৬৫ শতাংশ মাদরাসা শিক্ষার্থী সামাজিক মাধ্যমে সক্রিয়

নিজস্ব প্রতিবেদক |

ব্যক্তিগত মোবাইল বা ট্যাবের মাধ্যমে কওমি ও আলিয়া মাদরাসার শিক্ষার্থীদের ৬৫ শতাংশই সামাজিক মাধ্যমে সক্রিয় থাকেন। এরমধ্যে ছাত্ররা দিনের বেলায় অন্তত আধা ঘণ্টা আর ছাত্রীরা রাতে এক থেকে দেড় ঘণ্টা পর্যন্ত সময় ইন্টারনেটে ব্যস্ত থাকেন। কওমি ও আলিয়া মাদরাসার শিক্ষার্থীদের নিয়ে করা বেসরকারি এনজিও মুভ ফাউন্ডেশনের একটি জরিপের প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।

মুভ ফাউন্ডেশন সম্প্রতি ঢাকাসহ দেশের ১২টি জেলায় কওমি ও আলিয়া মাদরাসার শিক্ষার্থীদের সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার নিয়ে জরিপ চালায়। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা মনযূরুল হক বলেন, ‘পরীক্ষামূলক গবেষণায় সোশ্যাল মিডিয়া শিক্ষার্থীদের সাক্ষরতার অবস্থা দেখানো হয়েছে। এর মধ্যে কওমি ও আলিয়া উভয় ধরনের মাদরাসার ছাত্রছাত্রী রয়েছেন। অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের বয়স ১৬ থেকে ২২ বছরের মধ্যে, যারা মাধ্যমিক ও এর ওপরের স্তরে লেখাপড়া করছেন।’

মনযূরুল হক জানান, দেশের ১২টি জেলার (ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, রাজশাহী, সিলেট, হবিগঞ্জ, বরিশাল, ভোলা, গাইবান্ধা ও পঞ্চগড়) ৩৬টি মাদরাসার (২৩টি কওমি ও ১৩টি আলিয়া) ৮২৫ জন ছাত্রছাত্রীর অংশগ্রহণে মুভ ফাউন্ডেশন এই জরিপ চালিয়েছে। গবেষণার লক্ষ্য ছিল সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রবেশের মাধ্যম, দৈনিক ব্যবহারের মাত্রা, পছন্দের বিষয়, পোস্ট করা বা শেয়ার করার প্রবণতা, উগ্রবাদ ও সাইবার অপরাধ এবং এ সংক্রান্ত আইন বিধান বিষয়ে অংশগ্রহণকারীদের জ্ঞান সম্পর্কে ধারণা লাভ করা।

পরীক্ষামূলক গবেষণায় এসেছে, ৪২ শতাংশ কওমি ছাত্র এবং ৫৮ শতাংশ আলিয়া ছাত্রছাত্রী ইন্টারনেট সংযোগসহ মোবাইল বা ট্যাব ব্যবহার করেন। ৫ শতাংশ কওমি ছাত্র ও ১০ শতাংশ আলিয়া ছাত্রছাত্রী ইন্টারনেট সংযোগসহ কম্পিউটার ব্যবহার করেন।

ছাত্রীদের বেশিরভাগ রাতে ও মধ্যরাতের পরে, আর ছাত্রদের বেশিরভাগ সকালে ও দুপুরে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রবেশ করেন। ছাত্ররা দৈনিক সর্বোচ্চ ০-৩০ মিনিট করে এতে সময় কাটান, আর ছাত্রীরা ব্যয় করেন দৈনিক ১-২ ঘণ্টা সময়।

কওমি মাদরাসার আলেমরা বলছেন, আনুষ্ঠানিকভাবে মাদরাসার ছাত্রাবাসে মোবাইল ফোন ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আছে। সেক্ষেত্রে সাধারণ ফোন ব্যবহারের জন্য সুনির্দিষ্ট সময়সীমা থাকলেও স্মার্ট ফোন ব্যবহারের কোনও সুযোগ নেই।

এ বিষয়ে কথা হয় রাজধানীর লালবাগের জামিয়া ইসলামিয়া ইসলামবাগ মাদরাসার মুহতামিম মাওলানা মুঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমাদের মাদরাসায় ফোন ব্যবহার নিষিদ্ধ। ছাত্রাবাসে অ্যান্ড্রয়েড, স্মার্ট ফোন ব্যবহারের অনুমতি নেই। ছাত্রদের পড়াশোনা ও পরিবেশের জন্য এটা ক্ষতিকর। পুরো কওমি মাদরাসায় এর ব্যবহার ছাত্রদের জন্য নিষিদ্ধ। যারা ব্যবহার করেন, তারা হয়তো বাসায় গিয়ে, বা ছুটিতে গিয়ে ব্যবহার করেন।’

