‘উপাচার্যের দল’

আব্দুল বায়েস |

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসিদের জন্য দলই হচ্ছে বড় বল। তা-ও গোপনে নয়, প্রকাশ্যে মহড়া দিয়ে দল।

বিশেষত ’৭৩ অধ্যাদেশ অধ্যুষিত বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য এ কথাটা অধিকতর প্রযোজ্য। এর প্রধান কারণ হচ্ছে গণতন্ত্র তথা বাক্স্বাধীনতা। দল ছাড়া কখনো গণতন্ত্র হয় না, যদিও নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র বলে একটা কথা চালু আছে। অধ্যাদেশ ’৭৩ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য গণতান্ত্রিক বিধি ব্যবস্থার সুযোগটি রেখেছে বলে দলাদলির দাপট লক্ষ করা যায়। ডিন, বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে সিন্ডিকেট সদস্য, সিনেট, শিক্ষা পর্ষদ, আবার সিনেট থেকে সিন্ডিকেটে, অর্থ কমিটিতে—এ সবই নির্বাচননির্ভর। ভিসির প্যানেল, শিক্ষক সমিতির নির্বাচন তো আছেই। আবার নির্বাচিত অথবা অনির্বাচিত ভিসিকে সরানোর আন্দোলন। সারা বছর নির্বাচন আর আন্দোলন লেগে থাকলে পড়াশোনা ও গবেষণা নির্বাসনে যাবে, এটাই তো স্বাভাবিক।
শোনা কথা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নাকি অধ্যাদেশে এত নির্বাচনের কথা শুনে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তাহলে পড়াশোনা হবে কখন? এর উত্তরে অধ্যাদেশ প্রণেতা প্রফেসররা বলেছিলেন, দুশ্চিন্তার কারণ নেই মুজিব ভাই, স্বাধীনতা দিন, পড়াশোনা নিন।

এমন পড়াশোনা হচ্ছে যে এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার শিক্ষা ও গবেষণা র‌্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান তালিকার তলানিতে। রাজনীতিবিদ এতে মহাখুশি। প্রথমত, তাঁদের ছেলে-মেয়েরা বাংলাদেশে পড়াশোনা করে না; করে থাকলেও ব্যয়বহুল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে, নয়তো বিদেশে। দ্বিতীয়ত, শিক্ষকদের দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করা যাচ্ছে। তাঁদের এবং তাঁদের মাধ্যমে ছাত্র-ছাত্রীদের কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন আন্দোলন করানো ও ঠেকানো যায়। বাংলাদেশে ক্ষমতায় যাওয়ার দুটি হাতিয়ার—আমলাতন্ত্র ও শিক্ষক-ছাত্র, রাজনৈতিকীকরণ করতে পারলে ক্ষমতায় যাওয়াটা সহজ হয় এবং একবার বসলে নিশ্চিন্তে দেশ চালানো যায়। তথাকথিত অতিমাত্রায় গণতন্ত্র শিক্ষাঙ্গনে আফিমের মতো কাজ করে—‘নেশা লাগিল রে বাঁকা দু নয়নে নেশা লাগিল রে। ’

সুতরাং আমরা শক্তি আমরা বল, আমরা শিক্ষক দল। দলন, দমন, ডলন সবই দলের কাজ। এই দল ও বল (=দলবল) যার যত বড় ও বেশি, তারই ‘সম্মানের’ সঙ্গে টিকে থাকার সম্ভাবনা বেশি থাকে। দলবিহীন ভিসি ডানাবিহীন পাখির মতো মুখ থুবড়ে মাটিতে লুটায়। সে জন্যই ভিসিরা ক্ষমতায় বসেই প্রথম দল গোছানোর মতো ‘আবশ্যিক’ কাজে মনোযোগ দিয়ে থাকেন। এরপর অন্যান্য ‘অনাবশ্যক’ কাজ, যেমন—পড়াশোনার পরিবেশ সৃষ্টি, ছাত্রদের সহাবস্থান নিশ্চিতকরণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অর্থের জোগান, গবেষণা ইত্যাদি কাজ। তা না হলে স্ত্রী যখন জিজ্ঞেস করবে, তারপর তোমার কী হলো গো, তার উত্তরে যে ওই গান গাইতে হয়, ‘তার আর পর নেই, নেই কোনো ঠিকানা/যা কিছু গিয়েছে থেমে যাক থেমে যাক না। ’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) ভিসি শরীফ এনামুল কবিরের বিদায়ের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন ভিসি হয়ে আসেন। এখানে তাঁর কোনো দল ছিল না, যদিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর একটা বড় দল ছিল। তিনি এসে ঘোষণা দিলেন দলবিহীন নিরপেক্ষ ভিসি থাকবেন। সবাই তাঁর, তিনি কারো নন। সম্ভবত এর ফলে বেশ এক কঠিন সময় পার করে নির্বাচিত ভিসি আনোয়ার হোসেন টার্ম শেষ না করেই বিদায় নিতে বাধ্য হন। সে এক অনন্য এবং করুণ ইতিহাস হয়ে থাকবে। তবে এ কথাও ঠিক যে দল বড় হলেই ভিসির জন্য কেল্লা ফতে, ওম শান্তি এমন ধারণা ঠিক নয়। বড় দল নিয়ে বড় বিপর্যয়ের মুখোমুখি হয়ে বিদায় নিতে বাধ্য হয়েছেন এমন ভিসিও কয়েকজন আছেন। বলা হয়ে থাকে যে বিশেষত দলীয় কোন্দল ও ভুল নীতির কারণে বড় দল নিয়েও তাঁরা সমস্যায় পড়েছিলেন।

