৪৬ শতাংশ ছাত্রী ঝরে যায় : ব্যানবেইস জরিপ

দৈনিক শিক্ষা ডেক্স |

লিঙ্গ সমতা প্রতিষ্ঠিত হলেও মাধ্যমিকের ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হওয়া প্রায় ৪৬ শতাংশ ছাত্রী দশম শ্রেণি শেষ করার আগেই ঝরে পড়ছে। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) প্রকাশিতব্য শিক্ষা তথ্য প্রতিবেদনে এই উদ্বেগজনক তথ্য উঠে এসেছে। কয়েক দিনের মধ্যে এটি প্রকাশিত হবে বলে ব্যানবেইস সূত্রে জানা গেছে।

মাধ্যমিকে ঝরে পড়ার ওপর এর আগে ব্যানবেইসের ২০১১ সালের জরিপে বলা হয়েছিল, অভিভাবকদের নিম্ন আয়, বাল্যবিবাহ ও দারিদ্র্যই এর অন্যতম কারণ। বাল্য বয়সেই যেসব মেয়ের বিয়ে হয়ে যায়, তাদের মধ্যে ৯০ শতাংশই ঝরে পড়ে।

ঢাকার বাইরে বেশ কয়েকটি বিদ্যালয় পরিদর্শন করে মেয়েদের ঝরে পড়ার এই হারের সঙ্গে বাস্তবের মিল পাওয়া যায়। সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া উপজেলার নগরবাড়ী-বগুড়া মহাসড়কের পাটধারী এলাকায় অবস্থিত মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ উচ্চবিদ্যালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, সেখানে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হওয়া অর্ধেকেরও বেশি শিক্ষার্থী মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করার আগেই ঝরে পড়ে, যাদের অধিকাংশই মেয়ে। বিদ্যালয়ে সংরক্ষিত তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সালে ওই বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিল ৪২ জন শিক্ষার্থী। পাঁচ বছর পর ২০১৫ সালে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে ২০ জন। বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক জানালেন, ওই এলাকায় ঝরে পড়ার বড় কারণ দারিদ্র্য ও বাল্যবিবাহ।

গত সোমবার ঢাকার অদূরে কেরানীগঞ্জের শাক্তা উচ্চবিদ্যালয়ে গিয়ে জানা যায়, সহশিক্ষা থাকা এই বিদ্যালয়ে ২২ শতাংশের বেশি ছাত্রী ঝরে পড়ছে। বিদ্যালয়ে সংরক্ষিত ভর্তি-সংক্রান্ত পুরোনো খাতা দেখে জানা গেল, পাঁচ বছর আগে ২০১১ সালে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ১৩৯ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছিল। এর মধ্যে মেয়ে ছিল ৮০ জন। ছাত্রীদের মধ্যে ঝরে গেছে ১৮ জন।

প্রধান শিক্ষক আব্দুল ওয়াদুদ বললেন, এই স্কুলে ঝরে পড়ার মূল কারণ অভিভাবকদের দারিদ্র্য এবং পড়াশোনার প্রতি সচেতনতার অভাব। এ কারণে কিছু কিছু মেয়ের বাল্যবিবাহও হয়ে যাচ্ছে। গত মাসেও অনেকটা গোপনে নবম শ্রেণির এক ছাত্রীর বিয়ে হয়েছে।

কেরানীগঞ্জে ২২ শতাংশ ছাত্রী ঝরে গেলেও এই হার গ্রামাঞ্চলে, বিশেষ করে প্রত্যন্ত এলাকায় অনেক বেশি। এলাকাভেদে ঝরে পড়ার হার কম বা বেশি।

শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ গত রোববার সাংবাদিকদের বলেন, ঝরে পড়া কমাতে উপবৃত্তি বাড়ানোসহ সরকার বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে। এর মধ্যে ছাত্রীদের ডিগ্রি পর্যন্ত উপবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া সচেতনতা বাড়ানোসহ বিভিন্ন রকমের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, এতে সুফল পাওয়া যাচ্ছে।

বর্তমানে ডিগ্রি পর্যন্ত গরিব ও মেধাবী ছাত্রীদের উপবৃত্তি দেওয়া হয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ব্যানবেইসের একাধিক কর্মকর্তা ও শিক্ষাসংশ্লিষ্ট কয়েক ব্যক্তি বলেন, বর্তমানে শুধু উপবৃত্তির টাকা দিয়ে পড়াশোনার ব্যয় নির্বাহ করা সম্ভব হয় না। কারণ কোচিং-প্রাইভেটসহ অন্যান্য খরচ আছে। এ ছাড়া সামাজিক ও আর্থিক বাস্তবতার কারণেও অনেক মেয়ে ঝরে পড়ে।

জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী বলেন, নিরাপত্তাহীনতার কারণে অভিভাবকদের অনেকেই মেয়েকে বিয়ে দেওয়াটা সহজ সমাধান মনে করেন। বাল্যবিবাহ মাধ্যমিকে ঝরে পড়ার বড় কারণ বলে জানান তিনি। তাঁর মতে, ছাত্রীরা ঝরে পড়লে লৈঙ্গিক সমতা অর্জন ম্লান হয়ে যাবে। এ থেকে পরিত্রাণের উপায় হলো শিক্ষায় বিনিয়োগের পাশাপাশি সচেতনতা বাড়ানো।

ব্যানবেইসের বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য-২০১৫ প্রতিবেদন বলছে, দেশে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে ২০ হাজার ২৯৭টি (এর মধ্যে শুধু স্কুল ১৯ হাজার ৭২৬টি)। এসব প্রতিষ্ঠানে মোট ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ৯৭ লাখ ৪৩ হাজার ৭২ জন। এর মধ্যে ৫১ লাখ ৯৩ হাজার ৯৬২ জন (৫৩ দশমিক ৩১ শতাংশ) ছাত্রী।

এ তথ্য অনুযায়ী দেখা যায়, লৈঙ্গিক সমতা অর্জনের লক্ষ্য পার হয়ে গেছে। তবে ষষ্ঠ শ্রেণিতে যত ছাত্রী ভর্তি হচ্ছে, তার মধ্যে ৫৪ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ ছাত্রী মাধ্যমিক শেষ করতে পারে, অন্যরা ঝরে পড়ে। অন্যদিকে ভর্তি হওয়া ৬৬ দশমিক ২৮ শতাংশ ছাত্র মাধ্যমিক স্তর শেষ করতে পারে।

নিয়মিত মেয়াদে মাধ্যমিক স্তর সম্পন্ন করার ক্ষেত্রেও ছাত্রীরা পিছিয়ে। নিয়মিত মেয়াদে ছাত্রদের মাধ্যমিক স্তর শেষ করার হার যেখানে ৭৬ দশমিক ৪০ শতাংশ, সেখানে ছাত্রীদের এই হার ৬৪ দশমিক ৪০ শতাংশ।

ব্যানবেইসের পরিসংখ্যান বিভাগের প্রধান মো. শামছুল আলম বলেন, কয়েক দিনের মধ্যে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হবে।

ঝরে পড়ার কারণ: ২০১১ সালে ব্যানবেইসের করা ‘মাধ্যমিক স্কুল ড্রপআউট সার্ভে’ শীর্ষক প্রতিবেদনে ঝরে পড়ার কারণ হিসেবে প্রধান শিক্ষকেরা বলেছেন, ঝরে পড়া ২৪ দশমিক ২ শতাংশের অভিভাবক নিম্ন আয়ের, ২৪ দশমিক ৭ শতাংশের অভিভাবকের সাক্ষরজ্ঞান নেই, ১৮ দশমিক ৯ শতাংশের বাড়িতে পড়ার পরিবেশ খারাপ। আবার পরিবারের আগ্রহ কম ১৭ দশমিক ২ শতাংশের। এগুলোকে সামাজিক বাধা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সামাজিক বাধার মধ্যে আরও রয়েছে নিরাপত্তা, ধর্মান্ধতা, ইভ টিজিং, মাদকাসক্ত হওয়া ইত্যাদি।

অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দেখা যায়, অভিভাবকদের নিম্ন আয়, বাল্যবিবাহ, দারিদ্র্যই বড় কারণ। এর মধ্যে ১৫ দশমিক ৬ শতাংশের বাল্যবিবাহ হয়ে যাচ্ছে। অভিভাবকদের নিম্ন আয় ও দারিদ্র্যের প্রভাবের মধ্যে যোগসূত্র রয়েছে। এতে বলা হয়, বাল্যবিবাহ ঝরে পড়ার অন্যতম কারণ।

অভিভাবকদের ওপর জরিপ করতে গিয়েও দেখা যায়, ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশের বাবা পেশায় কৃষক এবং প্রায় ৩৪ শতাংশের বাবা শ্রমিক। শিক্ষাবান্ধব পরিবেশের অভাবসহ শিক্ষাব্যবস্থার কিছু সমস্যার কারণেও অনেক শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে।

খবরের সূত্র : দৈনিক প্রথম আলো, ১৩ এপ্রিল, ২০১৬।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য - dainik shiksha হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা - dainik shiksha ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক - dainik shiksha সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি - dainik shiksha ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার - dainik shiksha রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0058910846710205