দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নিজস্ব ক্যাম্পাসে স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণের আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে। যদিও এ আইন মানছে না বেসরকারি অনেক বিশ্ববিদ্যালয়। অন্যদিকে ইউজিসির চাপে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান স্থায়ী ক্যাম্পাস গড়ে তুললেও, সেখানে পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা কার্যক্রম স্থানান্তর করছে না। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্থায়ী ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক কার্যক্রম চলছে বছরের পর বছর। আজ শনিবার (৯ ফেব্রুয়ারি) দৈনিক বণিক বার্তায় প্রকাশিত অস্থায়ী ক্যাম্পাসনির্ভর বেসরকারি এসব বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে চার পর্বের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের প্রথম পর্ব থেকে এ তথ্য জানান যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন সাইফ সুজন।
দেশে বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে শিক্ষার্থী সংখ্যায় অন্যতম ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি। আশুলিয়ায় প্রায় ৬০ একর জায়গা নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টির স্থায়ী ক্যাম্পাস। সেখানে নির্মাণ করা হয়েছে বেশ কয়েকটি বহুতল ভবন। বিশাল আয়তনের দৃষ্টিনন্দন স্থায়ী ক্যাম্পাস গড়ে তোলা হলেও প্রতিষ্ঠানটির বেশির ভাগ কার্যক্রমই শহরের অস্থায়ী ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক। বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭৫ শতাংশ শিক্ষার্থীই এখনো অস্থায়ী ক্যাম্পাসে ক্লাস-পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সর্বমোট শিক্ষার্থী সংখ্যা ২০ হাজারেরও বেশি। এর মধ্যে স্থায়ী ক্যাম্পাসে ভর্তিকৃত শিক্ষার্থী পাঁচ হাজারের কিছু বেশি। বাকি শিক্ষার্থীরা ক্লাস করছেন শহরের অস্থায়ী ক্যাম্পাসে। সে হিসাবে বিশ্ববিদ্যালয়টির ৭৫ শতাংশ শিক্ষার্থীই এখনো অস্থায়ী ক্যাম্পাসে।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্থায়ী ক্যাম্পাসে স্থানান্তর প্রক্রিয়ার অগ্রগতি নিয়ে গত বছর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি প্রতিবেদন পাঠায় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি)। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৭টি বিশ্ববিদ্যালয়কে স্থায়ী ক্যাম্পাসে স্থানান্তরের চিঠি দেয়া হয়। নির্দিষ্ট কিছু প্রোগ্রাম স্থানান্তরের জন্য বলা হয় ১৭টি বিশ্ববিদ্যালয়কে। এছাড়া দুটি বিশ্ববিদ্যালয়কে আউটার ক্যাম্পাস বন্ধ করতে ও একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে স্থায়ী ক্যাম্পাসের জন্য জমি কিনতে নির্দেশনা দেয়া হয়। প্রতিবেদনে ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয় বিষয়ে বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়টির স্থায়ী ক্যাম্পাস থাকা সত্ত্বেও স্থানান্তর প্রক্রিয়ায় আগ্রহ নেই।
ড্যাফোডিলের অস্থায়ী ক্যাম্পাসে এখনো শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয় বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়টির রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. একেএম ফজলুল হক। তিনি বলেন, শিক্ষা কার্যক্রম স্থানান্তরের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এরই মধ্যে বিভিন্ন বিভাগ স্থায়ী ক্যাম্পাসে শিফট করা হয়েছে। আমাদের ল্যাব ক্লাসগুলো স্থায়ী ক্যাম্পাসে করানো হচ্ছে। ক্রমান্বয়ে আমাদের পূর্ণাঙ্গ কার্যক্রম স্থায়ী ক্যাম্পাসে নিয়ে যাওয়া হবে।