মাওলানা মুঞ্জুরুল ইসলাম আফেন্দী আরও বলেন, ‘সীমিত পরিসরে অনুমতি দেওয়ার চিন্তা করলেও অপব্যবহার হয়। ভালো ছাত্রদের পড়ালেখায় মনোযোগ থাকে না, সে কারণেই কওমি মাদরাসায় ছাত্রদের জন্য ফোন ব্যবহার নিষিদ্ধ।’

কওমি শিক্ষার্থীদের অনেকে বলছেন, স্মার্ট ফোন ব্যবহারের ক্ষেত্রে গোপনীয়তা অবলম্বন করতে হয় ছাত্রছাত্রীদের। তবে শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটি থাকায় এবং প্রতিদিন আসরের নামাজের পর বিরতি থাকায় ওই সময়টিতেই নানা উপায়ে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করেন ছাত্ররা। যাত্রাবাড়ী মাদরাসার একজন শিক্ষার্থী জানান, ‘মাদরাসায় মোবাইল ফোন ব্যবহারের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তবে কোনও-কোনও ছাত্র হয়তো বিশেষ গোপনীয়তার সঙ্গে ব্যবহার করে। অনেকে আবার শাস্তির মুখোমুখি হন ধরা পড়লে। তবে আমি এক সপ্তাহ বা দুই সপ্তাহ পর বাসায় গিয়ে ফোন চালাই। ফেসবুকে আমার আইডি আছে।’

মুভের পরীক্ষামূলক গবেষণার সারসংক্ষেপে বলা হয়েছে, উত্তরদাতার মধ্যে ৭৫ শতাংশ বাড়িতে বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যম ব্যবহারের সুযোগ পান (৬৩ শতাংশ মোবাইল বা ট্যাব এবং ১২ শতাংশ কম্পিউটার ব্যবহার করেন)। মাত্র ৫ শতাংশ ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারে (ইউডিসি) যান বা এ সম্পর্কে অবগত। বাকিরা সাইবার ক্যাফে (৫ শতাংশ), বন্ধু বা আত্মীয়ের ফোন বা কম্পিউটারের ওপর নির্ভরশীল।

ইন্টারনেট সংযোগ ব্যবহারের ক্ষেত্রে ৪২ শতাংশ কওমি মাদরাসার ছাত্র এবং ৫৮ শতাংশ আলিয়ার ছাত্রছাত্রী মোবাইল ফোনে এবং ৫ শতাংশ কওমিছাত্র ও ১০ শতাংশ আলিয়া ছাত্রছাত্রী কম্পিউটারে নেট ব্যবহার করেন। জরিপে অংশগ্রহণকারী কওমিছাত্রীদের কেউ কম্পিউটার ব্যবহার করার সুযোগ পান না, যদিও তাদের শতকরা ৭০ ভাগ মোবাইল বা ট্যাব ব্যবহার করে থাকেন। এর মধ্যে মাত্র ১ দশমিক ৪ শতাংশ কওমিছাত্রীর ইন্টারনেট সংযোগ আছে।

এই জরিপে অংশগ্রহণকারীদের বেশিরভাগ শিক্ষার্থী (৬৫ শতাংশ) কৌতূহল বা জানার আগ্রহ থেকে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করেন; অন্য কোনও উদ্দেশ্যে, বিতর্ক তৈরি বা প্রশ্ন তোলার জন্য নয়। দুই-তৃতীয়াংশের বেশি (৬৭ শতাংশ) ধর্মীয় শিক্ষা বা ধর্ম সংক্রান্ত পোস্ট বা আধেয় দেখেন, ১১ শতাংশ বিনোদন, ১৫ শতাংশ খেলাধুলা এবং ৭ শতাংশ রাজনৈতিক বিষয়গুলো লক্ষ করেন।

এতে বলা হয়, ‘কওমি ছাত্রীদের সবচেয়ে বেশি আগ্রহ ধর্মীয় শিক্ষামূলক বিষয়ে (৯৬ শতাংশ), পক্ষান্তরে কওমি ছাত্র ও আলিয়া শিক্ষার্থীদের বেশি আগ্রহ ধর্ম সংক্রান্ত বিষয়ে (যথাক্রমে ৬৬ শতাংশ ও ৫৩ শতাংশ)। শিক্ষার্থীরা সর্বাধিক শেয়ার করে ধর্মীয় শিক্ষামূলক বা ধর্ম সংক্রান্ত বিষয়াবলি (৭০ শতাংশ)। এরপর সামাজিক বিষয় (১৫ শতাংশ); খেলাধুলা ও বিনোদন (১০ শতাংশ) এবং রাজনৈতিক (৫ শতাংশ) বিষয়াবলি শেয়ার করেন।

