মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২ জন ছাত্র, ১ জন শিক্ষক ও ৩ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী শহীদ হয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রকৌশল দপ্তরের কর্মচারী শহীদ মোহাম্মদ হোসেনকে বীরপ্রতীক খেতাবে ভূষিত করা হয়।
৮ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ড. আজিজুর রহমান মল্লিকের সভাপতিত্বে বাণিজ্য বিভাগের শ্রেণিকক্ষে (চবি স্কুল) অনুষ্ঠিত সভায় ছাত্র-শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিয়ে গণিত বিভাগের অধ্যাপক মো. ফজলী হোসেন ও বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মাহবুব তালুকদারকে আহ্বায়ক করে 'চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদ' গঠন করা হয়।
পাকিস্তানিদের আক্রমণ প্রতিরোধে ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক ইনামুল হকের নেতৃত্বে অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ প্রদান ও পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ শামসুল হক, এখলাস উদ্দিন আহমদ ও মিছবাহ উদ্দিন আহমেদের উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয়ে মলোটভ ককটেল বনানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়।
৮ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের (চাকসু) জিএস আবদুর রব ভারতে সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য সবাইকে পৌঁছে দেয়ার কাজ শুরু করেন। ১০ মার্চ চাকসু ভিপি মোহাম্মদ ইবরাহিম ও জিএস আবদুর রব সশস্ত্র বাহিনীর বাঙালি সদস্যদেরকে অস্ত্র জমা না দেয়ার আহ্বান জানান।
১৭ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারিক শামসুল আলমের বাসভবনে আওয়ামী লীগ নেতা আতাউর রহমান খান কায়সার, আবু জাফর, ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন হারুন আহমেদ চৌধুরী, ক্যাপ্টেন অলি আহমদ ও ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান চৌধুরী পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ প্রতিরোধে পরিকল্পনা করতে বৈঠক করেন।
২৪ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র সমিতির আয়োজনে কেন্দ্রীয় মাঠে স্বাধীনতা সংগ্রামের সমর্থনে গণসঙ্গীত আয়োজন করা হয়। একইদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মল্লিকের নেতৃত্বে মিছিল মুসলিম ইনস্টিটিউট থেকে লালদিঘি মাঠে এসে শেষ হয়।
২৫ মার্চ রাতে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ শুরু হলে ২৬ মার্চ ভিসি ড. মল্লিক, অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান, ড. আনিসুজ্জামান ও রেজিস্ট্রার খলিলুর রহমান, চাকসু ভিপি-জিএসের উপস্থিতিতে সংগ্রাম পরিষদ সিদ্ধান্ত নেয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী, ইপিআর বাঙালি সেনা ও গ্রামবাসী মিলে ক্যাম্পাস ঘেরাও করে রাখবেন। সেদিনই পাকিস্তানি সেনারা ক্যাম্পাসে ঢুকতে চাইলে সংগ্রাম পরিষদ আলাওল হলে ঘাঁটি করে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যূহ তৈরি করে। ৫ এপ্রিল পর্যন্ত চলে পাকিস্তানি সেনাদের হামলা। একপর্যায়ে নিরস্ত্র সংগ্রাম পরিষদ পিছু হটে।
এরপর ৯ মাস চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘাঁটি গেড়েছিল পাকিস্তানি বাহিনী। ক্যাম্পাসে কনসেনট্রেশন ক্যাম্প স্থাপন করে তারা। ১৪ ডিসেম্বর জাফর ইমামের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিযান চালায়। ২৫ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পাকিস্তানি বাহিনীর দখলমুক্ত হয়।
মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল দপ্তরের চেইনম্যান বীরপ্রতীক মোহাম্মদ হোসেন, উপ-সহকারী প্রকৌশলী প্রভাস কুমার বড়ুয়া, দর্শন বিভাগের খণ্ডকালীন শিক্ষক অবনী মোহন দত্ত, চাকসুর সাধারণ সম্পাদক ইতিহাস বিভাগের ছাত্র আবদুর রব, বাংলা বিভাগের ছাত্র মনিরুল ইসলাম খোকা, মোহাম্মদ হোসেন ও মোস্তফা কামাল, অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র নাজিম উদ্দিন খান ও আবদুল মান্নান, ইতিহাস বিভাগের ছাত্র ফরহাদ উদ-দৌলা, বাণিজ্য অনুষদের ছাত্র খন্দকার এহসানুল হক আনসারি, ইংরেজি বিভাগের ছাত্র আশুতোষ চক্রবর্তী, সমাজতত্ত্ব বিভাগের ছাত্র ইফতেখার উদ্দিন মাহমুদ, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র আবুল মনসুর, গণিত বিভাগের ছাত্র ভুবন ও আলাওল হলের প্রহরী ছৈয়দ আহমদ শহীদ হন।
বীরপ্রতীক মোহাম্মদ হোসেন ছিলেন নৌকমান্ডো। ১৬ মে নিজ শরীরে লিমপেট মাইন বেঁধে কর্ণফুলী নদীতে পাকিস্তানি জাহাজ ধ্বংস করার অভিযানের সময় তিনি শহীদ হন।
মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগাযোগ ও সহায়তার অভিযোগে ৮ মে চবি শিক্ষক অবনী মোহন দত্তকে ধরে নিয়ে হত্যা করা হয়।
শহীদ ছাত্র খন্দকার এহসানুল হক আনসারি শহীদ জায়া মুশতারী শফির ভাই। ৭ এপ্রিল রাতে পাকিস্তান সেনা ও রাজাকাররা মুশতারী শফির স্বামী ডা. মোহাম্মদ শফি ও ভাই খন্দকার এহসানুল হক আনসারিকে ধরে নিয়ে যায়।
শহীদ ছাত্র আবদুর রব ১৩ এপ্রিল ভারতগামী একটি প্রশিক্ষণার্থী দলকে জিপে রামগড় পৌঁছে দেয়ার পথে চুয়েট এলাকায় পাকিস্তান সেনাদের হাতে ধরা পড়েন। তাকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়।
ইতিহাস বিভাগের ছাত্র শহীদ ফরহাদ উদ-দৌলা কক্সবাজারে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। ৫ মে পাকিস্তান সম্মুখযুদ্ধে আহত হয়ে মসজিদে আশ্রয় নিলে সেখান থেকে তাকে টেনে হিঁচড়ে বের করে বাঁকখালী নদীর তীরে গুলি করে হত্যা করা হয়। মরদেহ ভাসিয়ে দেয়া হয় নদীতে।
রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র শহীদ আবুল মনসুরকে তার বাসা থেকে তুলে নিয়ে ২৩ নভেম্বর আলবদর বাহিনী নির্মমভাবে হত্যা করে।
মুক্তিযুদ্ধ ও শহীদের স্মৃতি সংরক্ষণে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে দুটি স্মৃতিস্তম্ভ ও একটি ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে। ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে মুর্তজা বশীরের প্রচেষ্টায় স্থাপন করা হয় স্বাধীনতা ভাস্কর্য। একইবছর শিল্পী রশিদ চৌধুরীর নকশায় নির্মিত হয় বুদ্ধিজীবী স্মৃতিস্তম্ভ।
১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দে বুদ্ধিজীবী স্মৃতিস্তম্ভের বিপরীত পাশে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার স্থাপন করা হয়, এর স্থপতি অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল্লাহ খালেদ। ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে স্থাপিত হয় শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ ‘স্মরণ’। এর স্থপতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ সাইফুল কবীর।
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বীরপ্রতীক মোহাম্মদ হোসেনের গ্রামের বাড়ি হাটহাজারীর সফিনগর পশ্চিম ধলই গ্রামে তৈরি করা হয়েছে ‘স্মৃতি ভবন’। ক্যাম্পাসে চাকসুর সাধারণ সম্পাদক ইতিহাস বিভাগের ছাত্র শহীদ আবদুর রব স্মরণে একটি ছাত্র হলের নামকরণ করা হয়েছে।
শহীদ বীরপ্রতীক মোহাম্মদ হোসেন, শহীদ আবদুর রব, শহীদ ইফতেখার উদ্দিন মাহমুদ, শহীদ ফরহাদ উদ-দৌলা, শহীদ নাজিম উদ্দিন খান, শহীদ প্রভাস কুমার বড়ুয়া এবং শহীদ ছৈয়দ আহমদের স্মরণে ক্যাম্পাসে সড়কের নামকরণ করা হয়েছে। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে চালু করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কর্নার।