দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেছেন, দুর্নীতি করলে দুদকের বারান্দায় আসতেই হবে। এখানে আপসের কোনো সুযোগ নেই। দুর্নীতি করে কেউ ভাববেন না আপনি ছাড় পাবেন, অন্তত এই বার্তাটা আমরা দিতে চাই। দুদকের জাল থেকে কেউ তদবির করে বেরিয়ে যাবেন, তা হবে না। তাদের আইনি প্রক্রিয়ায় আদালতের মুখোমুখি হতে হবে। দুদক এখন আগের জায়গায় নেই এবং এ প্রতিষ্ঠানের প্রতি মানুষের আস্থা বেড়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
রোববার দুদকের প্রধান কার্যালয়ের সেমিনার কক্ষে রিপোর্টার্স অ্যাগেইনেস্ট করাপশন (র্যাক) আয়োজিত ‘মিট দ্য প্রেস’ অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন। ৯ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস সামনে রেখে র্যাকের পক্ষ থেকে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
দুদক চেয়ারম্যান বলেন, অনেকেই বলছেন, হয়তো দুদকের অভিযান থেমে গেছে। আমি বলতে চাই- দুদকের কাছে যেসব অভিযোগ ও তথ্য আছে অভিযান বন্ধ করার কোনো সুযোগ নেই। দুদক এ মুহূর্তে ১৮৭ জনের তালিকা নিয়ে কাজ করছে।
তিনি বলেন, দুর্নীতি করে দুদকের জাল থেকে কেউ বেরিয়ে যেতে পারবেন না। অবৈধ অর্থ দিয়ে যারা খেলাধুলা করেছেন তাদের অনেককেই তদন্তের আওতায় আনা হয়েছে।
তিনি জানান, এনবিআর ও সিআইডিসহ কয়েকটি সংস্থা মানি লন্ডারিংয়ের অপরাধ নিয়ে কাজ করছে। তারা সঠিকভাবে অর্থ পাচার সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালনা করছে কিনা সেদিকে দুদক নজর রাখছে। বেসিক ব্যাংকের অর্থ যেসব ব্যক্তি দেশের বাইরে সরিয়েছেন বা নিজেরা দেশের বাইরে পালিয়ে গেছেন তাদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহের কাজ চলছে। এ জন্য সংশ্লিষ্ট দেশে এমএলএআর (মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিসট্যান্স) পাঠানো হয়েছে।
দুদক বিটের সাংবাদিকদের সংগঠন র্যাকের ‘মিট দ্য প্রেস’ অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন কমিশনার এএফএম আমিনুল ইসলাম, সচিব মুহাম্মদ দিলোয়ার বখত, মহাপরিচালক (আইন) মফিজুর রহমান ভুঁইয়া, মহাপরিচালক (আইসিটি ও ট্রেনিং) একেএম সোহেল, র্যাকের সভাপতি মোর্শেদ নোমান, সাবেক সভাপতি মিজান মালিক, র্যাকের সাধারণ সম্পাদক আদিত্য আরাফাতসহ সংগঠনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও সাধারণ সদস্যরা।
দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, আমাদের কাছে (দুদক) চুনোপুঁটি থেকে শুরু করে প্রভাবশালীদের অনেকের বিরুদ্ধেই দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। আপনারা যাদের রুই-কাতলা বলেন, তাদের অনেকের বিষয়ে নানা মাধ্যম থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। দুদকের তালিকায় ১৮৭ জনের মধ্যে অনেক রাঘববোয়াল আছে। তাদের বিষয়ে দুদক কঠোর অবস্থানে রয়েছে। আপনারা যাদের রুই-কাতলা বলেন, আমি বলব- দুর্নীতি করলে তিনি যত বড় মাপেরই হোন না কেন, ধরা হবে। তদন্তকালে একজনের নাম কত জায়গা থকে বা কতভাবে এলো সেটাও বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে।
দুর্নীতির কারণে উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে উলেখ করে তিনি বলেন, দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরতে পারলেই টেকসই উন্নয়ন আরও টেকসই করা সম্ভব। এজন্য সরকারও যথেষ্ট আন্তরিক। সরকারের আন্তরিকতার উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, আগে জাতিসংঘ ঘোষিত ৯ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করা হতো না। তবে এখন গেজেট করে তা পালন করা হয়।
তিনি বলেন, সংবিধানে স্পষ্টই রয়েছে, কেউ দুর্নীতির অর্থ ভোগ করতে পারবেন না। এটা আমাদের মনে রাখতে হবে। আমাদের পূর্বপুরুষদের চাওয়াও ছিল এটি। দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গড়তে সবাইকে সোচ্চার হতে হবে।
ক্যাসিনো বা অন্য কোনো অবৈধ উপায়ে যারা জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের মালিক হয়েছেন, এমন ১৮৭ জনের নাম তাদের তালিকায় রয়েছে জানিয়ে ইকবাল মাহমুদ বলেন, তাদের মধ্যে বড় বড় রুই-কাতলাও রয়েছে। তবে তাদের কারও নাম আমরা বলব না। ইতিমধ্যে ১৪ জনকে জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি করা হয়েছে। আরও অনেকে রিমান্ডে আসবে। তাদের কাছ থেকে অন্যদের বিষয়েও তথ্য জানার চেষ্টা করা হচ্ছে।
