৮৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান : ৭৭ লাখ কোটি টাকা বিনিয়োগের টার্গেট

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রাণচাঞ্চল্য বহুদিন ধরেই। ছয় শতাংশের ওপর প্রবৃদ্ধি অর্জিত হচ্ছে গত টানা নয় বছর ধরে। এর মধ্যে আবার গত চার বছর ধরে সাত শতাংশের ওপর প্রবৃদ্ধি অর্জিত হচ্ছে। আর গত অর্থবছরে এই প্রবৃদ্ধির হার সাতের বৃত্ত ভেঙ্গে আটে উঠে এসেছে। সময়ের সঙ্গে বেড়েছে অর্থনীতির আয়তন। বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন ১১ লাখ কোটি টাকাকেও ছাড়িয়ে গেছে। সেই সঙ্গে অবকাঠামো উন্নয়ন আর মাথাপিছু আয় বাড়ায় উন্নত হয়েছে জীবনযাত্রার মান। এমন বাস্তবতা সামনে রেখেই সরকার প্রণয়ন করছে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা। এই পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য হচ্ছে তিনটি। এগুলো হলো- বিনিয়োগ আকর্ষণ, মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি। এছাড়া সবার সমান সুবিধা নিশ্চিত করতে সাম্য ও সমতা এবং জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব মোকাবেলা করাও ৮ম পরিকল্পনার অন্যতম লক্ষ্য। শনিবার (১৪ মার্চ) জনকণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানা যায়। প্রতিবেদনটি লিখেছেন কাওসার রহমান ।

প্রতিবেদনে আরও জানা যায়, পাঁচ বছর মেয়াদী এই বাস্তবধর্মী পরিকল্পনায় মোট ৭৭ লাখ কোটি টাকা বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এর মধ্যে চার ভাগের তিন ভাগই আসবে বেসরকারী খাত থেকে। আর এক ভাগের জোগান দেবে সরকার।

আগামী পাঁচ বছরে এমন বেসরকারী বিনিয়োগ টানার বড় লক্ষ্য নিয়েই মাঠে নামছে সরকার। এই বিনিয়োগ আকর্ষণের মূল ভরসা হবে চলমান ১০০ অর্থনৈতিক জোন। আর এই বিনিয়োগের ওপর ভর করেই সরকার মেয়াদ শেষে ২০২৪-২৫ সালে বেসরকারী বিনিয়োগের পরিমাণ নিয়ে যেতে চায় জিডিপির ২৮.২০ শতাংশে। যার ওপর ভর করে সরকার দেশের ভেতরেই পাঁচ বছরে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে চায় ৮৫ লাখ মানুষের।

অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সময়েই বাংলাদেশ বের হয়ে যাবে স্বল্পোন্নত দেশের গ-ি থেকে। ফলে, বহু বাণিজ্যিক সুবিধা যেমন হারাতে হবে আন্তর্জাতিক বাজারে, তেমনই খুলে যাবে নতুন সম্ভাবনার দ্বার। এমন আকাক্সক্ষা থেকেই ২০২০-২১ থেকে পরের পাঁচ অর্থবছর গড়ে ৮ দশমিক ৩৪ শতাংশ হারে গড় প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে চায় সরকার। আর পরিকল্পনার শেষ বছরে দেশের আর্থিক প্রবৃদ্ধির হার নিয়ে যেতে চায় ৮.৫ শতাংশে।

সরকারী বিনিয়োগের চাহিদা পূরণ করতে সরকার আগামী পাঁচ বছরে অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আহরণের দিকে বেশি মনোযোগ দিতে চায়। এ লক্ষ্যে অষ্টম পরিকল্পনার শেষ বছরে সরকার রাজস্ব আয়কে নিতে চায় জিডিপির সোয়া ১৬ শতাংশে। এজন্য সরকার আস্থা রাখছে কর প্রশাসন সংস্কারের ওপর। এই আয়ে ভর করেই সরকার উন্নত করতে চায় বণ্টন ব্যবস্থা। যাতে, ২০২৪-২৫ সালে পরিকল্পনার শেষ বছরে দেশের গরিব মানুষের হার নেমে আসতে পারে সাড়ে এগারো শতাংশে। বর্তমানে যা সাড়ে ২০ শতাংশ। আর চরম দারিদ্র্য নামিয়ে আনতে চায় পাঁচ শতাংশের নিচে।

