৮৫২ শিক্ষকের এমপিওভুক্তি: টার্গেট পঁচিশ কোটি টাকা

নিজস্ব প্রতিবেদক |

বেসরকারি ডিগ্রি কলেজের তৃতীয় শিক্ষক হিসেবে সারাদেশে কর্মরত মোট আটশ বায়ান্ন জনকে এমপিওভুক্ত করিয়ে কমবেশি পঁচিশ কোটি টাকার ঘুষ বাণিজ্যের টার্গেট করেছে একটি সিন্ডিকেট। কখানো এমপিওর দাবি না করা এবং কলেজের নিজস্ব তহবিল থেকে বেতন-ভাতা পাওয়ার শর্তে বেসরকারি ডিগ্রি কলেজে তৃতীয় শিক্ষক হিসেবে ২০১০ খ্রিষ্টাব্দের পর নিয়োগ পেয়েছেন তারা। প্রচলিত জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা অনুযায়ী তারা এমপিওভুক্ত হতে পারবেন না। তবুও তাদের কাছ থেকে কমবেশি ২৫ কোটি টাকা ঘুষ নেয়ার টার্গেট করেছে। কয়েক কোটি টাকা ইতিমধ্যে লেনদেন হয়েছে। এখন অপেক্ষা করছে, এমপিও নীতিমালা সংশোধন করে অথবা গোঁজামিল দিয়ে অথবা সময়সুযোগ মতো ঘুপচি পরিপত্র জারি করে, অথবা বড় কর্মকর্তাদের ভুল বুঝিয়ে অথবা এনটিআরসিএর সুপারিশে নিয়োগপ্রাপ্তদের সঙ্গে একলটে ঢুকিয়ে এমপিও দেয়ার ধান্দা করেছে এই সিন্ডিকেট।  

প্রচলিত বিধান অনুযায়ী ডিগ্রি কলেজে প্রথম দুইজন শিক্ষককে এমপিওভুক্ত করা হয়। জেনেশুনে এমপিও না পাওয়ার শর্তে ২০১০ খ্রিষ্টাব্দের পর বিভিন্ন সময়ে নিয়োগ পাওয়া শিক্ষকরা এমপিওর দাবি করে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে।  এই ৮৫২ জনের মধ্যে এনটিআরসিএর মনোনয়নে নিয়োগ পেয়েছেন ৭১ জন। এমপিও নীতিমালা সংশোধন না করে এই ৭১জনকে  মনোনয়ন দেয়ার পেছনে ঘুষ লেনদেন ও সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বদলি হয়ে অন্য মন্ত্রণালয়ে যাওয়া একজন অতিরিক্ত সচিবের অদক্ষতা ও অদূরদর্শীতার বিষয় রয়েছে।

সরাসরি পরিচালনা পর্ষদ কর্তৃক নিয়োগ পাওয়া ৭৭০ জনের মধ্যে কয়েকজন এমপিওর দাবিতে স্মারকলিপি দিয়েছেন কয়েকবার। মোট ৮৫২ জনের রয়েছে দুটি আলাদা সংগঠন।  এমপিওর দাবিতে গত বছর তারা আলাদা আবেদনও করেছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। সেই আবেদনের ওপর ভিত্তি করে মোট কত টাকা লাগবে,  এমপিও দেয়ার যৌক্তিকতা ইত্যাদি বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জানতে চেয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের কাছে। একটি কমিটিও করা হয়েছে।  কিন্তু এরই মধ্যে রাজশাহীসহ উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি কলেজের শিক্ষক শিক্ষা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা অধিদপ্তর ও জেলা শিক্ষা অফিসকেন্দ্রীক কয়েকজন কর্মকর্তা, কর্মচারী ও দালালদের সাথে যোগাযোগ শুরু করেছেন মর্মে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এই চক্রটি শিক্ষকের এমপিও পাইয়ে দেয়ার কথা বলে মাথাপিছু কমবেশি তিনলাখ টাকা তোলার টার্গেট করেছে। দুই/তিন কিস্তিতে টাকা দেবেন শিক্ষকরা।    

