৩০ কোচিংয়ের নথি তলব: দুদকের অনুসন্ধানে স্থবিরতা

নিজস্ব প্রতিবেদক |

অবৈধ সম্পদসহ বিভিন্ন দুর্নীতির খোঁজে চাহিদাকৃত ৩০ কোচিং সেন্টার মালিকদের প্রতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিগত তথ্যসমূহ তলব করার চার মাস অতিক্রম হলেও মেলেনি কাক্ষিত নথিপত্র। দুর্নীতি দমন কমিশন বা দুদকের ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয় থেকে ২০১৭ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে পৃথক পৃথকভাবে পাঠানো নোটিশে কোচিং মালিকদের ৪ জানুয়ারির মধ্যে চাহিদাকৃত নথিপত্র চাওয়া হয়েছিলো।  এরই মধ্যে বেশকিছু কোচিং সেন্টার আংশিক কিংবা পুরো নথিপত্র দুদকের কাছে সরবরাহ করলেও ১৫টির বেশি প্রতিষ্ঠান নানা অজুহাতে নথিপত্র সরবরাহ করছে না বলে দুদক সূত্রে জানা গেছে। 

দুদকের অনুসন্ধান সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা দৈনিকশিক্ষা ডটকমকে বলেন, ১৪০টি কোচিং প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে দুদকের অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ অবৈধ বাণিজ্যিক কোচিং, প্রশ্নপত্র ফাঁস, ভুয়া পরীক্ষার্থী সরবরাহ ও মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে ভর্তি পরীক্ষায় অনিয়মসহ অবৈধ সম্পদ অর্জন।  এ অভিযোগ অনুসন্ধানে প্রথম পর্যায়ে তিনটি পৃথক টিম ১০টি করে মোট ৩০টি কোচিং সেন্টারের মালিকদের  প্রতিষ্ঠান সংশ্লষ্ট বিভিন্ন তথ্য চাওয়া হয়েছে।  তথ্যের মধ্যে রয়েছে ট্রেড লাইসেন্স, অনুমোদন সংক্রান্ত কাগজ, ইউনাইটেড গ্রুপ ভিত্তিক তথ্য, তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান, আয়কর ও ভ্যাট প্রদান সংশ্লিষ্ট নথিপত্র।

দুদকের ওই কর্মকর্তা বলেন,  গত ৪ জানুয়ারির মধ্যে চাহিদাকৃত নথিপত্র জমা দেওয়ার কথা থাকলেও মাত্র ১৪ টি  প্রতিষ্ঠান চাহিদাকৃত নথি-পত্র জমা দিয়েছে। জমা দেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে ইউসিসি, সাইফুর’স, সানরাইজ, উদ্ভাস, কনফিডেন্স ও রেটিনাসহ ১৪ টি কোচিং প্রতিষ্ঠান। বেশকিছু প্রতিষ্ঠান সময় চেয়ে আবেদন করেছে। অনেক কোচিং সেন্টার জানিয়েছে তাদের প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। তবে তাদের নথিপত্রও চেয়েছি। আমরা তাদের কাছে বার বার তাগিদ দিয়ে যাচ্ছি। সময়মতো সরবরাহ না করলেও দুদক আইনের ১৯ (৩) ধারায় নথিপত্র ও তথ্য প্রদানে অসহযোগিতার অভিযোগ মামলায় যেতে হবে। আশা করছি তারা আমাদের সহযোগিতা করবে।

কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের জন্য চালু করা ১১০টি কোচিং সেন্টারের তালিকা সামনে রেখে অনুসন্ধান শুরু করে দুদকের ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়। এর পরপরই ২০১৭ খ্রিস্টাব্দের ২৯ নভেম্বর দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মোর্শেদ আলম ও দুদকের সহকারী পরিচালক আবদুল ওয়াদুদের নেতৃত্বে দুই পৃথক টিম ফার্মগেট, পান্থপথ ও কলাবাগানসহ বিভিন্ন এলাকায় বেশকিছু কোচিং সেন্টারের বিরেুদ্ধে অভিযান চালিয়েছিল।অভিযানে অধিকাংশ কোচিং সেন্টার বৈধ কাগজপত্র দেখাতে পারেনি।