এক প্রশ্নের জবাবে ইকবাল মাহমুদ বলেন, অর্থ পাচার সংক্রান্ত দুদকের দায়ের করা মামলায় এখন পর্যন্ত সাজার হার শতভাগ। ৩৪টি মামলার সব কটিতে আসামির সাজা হয়েছে।
তিনি বলেন, ২০১৫ সালে মানি লন্ডারিং সংক্রান্ত মামলা করার এখতিয়ার আরও তিনটি প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হয়। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত সিআইডি ৬০-৭০টি মামলা করেছে। আর এনবিআর দু-একটা মামলা করেছে। আমাদের দেশে যে মানি লন্ডারিং হয় এর বেশির ভাগ ট্রেড বেইজড মানি লন্ডারিং। আমাদের ধারণা, ট্রেড বেইজড মানি লন্ডারিং নিয়ে এনবিআরের বেশি মামলা করার কথা। কেউ যদি মানি লন্ডারিং মামলা না করে তাদের আমরা পর্যবেক্ষণে রাখছি।
চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত দুদকে ২২ হাজার ২৩৬টি অভিযোগ এসেছে জানিয়ে চেয়ারম্যান বলেন, এর মধ্যে ৩ হাজার অভিযোগ যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে অনুসন্ধানে নেয়া হয়েছে। আমরা আহ্বান করব- দুর্নীতির তথ্য দিন। অভিযোগকারীর নাম না দিলেও কোনো সমস্যা নেই। অভিযোগের মধ্যে সারবত্তা থাকলেই হবে।
সিন্ডিকেটের কারণে পেঁয়াজের মূল্য নিয়ে মানুষের অসন্তোষের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে ইকবাল মাহমুদ বলেন, শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগ পেঁয়াজ ব্যবসায়ীদের জিজ্ঞাসাবাদ করছে। যাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে তাদের কারও যদি অবৈধ সম্পদ থেকে থাকে তাহলে আমাদের কাছে তথ্য সরবরাহ করার জন্য শুল্ক গোয়েন্দাদের প্রতি অনুরোধ থাকবে। এরপর তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। তিনি বলেন, পেঁয়াজ নিয়ে সিন্ডিকেটকারীদের অবৈধ সম্পদের সন্ধান পেলে দুদককে জানান।
তিনি বলেন, দুর্নীতি কারও ভেতরে বা টেবিলে থাকে না। দুর্নীতি থাকে মাথায়, ব্রেইনে। এজন্য মাইন্ডসেট পরিবর্তন দরকার। যে কারণে সবার সম্মিলিত সহযোগিতা ছাড়া দুর্নীতি প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়।
দুদক চেয়ারম্যান বলেন, ফাঁদ মামলা পরিচালনা করার কারণে প্রকাশ্যে ঘুষ লেনদেন কিছুটা কমেছে বলে আমাদের ধারণা। যারা ঘুষ গ্রহণ করেছেন, ২০১৯ সালে দুদক বেশ কিছু ফাঁদের মাধ্যমে সরকারি বহু কর্মকর্তা-কর্মচারীকে গ্রেফতার করেছে। যে কারণে ঘুষখোরদের মধ্যে একটা আতঙ্ক কাজ করছে। এছাড়া সরকারি কর্মকর্তাদের দুদকের গণশুনানিতে আনা হয়েছে। যারা এসব গণশুনানিতে অংশ নিয়েছেন তাদের মধ্যে একটা পরিবর্তন হয়েছে। কিছু সমস্যা গণশুনানির মধ্যেই সমাধান করা সম্ভব হয়েছে।
ইকবাল মাহমুদ বলেন, জনবল সংকটের কারণে দুর্নীতির মামলার অনুসন্ধান ও তদন্ত কাজ কাক্সিক্ষত মাত্রায় করা যায়নি। আগামী দুই মাসের মধ্যে কমিশনে উপপরিচালক ও সহকারী পরিচালক পর্যায়ের কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া হবে। এতে সেই সমস্যার সমাধান হবে।
বেসিক ব্যাংকের তদন্তের ফলাফল নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তদন্ত কর্মকর্তারা আমাদের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন দিয়েছিলেন। তবে আমরা বলেছি, ঋণের নামে বের করা ব্যাংকের টাকা কোথায় গেল- তা খুঁজে বের করতে। এ জন্য কিছুটা সময় লাগছে। টাকা কোথায় গেল সেই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আদালতে চার্জশিট দিতে চাই না। কারণ টাকা কোথায় গেছে তা বের না করে চার্জশিট দেয়া হলে আদালত এ নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে।
বাচ্চুর বিষয়ে এক প্রশ্নে তিনি বলেন, তার নাম থাকবে কি থাকবে না তদন্ত শেষ হলে বলা যাবে। আমাদের ভুল হলে তখন সরকার বা ব্যাংক কর্তৃপক্ষ যদি মনে করে নারাজি দেবে দিতে পারে।
দুদক কমিশনার এএফএম আমিনুল ইসলাম সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, দুদকের দায়ের করা অভিযোগ বা মামলার বিষয়ে এ পর্যন্ত আপিল বিভাগে ৫১৯টি কেস রয়েছে। এর মধ্যে ১১২টি কেস নিষ্পত্তি হয়েছে। কমিশনের পক্ষে গেছে ৬০টি। কেস নিষ্পত্তির হার ৫৩ ভাগ। তিনি আরও জানান, ৩০২টি মামলার বিচার কাজ স্থগিত রয়েছে।