যেভাবে সিন্ডিকেট তৈরি: প্রথমে সাইফুল নামে সাতক্ষীরার একটি কলেজের একজন তৃতীয় শিক্ষকের নেতৃত্বে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব, একজন উপসচিব ও দুইজন প্রশাসনিক কর্মকর্তার সঙ্গে ফুল দিয়ে সৌজন্য সাক্ষাতের নামে দেখা করে ছবি তুলে তা নিজেদের ফেসবুক গ্রুপে দিয়ে দেয়া হয়েছে কয়েকমাস আগে। এরপর গত বছর মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরে যোগদেয়া দুইজন সহকারি পরিচালকের সঙ্গেও ফুলের তোড়া নিয়ে সৌজন্য সাক্ষাত করে ছবি তুলে তা নিজেদের ফেসবুক গ্রুপে দিয়ে দেন সাইফুল গং। আর সরকারি কলেজ থেকে হঠাৎ শিক্ষা অধিদপ্তরে পদায়ন পাওয়া এই দুই সহকারি পরিচালক আনন্দে গদগদ হয়ে ফুল গ্রহন করেন। মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরেরর কর্মকর্তাদের সাথে তোলা ছবি দেখিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলে থাকা তৃতীয় শিক্ষকদের কাছে এই মর্মে  বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করে যে, ‘কর্মকর্তাদের সঙ্গে শিক্ষক নেতাদের রয়েছে দারুন সখ্য। তাহলে বিশ্বাস করা যায় যে, ‘এই স্যারেরা একটু হেল্প করলেই এমপিও পাওয়া যাবে। তাহলে  এমপিওভু্ক্তির জন্য ঘুষের টাকা দেয়া যায়!’  উদাহরণ হিসেবে ২০১০ খ্রিষ্টাব্দের আগে নিয়োগ পাওয়া তৃতীয় শিক্ষকদের এমপিও দেয়ার কথা বলা হয়। বাস্তবে, ২০১০ খ্রিষ্টাব্দের আগের নিয়োগপ্রাপ্তদের এমপিওর বিষয়ে আদালতেরে নির্দেশ এবং এমপিওনীতিমালার দূর্বলতার কারণে কিছুটা ব্যাকফুটে ছিলো মন্ত্রণালয়। তাই আপিলে না গিয়ে কিছুটা মানবিক দৃষ্টিতে দেখে এমপিও দেয়া হয়। সরকার চাইলে আপিলে যেতে পারতেন। কিন্তু করেনি।

কিন্তু ২০১০ খ্রিষ্টাব্দের পর নিয়োগ পাওয়াদের কোনও যুক্তিই নেই বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একাধিক সৎ কর্মকর্তা দৈনিক শিক্ষাকে নিশ্চিত করেছেন। এই চক্রটি ধান্দা করছে বড় কর্তাদের ভুল বুঝিয়ে এমপিও দিয়ে দেয়ার। বড় কর্তাদের বলা হবে, এরা সবাই ২০১০ খ্রিষ্টাব্দের পরে নিয়োগপ্রাপ্ত, তাই সবাই বর্তমান সরকার সমর্থক ইত্যাদি ইত্যাদি। দৈনিক শিক্ষার অনুসন্ধানে জানা যায়, ঘুষ দিয়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাওয়া এবং এমপিওভুক্ত হওয়ার তালিকায় জামাত-শিবির ও বিএনপিপন্থীরা এগিয়ে থাকে। আওয়োমী লীগ ক্ষমতায় থাকলে ছাত্রলীগ ব্যাকগ্রাউন্ডের কেউ লাখ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে শিক্ষক হতে যেমন চান না তেমনি ঘুষ গ্রহীতারাও নিজ দলের কর্মীদের কাছ থেকে ঘুষ নিতে নিরাপদ বোধ করেন না।  

শিক্ষা অধিদপ্তরের আইন শাখার একজন কর্মকর্তা ও একজন কর্মচারী এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে যুক্ত বলে জানা যায়। আর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ‘ক’ আদ্যক্ষরের একজন উপসচিব ও শিক্ষা অধিদপ্তরের ‘ক’ আদ্যক্ষরের দুই সহকারি পরিচালক এই সিন্ডিকেটের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য বলে দৈনিক শিক্ষার অনুসন্ধানে জানা যায়। 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha শিক্ষায় বরাদ্দ বেড়েছে, আরো বাড়বে: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না - dainik shiksha সমাবর্তনের অজুহাতে সনদ আটকে রাখা যাবে না হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে স্কুলছাত্রীর মৃত্যু চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু - dainik shiksha চুয়েটে আন্দোলন স্থগিত, সড়কে যান চলাচল শুরু প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় - dainik shiksha প্রাথমিকের প্রশ্ন ফাঁসে অল্পদিনে কয়েকশ কোটি টাকা আয় রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট - dainik shiksha রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সংবিধানবিরোধী নয়: হাইকোর্ট কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0058858394622803