৪ শতাংশ অতিরিক্ত কর্তন: একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত

অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী |

বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন থেকে অবসর সুবিধা বোর্ড ও কল্যাণ ট্রাস্ট তহবিলের জন্য যে টাকা এমপিও থেকে কেটে নেয়া হয় তার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ খুঁজে পাই না৷ অতিরিক্ত ৪ শতাংশের কথা না হয় পরে বলি৷ তার আগে বর্তমানে যে ৬ শতাংশ কেটে রাখা হয় সেটি নিয়েও প্রশ্ন থেকে যায়৷ প্রশ্নটি এ জন্য যে, টাকাটা সংশ্লিষ্ট শিক্ষক-কর্মচারীর সম্মতি ছাড়াই কেটে নেয়া হয়৷ টাকার মালিক সারা জীবনেও জানতে পারেন না তার কত টাকা কেটে রাখা হয়েছে৷ কেটে নেয়া টাকাটি ব্যাংকের কোন হিসেবে জমা করা হয় তাও জানেন না৷ শুধু কী তাই! যে উদ্দেশ্যে টাকাটি কেটে রাখা হয় সেটি কতটুকু প্রতিপালিত হয়? তাই যদি হতো তবে নিজের টাকা থেকে কেটে নিয়ে জমানো টাকাটা ফেরত পেতে শিক্ষক-কর্মচারীদের এত দুর্ভোগ পোহাতে হতো না৷ অবসর সুবিধা ও কল্যাণ ট্রাস্ট অফিসে এত ধর্ণা দিতে হতো না৷

কত অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক-কর্মচারী এ টাকা ফেরত পেতে গিয়ে খালি হাতে কবরবাসী হয়েছেন সে হিসেব আমাদের কারো কাছে নেই৷ কতজনের পরিবার মৃত্যুর পরও টাকা পেতে গিয়ে জনমের কষ্ট ভোগ করেছেন৷ অবসর সুবিধা ও কল্যাণ ট্রাস্ট নিয়ে আজ পর্যন্ত কারো সুখকর অভিজ্ঞতা নেই৷ এ নিয়ে সবার তিক্ত অভিজ্ঞতা৷ তারপরও যে টাকাটি পাওয়া যায় সে টাকার কোনো হিসেব দেয়া হয় না৷ একটা স্ট্যাটমেন্ট সাথে দেয়া দরকার ছিল৷ যে কোনো শিক্ষক-কর্মচারীর জানার ইচ্ছে থাকতে পারে তিনি কত টাকা চাঁদা দিয়েছেন আর কত টাকা সুবিধা পেয়েছেন৷ অবসরে যাবার আগেও যে কোনো সময় যে কেউ চাইলে তার জমার পরিমাণ জানার অবারিত সুযোগ থাকা উচিত ছিল৷ বিদ্যমান ৬ শতাংশ (৪ শতাংশ + ২ শতাংশ) চাঁদার বিনিময়ে সর্বশেষ মূল বেতনের ১০০ (৭৫+২৫) মাসের সমান টাকা পাবার কথা৷ কিন্তু এ পর্যন্ত যারা অবসর ও কল্যাণের টাকা পেয়েছেন তারা কেউই প্রাপ্ত টাকার সাথে এ রকম হিসেব মেলাতে পারেন না৷ তাই টাকাটা পরিশোধের সময় একটি হিসাব বিবরণী সাথে দেয়া প্রয়োজন৷ তা না হলে কেবলি প্রশ্ন থেকে যায়৷ থাকাটাই স্বাভাবিক৷ সরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের টাকা তো এ রকম কেটে রাখা হয় না৷ কেবল বেসরকারি শিক্ষকদের বেলায় যত জবরদস্তি আর জুলুম৷ এ সব জবরদস্তি আর জুলুম বন্ধ হওয়া চাই৷ তা না হলে দিনে দিনে ক্ষোভ আর অসন্তোষ বাড়তেই থাকবে৷

