ্চায়েত এসব পৃষ্ঠপোষকতা করত। পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে ব্রিটিশ আমলে আরবি ও ফারসিসহ সনাতনী শিক্ষা ব্যবস্থায় ভাটা পড়ে।
১৮৩০ সালে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিংক এক আদেশে ইংরেজিকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রচলন করেন। এরপরে শিক্ষা বিষয়ক কর্তৃপক্ষ সর্বপ্রথম ঢাকা ও পাটনা নগরীতে স্কুল খোলার প্রস্তাব করে। ১৮৩৫ সালের ২৪ জুন সরকার এ প্রস্তাব গ্রহণ করে। এর পরের মাসেই অর্থাত্ ১৫ জুলাই ইংরেজি বিদ্যালয় হিসেবে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল প্রতিষ্ঠা করে। এটি ছিল অবিভক্ত বাংলার প্রথম সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠার সময় স্কুলটির নাম ছিল ‘ঢাকা গভর্নমেন্ট হাইস্কুল’ এবং এর প্রথম প্রধান শিক্ষক ছিলেন মি. রিজ নামের একজন ইংরেজ মিশনারি। ১৮৪১ সালে এ স্কুলের প্রাঙ্গণেই ঢাকা কলেজের ভিত্তি স্থাপন করা হয় এবং স্কুল ভবনটি পুনর্নির্মাণ করে এর দ্বিতীয় তলায় কলেজের স্থান সংকুলানের ব্যবস্থা করা হয়। এ সময় স্কুলটির নতুন নামকরণ করা হয় ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল। অনেকদিন পর্যন্ত এ ভবনের নিচতলাতেই স্কুলটির কার্যক্রম চলেছে। মওলানা আবদুল লতিফ (পরবর্তীকালে নবাব আবদুল লতিফ খান বাহাদুর) এ সময় স্কুলে একজন শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। ১৯০৮ সালে স্কুলটিকে কলেজ থেকে পৃথক করে স্কুল পরিদর্শকের অধীনে দেওয়া হয়। এ সময় জিলা স্কুলের মর্যাদা অর্জন করলেও এটি ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল নামেই পরিচিতি পায়। ছেলেদের এ স্কুলে এখন দুই শিফটে মানবিক, বিজ্ঞান এবং বাণিজ্য শাখায় পড়ানো হয়।