দুদক সূত্র জানায়, ১১০ সেন্টারের বিরুদ্ধে অবৈধ কোচিং, প্রশ্নপত্র ফাঁস, ভুয়া পরীক্ষার্থী সরবরাহ, মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে ভর্তি পরীক্ষায় অনিয়মের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে। কোচিং সেন্টার মালিকরা কীভাবে ফুলে-ফেঁপে উঠেছেন, তাদের নামে কীভাবে কোটি কোটি টাকার সম্পদ থাকতে পারে এসবই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে অনুসন্ধান করা হচ্ছে।

অনুসন্ধান কার্যক্রম তদারক করছেন দুদকের ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক নাসিম আনোয়ার। এ বিষয়ে তিনি বলেন, অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। আমাদের টিম কাজ করছে। এখন নথিপত্র সংগ্রহের কাজ চলছে। নথি-পত্র যাচাই শেষে আইন অনুসারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। অনুসন্ধান পর্যায়ে এর বাইরে কোনো বক্তব্য দেওয়া যথাযথ হবে না।

দুদক জানায়, সারা দেশের কোচিং সেন্টারগুলোর মধ্যে সিংহভাগই গড়ে উঠেছে ঢাকা মহানগর এলাকায়। যৌথ মালিকানাধীন কোচিং সেন্টারগুলো রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানি (আরজেএসসি) থেকে নিবন্ধন নিয়ে ও একক মালিকানাধীন সেন্টারগুলো ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন থেকে ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে অবাধে ব্যবসা করছে। এর মধ্যে সরাসরি কোচিং ব্যবসার কথা উল্লেখ করে আরজেএসসি থেকে নিবন্ধন নিয়েছে ১৯টি কোচিং সেন্টার। এই তালিকায় প্যাসিফিক, ভার্সিটি, বীকন, সানরাইজ, ক্ল্যাসিক, মেডিক্যাল, আইকনসহ অন্যান্য কোচিং সেন্টারের নাম রয়েছে। আরো ৩১৭টি প্রতিষ্ঠান তাদের নিবন্ধন সংক্রান্ত কাগজপত্রে নানাভাবে কোচিং শব্দ উল্লেখ করেছে। তাদের মধ্যে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের কোচিং করাবে তা নির্দিষ্ট করা সম্ভব হয়নি।

দুদকে আসা অভিযোগে বলা হয়েছে, সারা দেশে প্রতিবছর প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকার কোচিং বাণিজ্য হচ্ছে। অভিভাবকদের পকেট থেকে যাচ্ছে এই টাকা। শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ বহু গুণে বাড়িয়ে তুলেছে কোচিং সেন্টারগুলো। শুধু শহরে নয়, প্রত্যন্ত অঞ্চলেও কোচিং সেন্টার গড়ে উঠেছে। রাজধানীকেন্দ্রিক সেন্টারগুলো ঢাকার বাইরে একের পর এক শাখা খুলছে। খ্যাতনামা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর স্বনামধন্য শিক্ষকরাও ব্যক্তিগতভাবে নিজেদের বাসা-বাড়িতে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন ব্যাচে বাণিজ্যিকভাবে কোচিং করাচ্ছেন। 

অভিযোগে আরো বলা হয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় নীতিমালা করে কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করলেও এসব প্রতিষ্ঠান আরজেএসসি ও সিটি করপোরেশন থেকে নিবন্ধন নিয়ে অবাধে কোচিং ব্যবসা করছে। অভিযুক্ত ১১০টি কোচিং সেন্টারের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ৩৩টি, মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির ১৫টি, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পাঁচটি, মেরিন, টেক্সটাইল, ক্যাডেটের জন্য ছয়টি, একাডেমিক কোচিং সেন্টার ১৮টি, বিসিএস ও অন্যান্য চাকরির জন্য ১৪টি ও ইংরেজিসহ বিভিন্ন ভাষা শেখার ১৯টি কোচিং সেন্টারের নাম রয়েছে। এর মধ্যে কোনো কোনো কোচিং সেন্টার একাধিক খাতে কোচিং করাচ্ছে। খাত ভিত্তিক হিসেবে ১১০টির নাম উল্লেখ করা হয়েছে। 