আগামী ২০৪০ সালে দেশকে উন্নত দেশের কাতারে নিয়ে যাওয়ার অভিলাষ থেকেই সরকার প্রণয়ন করছে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা। আর ওই অভিলাষে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার পাঁচ বছরকে সরকার বাংলাদেশকে উন্নত দেশে নিয়ে যাওয়ার ভিত্তি হিসেবে গণ্য করতে চায়।

তবে অষ্টম পরিকল্পনায় মূল দৃষ্টি থাকছে গ্রামের দিকে। সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারের ‘আমার গ্রাম, আমার শহর’-এর অঙ্গীকার অনুযায়ী ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে গ্রামীণ রূপান্তরকে। অর্থাৎ শহরের সুবিধা পৌঁছানোর মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতির বৈচিত্রায়ন করা হবে।

আধুনিক পরিবহন ও তথ্যপ্রযুক্তি সেবা গ্রাম এবং নগরের মধ্যে ব্যবধান কমাতে সাহায্য করছে। রূপান্তরের এই গতি আরও ত্বরান্বিত করার পাশাপাশি টেকসই করা হবে ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে। বৈচিত্র্যের মাধ্যমে কৃষির উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর ওপর জোর দেয়া হবে। জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও নগরায়ণের কারণে জমির পরিমাণ ক্রমাগত কমে যাচ্ছে। তাই গবেষণা, সম্প্রসারণ ও কৃষি খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে ভূমির উৎপাদনশীলতার ওপর আরও গুরুত্ব দেয়া দরকার। এছাড়া খামারভিত্তিক বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য বেশি দামের পণ্য উৎপাদনের ওপরও জোর দেয়া হবে।

মধ্য মেয়াদে অর্থনীতির কাঠামো, গতিপ্রকৃতি এবং সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য সরকার পাঁচ বছর মেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করে থাকে। স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত সাতটি পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করছে। ২০১৫-১৬ থেকে বাস্তবায়ন শুরু হওয়া চলতি সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা শেষ হচ্ছে চলতি অর্থবছরে। অর্থাৎ আগামী ৩০ জুন। অবশ্য তার আগেই সরকার নতুন পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়নের কাজ শেষ করতে চায় পরিকল্পনা কমিশন। কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ এখন অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত। যার বাস্তবায়ন শুরু হবে ২০২০-২১ অর্থবছর থেকে এবং শেষ হবে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে।

পরিকল্পনা প্রণেতারা বলছেন, রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই প্রণয়ন করা হচ্ছে নতুন অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা। এক্ষেত্রে বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি। ফলে পাঁচ বছরে গড়ে ৮.৩৪ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্য নির্ধারণ করলেও পরিকল্পনার শেষ বছরে সরকার এই আর্থিক বৃদ্ধি ৮.৫ শতাংশ স্থিতিশীল রাখতে চাইছে। বিদ্যমান সামষ্টিক অর্থনৈতিক কাঠামো বিবেচনায় রেখেই পাঁচ বছরের আর্থিক বৃদ্ধির হার প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রথম বছর ২০২০-২১ সালে প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৮.২ শতাংশ। দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষ তথা ২০২১-২২ ও ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৮.৩ শতাংশ। চতুর্থ অর্থবছর ২০২৩-২৪ সালে আর্থিক বৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৮.৪ শতাংশ এবং পরিকল্পনার শেষ অর্থবছর ২০২৪-২৫ সালে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৮.৫ শতাংশ।

অর্থনৈতিক বাস্তবতা প্রসঙ্গে প্রণেতারা বলছেন, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দায় দেশের অভ্যন্তরীণ সূচকগুলো এখন দূরবস্থায়। এই বাস্তবতাকে বিবেচনায় রেখেই উচ্চাভিলাসের পরিবর্তে বাস্তবধর্মী সব লক্ষ্য নির্ধারণ করা হচ্ছে নতুন পরিকল্পনায়।