একদিকে আইনি বাধ্যবাধকতা, অন্যদিকে ইউজিসি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের চাপে বেশকিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এর মধ্যে দৃষ্টিনন্দন স্থায়ী ক্যাম্পাস গড়ে তুলেছে। স্থায়ী ক্যাম্পাস করতে বাধ্য হয়েছে ড্যাফোডিলও। ২০১৩ সালের জানুয়ারিতে আশুলিয়ায় গড়ে তোলা স্থায়ী ক্যাম্পাসটি উদ্বোধন করে বিশ্ববিদ্যালয়টি। কিন্তু শতকোটি টাকা ব্যয়ে প্রতিষ্ঠিত এ ক্যাম্পাসে পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা কার্যক্রম স্থানান্তর করা হচ্ছে না। এটি ব্যবহূত হচ্ছে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী, সমাবর্তনের মতো বিভিন্ন উদযাপনের স্পট হিসেবে।
স্থায়ী ক্যাম্পাস গুরুত্ব না পাওয়ার বিষয়টি আরো স্পষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়টির ওয়েবসাইটে। ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে মূল ক্যাম্পাস হিসেবে ঠিকানা রয়েছে সোবহানবাগে অবস্থিত অস্থায়ী ক্যাম্পাসের।
স্থায়ী ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থী কম থাকার বিষয়টি স্বীকার করে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ডিন (স্থায়ী ক্যাম্পাস) অধ্যাপক ড. মোস্তফা কামাল বলেন, ‘আমাদের স্থায়ী ক্যাম্পাসে ভর্তিকৃত শিক্ষার্থী সংখ্যা পাঁচ হাজার। আর শহরের ক্যাম্পাসে ১৫ হাজার শিক্ষার্থী রয়েছে। আমরা চাই, শিক্ষার্থীরা স্থায়ী ক্যাম্পাসে ভর্তি হোক। কিন্তু ভর্তিচ্ছুরা শহরের বাইরে যেতে চায় না। তাদের অভিভাবকরাও চান না সন্তান শহরের বাইরে গিয়ে ক্লাস করুক। এজন্যই ধানমন্ডিতে ভর্তি নেয়া হচ্ছে এখনো। তবে শিক্ষার্থীরা শহরের অস্থায়ী ক্যাম্পাসে ক্লাস করলেও ল্যাবের কাজে অংশ নিতে স্থায়ী ক্যাম্পাসে যায়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের যানবাহনের ব্যবস্থা করেছে। অস্থায়ী ক্যাম্পাসের তুলনায় স্থায়ী ক্যাম্পাসে সুযোগ-সুবিধা অবশ্যই বেশি। আমরা ক্রমান্বয়ে শিক্ষার্থীদের স্থায়ী ক্যাম্পাসমুখী করার চেষ্টা করছি। পাশাপাশি এখন যত শিক্ষক নিয়োগ হচ্ছে—সবই স্থায়ী ক্যাম্পাসে।’
এদিকে শিক্ষার্থীরা বলছেন, স্থায়ী ক্যাম্পাস অনেক গোছানো। তবে শহর থেকে অনেক দূরে হওয়ায় আসা-যাওয়ার ক্ষেত্রে বেশি সময়ের প্রয়োজন হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে জার্নালিজম অ্যান্ড মাস কমিউনিকেশন বিভাগের এক ছাত্র বলেন, ‘আমি ধানমন্ডি ক্যাম্পাসে ভর্তি হয়েছি। সেখানেই ক্লাস-পরীক্ষা হচ্ছে। স্থায়ী ক্যাম্পাসে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যাওয়া লাগে। এছাড়া একাডেমিক ও প্রশাসনিক—সব কাজই ধানমন্ডি ক্যাম্পাসে। স্থায়ী ক্যাম্পাসে ক্লাস কিংবা পরীক্ষা—এসব বিষয়ে কোনো নির্দেশনা দেয়া হয়নি।’
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এখনো অস্থায়ী ক্যাম্পাস-নির্ভরতার বিষয়ে জানতে চাইলে ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান বলেন, বেশকিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণ করে চিঠি দিয়ে আমাদের তা জানিয়েছে। পরে খোঁজ নিয়ে দেখলাম, স্থায়ী ক্যাম্পাস করেছে ঠিকই, তবে এসব ক্যাম্পাসে পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা কার্যক্রম স্থানান্তর করা হয়নি। কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থায়ী ক্যাম্পাসে গিয়েছি আমি। সেখানে গিয়ে দেখলাম, বিশাল জায়গা নিয়ে মনোরম পরিবেশে ক্যাম্পাস করা হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখনো এসব ক্যাম্পাসে না গিয়ে শহরের অলিগলিতে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। আবার ব্যতিক্রমও রয়েছে। যেমন ইউআইইউ আইন মেনে স্থায়ী ক্যাম্পাসে চলে গেছে, আগের ক্যাম্পাসে এখন মার্কেট করা হচ্ছে।
ইউজিসি চেয়ারম্যান আরো বলেন, অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আশঙ্কা, স্থায়ী ক্যাম্পাসে গেলে শিক্ষার্থী হারাতে হবে। আমি তাদের বলেছি, আজ হোক, কাল হোক স্থায়ী ক্যাম্পাসে তো যেতেই হবে। যত আগে স্থানান্তর করা হবে, তত তাড়াতাড়ি গুছিয়ে নেয়া সম্ভব হবে। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদেরও স্থায়ী ক্যাম্পাসমুখী করা যাবে।