বলা নেই কওয়া নেই অতিরিক্ত কর্তনের যে সার্কুলারটি দেয়া হয়েছে সেটি গায়ের জোরে করা হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়৷ সার্কুলারটি দেবার আগে শিক্ষক-কর্মচারীদের প্রতিনিধিদের সাথে সংশ্লিষ্টদের বসা অপরিহার্য ছিল৷ চাঁদা বৃদ্ধি করার আগে কী পরিমাণ সুবিধা বৃদ্ধি করা হবে সেটি স্পষ্ট করা দরকার৷ ৬ শতাংশ চাঁদায় যদি ১০০ মাসের বেতনের সমান সুবিধা পাওয়া যায় তাহলে ১০ শতাংশে কম করে তা ১৭৫ মাসের সমান হবার কথা৷ এ সব বিষয়ের ফয়সালা না করে কেবল চাঁদা বৃদ্ধির বিষয়টি অন্যায় ও অযৌক্তিক৷ গাঁও-গেরামে একটি কথা প্রচলিত আছে- ‘নরম মাটি গোগরায়ও খুঁড়ে’৷ গোগরা এক ধরনের অতিশয় দুর্বল প্রাণী৷ বেসরকারি শিক্ষকদের যারা গোগরার মতো দুর্বল মনে করে এ সব তাদের কারসাজি ছাড়া অন্য কিছু নয়৷ শিক্ষক সমাজ গোগরার মতো কোনো দুর্বল প্রাণী নন৷ তারা দেশ ও জাতি গঠনের আসল কারিগর৷ তারা নৈতিক শক্তিতে বলিয়ান আশরাফুল মাখলুকাত৷ সকল অন্যায়, অনিয়ম, অনাচার ও দুরাচার তারাই দূর করেন৷ সকল অনিয়ম ঝ্যাঁটিয়ে বিদায় করার শিক্ষা তারাই সব মানুষকে দিয়ে থাকেন৷

বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীর বেতন আর কত টাকা? এর দিকে যাদের লোলুপ দৃষ্টি তারা কেমন মানুষ? এই তো সামনে রমজান মাস৷ যে টাকা বেতন পান তা দিয়ে কত জন রমজানের খরচ নির্বাহ করতে পারবেন? এরপর ইদ৷ তাদের ইদ বোনাস আর কয় টাকা? সে টাকায় কত জন ইদে পরিবার-পরিজনসহ ভালো জামা কাপড় কিনে পরতে পারেন? মনের মতো করে কত জন ইদ পালন করতে পারেন? কত জন ফেতরা দিতে পারেন? কুরবানি আদায় করতে পারেন? বিষয়গুলো ভেবে দেখার মানুষ নেই৷ কেবল বাঁশ দেবার মানুষ আছে৷ বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের প্রতি এহেন মনোভাব যাদের তারাই অবসর সুবিধা বোর্ড ও কল্যাণ ট্রাস্টের কর্ণধার৷ এদের কাছে কী আর আশা করা যায়? তাদের কাছে প্রত্যাশারই কী বা থাকে? এখন শিক্ষার সুযোগ সবার জন্য অবারিত করার সময়৷ বেসরকারি শিক্ষা জাতীয়করণের উপযুক্ত সময়৷ এখন চাঁদার নামে কর্তন বাড়ানোর সময় নয়৷

শিক্ষায় যখন বাংলাদেশ দ্রুত একটি বিপ্লবের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ঠিক তখন বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের অবসর ও কল্যাণ তহবিলে অতিরিক্ত চাঁদা কর্তনের বিষয়টি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত ছাড়া আর কিছু নয়৷ যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরায় তাদের ওপর বাড়তি চাঁদা মরার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের সামিল৷ সারা দেশের সাড়ে পাঁচ লক্ষাধিক শিক্ষক-কর্মচারী মর্মপীড়ায় আজ প্রতিবাদে সোচ্চার। এ প্রতিবাদে উবে যাবে সব ষড়যন্ত্র৷ নিপাত যাবে সব বঞ্চনা৷

লেখক:  অধ্যক্ষ,  চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট এবং দৈনিক শিক্ষার নিজস্ব সংবাদ বিশ্লেষক ৷


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
প্রাথমিকে ১০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ জুনের মধ্যে: প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha প্রাথমিকে ১০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ জুনের মধ্যে: প্রতিমন্ত্রী পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা দাবি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের - dainik shiksha পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা দাবি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের ঝরে পড়াদের ক্লাসে ফেরাতে কাজ করছে সরকার - dainik shiksha ঝরে পড়াদের ক্লাসে ফেরাতে কাজ করছে সরকার প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি, ভাইবোন গ্রেফতার - dainik shiksha প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি, ভাইবোন গ্রেফতার ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি - dainik shiksha ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন প্রায় শূন্যের কোটায় - dainik shiksha শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন প্রায় শূন্যের কোটায় ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে - dainik shiksha ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0028190612792969