ঐতিহ্যগতভাবে জাবিতে ভিসির দল বলতে রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিত্তিতে কিছু না। শিক্ষকরা আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত, বাম ইত্যাদিতে বিভক্ত; কিন্তু ভিসির দল মানে Coalition of convenience। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নির্বাচিত ভিসিকে বিএনপির একাংশ প্রকাশ্যে সমর্থন দেয় ও ভিসির দলের সঙ্গে নির্বাচনে অংশ নেয়; বিএনপির আমলে তার বিপরীত। আবার ভিসির প্রকাশ্য বিরোধিতায় নামে সরকার সমর্থক এক অংশ। এটার কারণ আর কিছুই নয়—সামথিং ইজ ব্যাটার দ্যান নাথিং অথবা ঘরের শত্রু বিভীষণ নীতির প্রতিফলন। কারণ যা-ই থাকুক, এতে ভিসির পতনের সময়টা প্রলম্বিত হয়। এখন অবশ্য সেই দিন নেই। শুনেছি, জাবিতে এখন দলীয় পতাকায় নির্বাচন হয়; ভিসির প্রতি সমর্থন দিতে হলে দিতে হবে গোপনে গোপনে, চান্নি পসর রাইতে, চাদরে মুখমণ্ডল ঢেকে।

১৯৯৯ সালে ভারপ্রাপ্ত উপাচার্যের দায়িত্ব পাওয়ার সময় আমারও একটা দল ছিল। তবে দলের সদস্যসংখ্যা সবসহ দেড় ডজন। দু-একজন ছিলেন গায়েগতরে দুরমুশ, দেখলে প্রতিপক্ষের ভয় পাওয়ার কথা; কিন্তু তাদের মন ছিল কাদার মতো নরম। এতেও কোনো অসুবিধা থাকার কথা ছিল না, যদি আওয়াজ-আস্ফাালনে একটু-আধটু শক্তিশালী হতেন। আমাদের প্রতিপক্ষ এত হৈচৈ করছে আর তোমরা মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছ—এ কথা বলতেই নিজেদের সাফাই গাইতেন : আমরা আওয়াজে নয়, শব্দে বিশ্বাসী। কারণ বজ্রপাতে ফল হয় না; ফল হয় বৃষ্টিতে। তাদের সেই কাঙ্ক্ষিত বৃষ্টির অভাবে অনাসৃষ্টি চলত আর বজ্রপাতে আমার মুণ্ডুপাত ঘটানো হতো। তবে জাবির সুলতানা রাজিয়া বলে খ্যাত হাসিনা মতিন, কাঞ্চন চৌধুরী, মাহমুদা গনি ও নাজমা সিদ্দিকি যুক্তিতর্কের প্রাচীর বানিয়ে আমাকে রক্ষা করার চেষ্টা করতেন। শুরুর দিকটায় তাঁরা আমার দলের ‘প্রাণপুরুষ’ ছিলেন বললেও বোধ করি ভুল হবে না।