দেশের অভ্যন্তরে গ্যাসের স্বল্পতার কথা বিবেচনা করে গ্যাস অনুসন্ধানে বড় কোন পরিকল্পনায় না নিয়ে আমদানির মাধ্যমেই জ্বালানি চাহিদা পূরণের দিকে নজর দেয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে ২০২৫ সাল পর্যন্ত জ্বালানি খাতে মোট খরচের চিন্তা ১৫ বিলিয়ন ডলার বা ১ লাখ ২৭ হাজার কোটি টাকা। যার জোগান আসবে সরকারী, বেসরকারী এবং বিদেশী বিনিয়োগের মাধ্যমে। কূপ খনন, সংস্কার এবং জরিপের পেছনে বরাদ্দের কথা বলা হয়েছে মাত্র ৭ হাজার কোটি টাকা। বাকিটা যাবে বিতরণ, সঞ্চালনসহ অন্যান্য খাতে। অর্থাৎ নিজস্ব অনুসন্ধানের বদলে বেশি মনোযোগ দেয়া হচ্ছে আমদানির অবকাঠামো তৈরি এবং ব্যবস্থাপনার দিকে।

এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য সিনিয়র সচিব ড. শামসুল আলম বলেন, ‘আমরা বাস্তবধর্মী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে অষ্টম পরিকল্পনা প্রণয়ন করছি। যাতে আমরা এই পরিকল্পনা অর্জন করতে পারি। স্থানীয় ও বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়েই আমরা জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছি। বিনিয়োগে আস্থা অর্জন সম্ভব হলে আর্থিক বৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রাকে ছাড়িয়ে যাবে বলে তিনি মনে করেন।

তিনি বলেন, বিশ্ব অর্থনীতির বর্তমান বাস্তবতা হলো চীন ও ভারতের মতো বড় অর্থনীতি দুর্বল পারফর্মেন্স করছে। আবার চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য যুদ্ধ আমাদের অর্থনীতিকে আঘাত করতে পারে। পরিকল্পনা প্রণয়নের ক্ষেত্রে এগুলোও বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে।

অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বেসরকারী বিনিয়োগের জন্য অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল উন্নয়ন-সহযোগীদের আগের মতোই পাশে চেয়েছেন। পাশাপাশি ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগের জন্য তিনি বিদেশী বিনিয়োগকারীদের প্রতিও আহ্বান জানিয়েছেন।

সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার সব লক্ষ্য অর্জন করতে না পারলেও বড় সাফল্য এসেছে আর্থিক প্রবৃদ্ধিতে ॥ যদিও বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান ও রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য অর্জনের ব্যর্থতা রূপ নিয়েছে নতুন মাত্রায়। তারপরও রেকর্ড জিপিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন বাংলাদেশের অর্থনীতির অগ্রযাত্রা আরও উজ্জ্বল করেছে। গত টানা চার বছর ধরেই জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হচ্ছে সাত শতাংশের ওপর। এর মধ্যে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রেকর্ড ৮.১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। আর সবমিলিয়ে গত টানা নয় বছর ধরেই ৬ শতাংশের ওপর জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হচ্ছে। অন্যদিকে, চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে আর্থিক বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৮.২০ শতাংশ। চলতি বাজার মূল্যে এ বছর দেশের জিডিপি দাঁড়াবে ৩৪৭.৭ বিলিয়ন ডলার। যা গত অর্থবছরে (২০১৮-১৯) ছিল ৩০১. ৯ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ ২৫ লাখ কোটি টাকারও বেশি দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। যদিও স্থির মূল্যে অর্থনীতির এই আকার ১১ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। আর্থিক ব্যবস্থাপনা ও সুশাসন নিশ্চিত করা গেলে অর্থনীতির চিত্র আরও চমকপ্রদ হতে পারত তা বলাই বাহুল্য।