জরিপে এসেছে, কওমিছাত্ররা ধর্ম সংক্রান্ত বিষয়াবলি (৬০ শতাংশ); কওমিছাত্রীরা ধর্মীয় শিক্ষামূলক (৫০ শতাংশ) এবং সামাজিক বিষয় সংক্রান্ত পোস্ট (৫০ শতাংশ) বেশি শেয়ার করেন। অন্যদিকে, আলিয়ার ছাত্রছাত্রীরা বেশি শেয়ার করেন ধর্মীয় শিক্ষামূলক বিষয় (৫৯ শতাংশ), তারপর ধর্ম সংক্রান্ত বিষয় (২০ শতাংশ), সামাজিক বিষয় (১৭ শতাংশ), বিনোদন ও খেলাধুলা (১৫ শতাংশ) এবং রাজনৈতিক বিষয় (৭ শতাংশ)।

মুভের পরীক্ষামূলক জরিপে এসেছে, পোস্ট শেয়ারের উৎস হিসেবে ছাত্রদের সবচেয়ে বেশি পছন্দ হচ্ছে বন্ধুদের পোস্ট (৩৯ শতাংশ) এবং ছাত্রীদের পছন্দ হচ্ছে তাদের আত্মীয়ের পোস্ট (৩১ শতাংশ)। উত্তরদাতাদের অনেকেই (৩৫ শতাংশ ছাত্র ও ২৯ শতাংশ ছাত্রী) বিষয়ভিত্তিক লেখক বা সেলিব্রেটিদের পোস্টও শেয়ার করেন। এছাড়া, উত্তরদাতা কওমি ছাত্রদের অর্ধেক ও 

ছাত্রীদের এক-তৃতীয়াংশ এবং আলিয়ার তিন-চতুর্থাংশ ছাত্রছাত্রী পোস্ট শেয়ারের আগে তথ্য যাচাই করার চেষ্টা করেন। কওমি ছাত্রদের ৭ শতাংশ একেবারেই যাচাই করেন না, ২১ শতাংশ মাঝে মধ্যে করেন। আর ২১ শতাংশ বিষয়টি নিয়ে ভাবেন, কিন্তু যাচাই করেন না। ৩৩ শতাংশ কওমিছাত্রী শেয়ার করার আগে কখনোই তথ্য যাচাই করেন না। ৩৩ শতাংশ যাচাইয়ের কথা ভাবেন বটে, কিন্তু করেন না।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় সাইবার অপরাধ। এ নিয়ে তৈরি হয়েছে পৃথক একটি আইনও। এই প্রসঙ্গে জরিপে বলা হয়েছে, ৬২ শতাংশ শিক্ষার্থী সাইবার অপরাধ পরিভাষাটির সঙ্গে মোটামুটি পরিচিত। বাকিরা অল্প শুনেছেন বা আদৌ শোনেননি।

এ প্রসঙ্গে সিলেটের বিয়ানীবাজার জামেয়া ইসলামিয়া আতহারুল উলুম আদিনাবাদ মাদরাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা রুহুল আমীন সাদী মনে করেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করতে তেমন কোনও বাধা নেই। তবে একে আসক্তির পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সঠিক হবে না। সে কারণেই তার মাদরাসায় ছাত্রদের জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে কিছু বিধিনিষেধ রয়েছে।

জানা গেছে, আগামী ৩০ জুন জরিপটি উপস্থাপন করা হবে। রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে মুভ ফাউন্ডেশনের গবেষণা ‘বাংলাদেশে মাদরাসা শিক্ষার্থীদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সাক্ষরতা’র ওপর সেমিনার হবে। সেখানে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা অংশগ্রহণ করবেন।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
পরীক্ষার নাম এসএসসিই থাকবে, ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ - dainik shiksha পরীক্ষার নাম এসএসসিই থাকবে, ওয়েটেজ ৫০ শতাংশ ফরেনসিক অডিটে ফাঁসছেন দশ হাজার জাল সনদধারী - dainik shiksha ফরেনসিক অডিটে ফাঁসছেন দশ হাজার জাল সনদধারী কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পিএইচডি ফেলোশিপ - dainik shiksha প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের পিএইচডি ফেলোশিপ সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি - dainik shiksha সাংবাদিকদের ঘুষ বিষয়ক ভাইরাল ভিডিও, ইরাব কোনো বিবৃতি দেয়নি জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন - dainik shiksha জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন কলেজ পরিচালনা পর্ষদ থেকে ঘুষে অভিযুক্ত সাংবাদিককে বাদ দেওয়ার দাবি - dainik shiksha কলেজ পরিচালনা পর্ষদ থেকে ঘুষে অভিযুক্ত সাংবাদিককে বাদ দেওয়ার দাবি পছন্দের স্কুলে বদলির জন্য ‘ভুয়া’ বিবাহবিচ্ছেদ - dainik shiksha পছন্দের স্কুলে বদলির জন্য ‘ভুয়া’ বিবাহবিচ্ছেদ জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন - dainik shiksha জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা - dainik shiksha হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা সনদ বাণিজ্য : কারিগরি শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রী কারাগারে - dainik shiksha সনদ বাণিজ্য : কারিগরি শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রী কারাগারে সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা - dainik shiksha সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0029690265655518