সরকারদলীয় সমর্থকদের একটা বড় অংশ আমাকে মেনে নিতে না পারা আমার দল ছোট থাকার অন্যতম কারণ। আমি নাকি নব্য আওয়ামী লীগার, সেদিনের যোগী ভাতেরে কই অন্ন। ব্রাহ্মণ আওয়ামীরা আমার মতো নমঃশূদ্র আওয়ামীকে কবুল করতে নারাজ ছিলেন। সেটা বুঝলাম ভারপ্রাপ্ত ভিসি হওয়ার পর প্রথম সিন্ডিকেট সভায়। বলা নেই কওয়া নেই কোথা থেকে পটকার আওয়াজ শুনতেই সিন্ডিকেট গরম—এমন করে চললে বিশ্ববিদ্যালয় খুলবেন কী করে? তার চেয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়া অব্দি বন্ধ থাকুক। শুধু তা-ই নয়, মুখ আর বডি ল্যাঙ্গুয়েজে আওয়ামী সদস্যরা প্রকান্তরে এক প্রকার জানিয়ে দিলেন, thus far, no further. অনেকটা রবীন্দ্রনাথের ‘যজ্ঞেশ্বরের যজ্ঞ’ গল্পে বর্ণিত যজ্ঞেশ্বরের জ্যাঠাইমার মতো আমি বললাম, ‘ভাই, অপরাধ যা হইবার তা তো হইয়া গেছে, এখন মাপ করো, আজিকার মতো শুভ কর্ম সম্পন্ন হইতে দাও। ’ এমনকি যজ্ঞেশ্বরের ন্যায় জোর হাতে বললাম, ‘আমি অতি ক্ষুদ্র ব্যক্তি, আপনাদের নির্যাতনের যোগ্য নই। ’ অনুমান করি, আমার নাকাল অবস্থা দেখে সিন্ডিকেট সদস্য বিএনপির বন্ধুদের হৃদয় নাচল ময়ূরের মতো। ভারপ্রাপ্ত ভিসি হিসেবে অবস্থা অনেকটা মধুচন্দ্রিমায় গিয়ে বাস খাদে পড়ে আহত হওয়ার মতো দাঁড়াল।

দিন বদলায়। শিগগিরই নির্বাচিত ভিসি হিসেবে আবির্ভূত হই। দল বড় হতে থাকে। ব্রাহ্মণ আওয়ামীরা নমঃশূদ্রের নাম জপতে শুরু করে। প্রথমে নেতা তাঁর দলের সবাইকে এতিম করে দিয়ে আমার সঙ্গে সখ্য করতে, সহযোগিতার হাত বাড়াতে এগিয়ে আসেন। এরপর সুড়সুড় করে সবাই দলে ভেড়ে—কেউ সামনের, কেউ পেছনের দরজা দিয়ে। কেউ আবার আশা ভোঁসলের গানের মতো, ‘চোখে চোখে কথা বল মুখে কিছু বল না একি ছলনা’। শিগগিরই ভিসির অফিস ও বাসা লোকে লোকারণ্য হয়ে ওঠে।

২০০১ সালে জাতীয় নির্বাচনে সরকারের পরিবর্তন ঘটলে আমার বিদায়ঘণ্টা বেজে ওঠে। চোখের সামনে বড় দল ছোট হয়ে আসতে থাকে। নতুন ভিসির সঙ্গে সখ্য স্থাপনের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হতে কেটে পড়ে কেউ কেউ। এমনকি দু-একজন কেউকেটা। বাস্তবে দেখলাম অস্তায়মান সূর্যকে অভিবাদন করে না। সব দেখেশুনে তখন তারাপদ রায়ের শ্রেষ্ঠ একটি কবিতা ‘ভূত ও মানুষ’ মনে পড়ে—‘এইতো আজকেই দলে দলে মানুষ/মিছিল করে ময়দানে এলো, সভা করল। /দৈনিক লাখ লাখ মানুষ রাস্তাঘাটে, হাটে-বাজারে,/ঘুরছে-ফিরছে, কাজ করছে, কাজ খুঁজছে,/হাসছে-কাঁদছে, ভালোবাসছে, ঝগড়া করছে। .../কিন্তু কিভাবে বুঝলে যে ওরা মানুষ?/ওদের বুকের মধ্যে তলিয়ে দেখেছ,/ওদের মধ্যে মানুষের মন আছে কি না,/মানুষের আত্মা, মানুষের বিবেক আছে কি না?’

ভিসির দলে বেশির ভাগ শিক্ষক আত্মার বদলে অর্থনীতি নিয়ে ভেড়ে। অর্থনীতির নিয়মেই আবার ঘাট ছাড়ে। তার পরও খুশি আছি এই ভেবে যে, ‘যা কিছু পেয়েছি কাছে তাই সঞ্চয়/যা কিছু পেলাম নাক সে আমার নয়। ’

 

লেখক : সাবেক উপাচার্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

 

সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ - dainik shiksha প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার - dainik shiksha তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার - dainik shiksha স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন - dainik shiksha নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0029211044311523