সপ্তম পরিকল্পনায় সরকারের বড় সাফল্য প্রবৃদ্ধির রেকর্ড। কারণ, সর্বশেষ চার অর্থবছরে ৭ দশমিক ৩ গড় লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে অর্জিত হয়েছে ৭ দশমিক ৬। সর্বশেষ অর্থবছরে যা ছাড়িয়েছে সর্বকালের রেকর্ড। যদিও প্রবৃদ্ধির এই অর্জনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না অন্য সূচকগুলো। ফলে এর স্থায়িত্ব এবং মান নিয়ে প্রশ্ন বহুদিনের।

টানা কয়েক বছরের প্রবৃদ্ধির সাফল্যকে মলিন করেছে বেসরকারী বিনিয়োগ। কারণ, চলতি অর্থবছরে এই হার জিডিপির ২৬ দশমিক ৬ শতাংশে নেয়ার কথা থাকলেও, ২০১৮-১৯ পর্যন্ত অর্জন সাড়ে তেইশের নিচে। এছাড়া, রাজস্ব আয়ের অবস্থা আরও ভয়াবহ। শেষ বছরে জিডিপির ১৬ শতাংশের ওপরে এই আয় নেয়ার লক্ষ্য থাকলেও, রয়ে গেছে ১০ শতাংশের নিচে। লক্ষ্য অর্জিত হয়নি রফতানি আয়েও। আর্থিক খাত, ব্যবসায় পরিবেশ এবং সুশাসন ইস্যুতেও খুব বেশি সাফল্য আসেনি এই সময়ে।

বৈষম্য কমিয়ে সুষম উন্নয়নের অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করার কথা ছিল সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়। কিন্তু সেখানেও সাফল্য প্রায় শূন্য।

সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার অর্জন প্রসঙ্গে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য সিনিয়র সচিব শামসুল আলম বলেন, ব্যবস্থাপনা যদি কাক্সিক্ষত পর্যায়ে যেত, বেসরকারী বিনিয়োগ আরও বেশি হতো তাহলে প্রবৃদ্ধি আরও বেশি পেতাম। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছিল কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, দেশের বিনিয়োগকারীদের আস্থা আমরা পেয়েছি। সেই আস্থাশীলতার বিষয়ে আমাদের অর্থনৈতিক সুশাসনকে এখন অনেক বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।

গত পাঁচ দশকে পরিকল্পনা তৈরির ক্ষেত্রে যতটা দক্ষতা দেখাতে পেরেছে বাংলাদেশ ততটা দেখাতে পারেনি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে। ফলে প্রায় প্রতি ক্ষেত্রেই শেষ দিকে এসে হোঁচট খেতে হচ্ছে। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বেরসকারী খাতের বিনিয়োগ বার বার উচ্চ স্তরে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য নিয়েও অর্জিত হয়নি। চলমান সপ্তম পরিকল্পনার পাঁচ বছরে ১ শতাংশও বাড়েনি জিডিপির অনুপাতে বেসরকারী খাতের বিনিয়োগ। বর্তমানে বেসরকারী বিনিয়োগ জিডিপির অনুপাতে ২৩ শতাংশ হলেও, আগামী পাঁচ বছরে নেয়ার পরিকল্পনা সোয়া ২৮ শতাংশে। যদিও সরকারের এ বিনিয়োগ টানার অন্যতম উৎস এক শ’ অর্থনৈতিক জোন, তারপরও বিদ্যমান বাস্তবতায়, ২০২০-২১ থেকে পরের পাঁচ অর্থবছরের জন্য বেসরকারী বিনিয়োগ এই অসম্ভব উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার এই পরিকল্পনাকে উচ্চাভিলাষীই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