এর মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য ইউসিসি, ইউনিএইড (কিরণ, কবির, সুমন), ইউনিএইড (মনির, মল্লিক, জহির), ফোকাস, সানরাইজ, গার্ডিয়ান, ডিভাইন, এইউসিসি (জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়), সাইফুর’স, ইপিপি (শুধু ক-ইউনিট), ডিইউসিসি, ডি-হক স্যার, লিডস, হোপ, আইকন প্লাস, ভয়েজ, মেরিন, আইকন, কোয়ান্টা, দুর্বার, প্যারাগন, অ্যাডমিশন এইড, প্রাইমেট, প্লাজমা, এইউএপি, সংশপ্তক, এফ্লিক্স, এডমিশন প্লাস, এডমিয়ার, ইউএসি, ইউরেনাস, পিএসি ও ইঞ্জিনিয়ার্স কোচিং সেন্টারের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। 

মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কলেজে ভর্তির উদ্ভাস, রেটিনা, সানরাইজ, পিএসি, কর্ণিয়া, ডিএমসি, মেডিকো, দি রয়াল, গ্রীন অ্যাডমিশন এইড, থ্রি ডক্টরস, ফেইম, প্রাইমেট, প্লাজমা, এভিস ও মেডিকেয়ারের নাম উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য উদ্ভাস, সানরাইজ, পিএসি, ওমেকা ও মেরিনাথের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। মেরিন-টেক্সটাইল-ক্যাডেটে ভর্তির জন্য ইম্যাক, ভয়েজ, মিরপুর ক্যাডেট কোচিং (ফার্মগেট শাখা), মেরিন গাইড, অ্যাডমিয়ার ও বর্ণ কোচিং সেন্টারের নাম রয়েছে।

একাডেমিক কোচিং সেন্টার হিসেবে সানরাইজ, ডিভাইন, উদ্ভাস, ম্যাবস, অপরাজিতা, আইডিয়াল একাডেমি, রিয়াল, সেন্ট তেরেসা, অন্বেষা, ফেইম মবিডিক, ক্রিয়েটিভ, উদ্দীপন, ই-হক, বিইউপি, সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড, দুরন্ত, অভিযাত্রিকের নাম রয়েছে।

বিসিএস ও অন্যান্য চাকরির জন্য কনফিডেন্স, বীকন, ওরাকল, ক্যারিয়ার এইড, এইউএপি, সাকসেস, সুগন্ধা, হোপ, প্রাইম একাডেমি, বিসিএস আপগ্রেড, ওয়ান ল্যাংগুয়েজ ক্লাব, ইউনিট, গ্লোবাল প্রফেশনাল একাডেমি ও ডিফেন্স গাইড কোচিং সেন্টারের নাম উল্লেখ করা হয়।

ইংরেজিসহ বিভিন্ন ভাষা শেখার সাইফুর'স, এফএম মেথড, ইংলিশ ওয়ার্ড, ব্রিজ কাউন্সিল, সুগন্ধা, হোপ, টার্গেট, নজরুল, ওয়ান ল্যাংগুয়েজ ক্লাব, হিলস, এজিসিসিসি, ওরি, গ্লোবাল, লিডার, ইংলিশ সেন্টার, এলফিক্স, বিজয়, সিডি মিডিয়া ও লিবার্টি ইংলিশ কোচিং সেন্টারের নাম রয়েছে।

কোচিং বাণিজ্যের বিষয়ে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ সম্প্রতি বলেন, শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন বাংলাদেশের সব কোচিং সেন্টারগুলো অবৈধ। আমরা বলতে চাই সব কোচিং সেন্টারগুলো শুধু অবৈধ নয়; দুর্নীতির আখড়াও। সবাই মিলে অবৈধ ও দুর্নীতিগ্রস্ত কোচিং সেন্টারগুলো বন্ধ করার উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার।আমাদের সন্তানরা সারা দিন কোচিং সেন্টারে ঘুরে বেড়াবে তা হতে পারে না। তাই যে কোনো মূল্যে সম্মিলিতভাবে প্রশ্নপত্র ফাঁস ও কোচিং বাণিজ্য চিরতরে বন্ধ করতে হবে।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0030438899993896