বেসরকারী বিনিয়োগ ছাড়াও, বিদেশী বিনিয়োগ এবং রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যও বড়। দুরবস্থা সম্পদ আহরণ এবং বণ্টনেও। নতুন আইন প্রয়োগেও বাড়েনি রাজস্ব আদায়। উল্টো কমে গেছে রাজস্ব আয়ের প্রবৃদ্ধি। এমন অবস্থায়, জিডিপির ১০ শতাংশের নিচে থাকা এই আয়কে জিডিপির সোয়া ১৬ শতাংশে নিয়ে যাওয়া সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। আবার এই আয়ের ওপর ভর করেই সরকার বণ্টন ব্যবস্থা উন্নত করে ২০২৪-২৫ সালে পরিকল্পনার শেষ বছরে দেশের গরিব মানুষের হার নামিয়ে আনতে চায় সাড়ে এগারো শতাংশে। বর্তমানে যা সাড়ে ২০। আর চরম দারিদ্র্য নামিয়ে আনতে চায় পাঁচ শতাংশের নিচে।

এমন বাস্তবতায় হাতে নেয়া হচ্ছে পরের পাঁচ অর্থবছরের জন্য বাস্তবায়নযোগ্য অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, যার মধ্যে অসীম সম্ভাবনা যেমন লুকিয়ে আছে তেমনই থাকছে খানিকটা শঙ্কাও। শঙ্কাটা বাস্তবায়ন নিয়ে। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় প্রত্যাশিত অর্জন না হলেও অষ্টম পরিকল্পনায় রাখা বিলাসী সব লক্ষ্যমাত্রা প্রসঙ্গে বিশ্লেষকরা বলছেন, পরিকল্পনা, অর্থনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য থাকলেও বাস্তবায়নের জন্য নেয়া হয় না কার্যকর কোন উদ্যোগ। ফলে নতুন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে হোঁচট খাওয়ার শঙ্কা বরাবরের মতোই রয়ে যাচ্ছে।

তাদের মতে, এবারও নতুন পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা তৈরিতে খুব বেশি আমলে নেয়া হয়নি অর্থনীতির সাম্প্রতিক বাস্তবতাকে। কেবল কাগজ-কলমে সাফল্যের ধারাবাহিকতা মাথায় রেখে পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হচ্ছে। যা শেষ বিচারে গিয়ে সঙ্কটে ফেলতে পারে অর্থনীতিকে।

বড় প্রকল্প চলছে গোটা দশেক। যাতে খরচ হওয়ার পৌনে তিন লাখ কোটির সিংহভাগই আনতে হচ্ছে বাণিজ্যিক ঋণ হিসেবে। অথচ বাস্তবায়নে নেই প্রত্যাশিত গতি। ভোগাচ্ছে পণ্য মূল্যের বাড়তি দাম। মধ্যবিত্তের জীবনযাত্রা এখন আগের চেয়ে সঙ্কটে। মোটা দাগে এগুলোই অর্থনীতির বর্তমান বাস্তবতা। তাহলে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব কিভাবে?

এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, অভিলাষ-আকাক্সক্ষা উচ্চ পর্যায়ের। কিন্তু সংশ্লিষ্ট যে কার্যক্রম সেগুলো নিম্নমানের। এই জায়গাগুলো যদি আমরা দৃষ্টি না দেই তাহলে আমরা অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার যে ভিত্তি সে ভিত্তিটাকে আমরা সঠিকভাবে নিতে পারব না।

তিনি বলেন, প্রকৃতভাবে যদি আমরা আর্থিক বৃদ্ধিটাকে বাড়িয়ে টেকসইভাবে সাড়ে আটের মধ্যেও রাখতে পারি তাহলেও আমরা একটা বিরাট অর্জন করতে পারব।

বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, আমরা এখন যে পর্যায়ে আছি সেটায় কি আমাকে একটা টেকসই গ্রোথ দিতে পারবে, মনে হয় না।

সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজ বলেন, অর্থনীতি যত বড় হচ্ছে এটার ব্যবস্থাপনা তত বশি চ্যালেঞ্জিং হচ্ছে। ইতিবাচক ফলগুলো সুষ্ঠু এবং কার্যকর অর্থনীতি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অর্জন করার কথা ছিল। সে জায়গাটাতে আমাদের আরও কাজ করার একটা জায়গা দেখা দিয়েছে।

সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের যে টার্গেট ছিল বছর শেষে দেখা গেল আমাদের সেই টার্গেটের সঙ্গে বেশ কিছু জায়গায় বড় ধরনের বিচ্যুতি হচ্ছে। কেন এই বিচ্যুতি হচ্ছে সেটাকে চিহ্নিত করে তা সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, এসডিজি বাস্তবায়ন, এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন এবং মিডিল ইনকাম গ্র্যাজুয়েশন- এই চ্যালেঞ্জগুলোও বাংলাদেশ ভালভাবেই মোকাবেলা করতে পারবে।

তবে বিশ্লেষকদের যুক্তির সঙ্গে মোটেই একমত নন পরিকল্পনামন্ত্রী। পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, এটি একটি চলমান ব্যাপার। এটি দাঁড়িয়ে থেকে ঠিক করা যাবে না। আপনাকে দৌড়াতেও হবে আবার ব্যথাকে শণাক্ত করতে হবে। দাঁড়িয়ে গেলেই হেরে যেতে হবে। তিনি বলেন, যে সকল নিয়ম চলে আসছে তা প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে। অনেকেই রয়ে গেছে আমাদের চোখের আড়ালে।

এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, দেশে বেসরকারী বিনিয়োগ নিম্ন অবস্থানে রয়েছে। বিনিয়োগ আরও বাড়াতে হবে। আমরা ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি করছি। বিনিয়োগের জন্য এগুলোয় নানা সুবিধা দেয়া হচ্ছে। এই সুযোগ প্রহণ করা উচিত।

রাজস্ব আয় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের রাজস্ব আয় কম। কিন্তু যতটা কম বলা হয়, ততটাও কম নয়। বিশ্বের এমন কোন দেশ নেই, যেখানে বাংলাদেশের মতো শিল্পে এত কর ছাড়া দেয়া হয়। আগামীতে আমরা যেসব খাতে প্রণোদনা বা ছাড় দিচ্ছি, সেগুলোর একটা হিসাব করা হবে।

তিনি আরও বলেন, আমাদের সব সময় পরনির্ভরশীল হলে চলবে না। নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে হবে। স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হওয়ার পর কিছুটা চাপ তৈরি হলেও নিজেদেরই সামাল দিতে হবে। সবসময় গরিব থাকলে চলবে না। কিছু পেতে হলে কিছু দিতে হয়। গত ১০ বছরে প্রবৃদ্ধি অর্জনে বিশ্বের অনেক দেশের চেয়ে আমরা এগিয়ে রয়েছি। ২০২৪ সালে বাংলাদেশ সিঙ্গাপুর, হংকং ও মালেয়শিয়াসহ অনেক দেশকে ছাড়িয়ে যাবে।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
মুজিবনগর দিবসে সব স্কুল-কলেজে আলোচনা - dainik shiksha মুজিবনগর দিবসে সব স্কুল-কলেজে আলোচনা মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষক নিবন্ধন সনদের ফটোকপি পোড়ানো কেমন প্রতিবাদ! - dainik shiksha মেয়াদোত্তীর্ণ শিক্ষক নিবন্ধন সনদের ফটোকপি পোড়ানো কেমন প্রতিবাদ! স্কুলের অর্থ আত্মসাৎ, প্রধান শিক্ষক গ্রেফতার - dainik shiksha স্কুলের অর্থ আত্মসাৎ, প্রধান শিক্ষক গ্রেফতার শিক্ষা অধিদপ্তরে ডিজির রুটিন দায়িত্ব, জিয়া পরিষদ সদস্যদের পোয়াবারো! - dainik shiksha শিক্ষা অধিদপ্তরে ডিজির রুটিন দায়িত্ব, জিয়া পরিষদ সদস্যদের পোয়াবারো! জাল সনদে শিক্ষকের একযুগ চাকরির অভিযোগ - dainik shiksha জাল সনদে শিক্ষকের একযুগ চাকরির অভিযোগ ‘পুরো মুসলিম বিশ্ব ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা উদযাপন করবে’ - dainik shiksha ‘পুরো মুসলিম বিশ্ব ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা উদযাপন করবে’ কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0074021816253662