বেশ কিছুদিন আগে ক্যাম্পাসের একটা সামাজিক সংগঠনের কর্মীরা ব্যতিক্রমধর্মী এক প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিল। সেই প্রতিযোগিতার মূল বিষয় ছিল প্রত্যেক প্রতিযোগীকে কমপক্ষে চার মিনিট করে শুদ্ধভাবে বাংলায় কথা বলতে হবে; সেটা হতে পারে যেকোনো বিষয়। সেখানে ২৫ জন প্রতিযোগী ছিল, কিন্তু শুদ্ধভাবে বাংলায় কথা শেষ করতে পেরেছিল মাত্র ২ জন প্রতিযোগী। বাকিরা কথার মধ্যে একাধিক ইংরেজি শব্দ জুড়ে দিয়েছিল।
বিশ্বের ইতিহাসে আমাদের মতো মাতৃভাষার জন্য এতটা ত্যাগ স্বীকার করেনি কোনো জাতিই। সেই ইতিহাসকে সম্মান জানিয়ে ২১ ফেব্রুয়ারিকে ইউনেস্কো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এ স্বীকৃতির ফলে বিভিন্ন ভাষাভাষীদের কাছে বাংলা ভাষার সম্মান বেড়ে যায় বহুগুণ। সারাবিশ্ব শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে এই দিনটিকে। মাতৃভাষা বাংলার জন্য যে রাজপথে তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিল এদেশের তরুণরা এটা নিশ্চয়ই কারো অজানা নয়। কিন্তু সে ব্যাপারটাই বোধহয় খুব করে ভুলতে বসেছি আমরা। শুধু বিশেষ কিছু দিবসে আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাষাকে নিয়ে লিখি। কিন্তু সারাটা বছর বাংলাভাষাকে আমরা লালন করছি কতটুকু?
আজকাল এফ.এম রেডিওর কিছু কিছু উপস্থাপনা শুনলেও বোঝা যায় আমাদের মাতৃভাষাকে কী পরিমাণ বিকৃত করা হচ্ছে। তাদের কথাবার্তা শুনে বোঝার উপায় নেই যে তারা বাংলা বলছে নাকি ইংরেজি বলছে। অনেক সময় বাংলা শব্দকে উচ্চারণ করা হচ্ছে বিকৃতভাবে। একটা বাংলা বাক্যের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে ইংরেজি শব্দ। সুতরাং সেটা যেমন হচ্ছে না বিশুদ্ধ বাংলা বাক্য আবার ইংরেজি বাক্যও বলা যাচ্ছে না। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো তরুণদের মধ্যেও চলে এসেছে এ ধরনের প্রবণতা, যা বিনোদনের নামে তাদের প্রভাবিত করছে। আমরা অনেকেই বেশিরভাগ সময় পাঁচ লাইন বিশুদ্ধ বাংলা বলতে পারি না, কারো সঙ্গে কথোপকথনের সময় বাংলা বাক্যের মধ্যে হর-হামেশাই ঢুকিয়ে দেই ইংরেজি শব্দ। শুধু তাই নয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও দেখা যাচ্ছে এই অসুস্থ প্রবণতা। বাংলায় নয় বরং বলা যায় বাংলিশে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি আমরা। শুধু তাই নয়, দেখা যায় বার্তা আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে কিছু কিছু শব্দ আমরা পুরো লিখি না, যতটা সংক্ষেপে পারি লেখার চেষ্টা করি।
শহরে রাস্তায় বের হলেই দেখা যায় বিভিন্ন বিজ্ঞাপনে, দোকানপাটের নাম, প্রতিষ্ঠানের নাম, বাড়ির নামফলকে জুড়ে দেওয়া বাংলা ইংরেজিমিশ্রিত। সেই বাংলাটুকুতেও আবার ভুলের ছড়াছড়ি। এবং এ ব্যাপারটা সংক্রামক ব্যাধির মতো ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। বাংলার সঙ্গে ইংরেজি ব্যবহার করাটা যেন রীতিমতো একটা শিল্প হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ আমরা কি একবারও ভেবে দেখেছি যে, কয়েক মিনিট ঠিকমতো মাতৃভাষাতে কথা বলতে শরীর ঘেমে যায়! বাংলাভাষার নিজস্বতা ধরে রাখতে আমাদের বুঝি সব অপারগতা! শিক্ষা ও সামাজিক কর্মকাণ্ডসহ আরও বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাভাষায় পিছিয়ে পড়ার কারণ হলো আমরা বিদেশি সংস্কৃতি নিয়ে রীতিমতো ডুবে আছি।
তার মানে এই নয় যে, ইংরেজিসহ প্রয়োজনীয় অন্যান্য ভাষা আমরা শিখব না বা জানব না। বিশ্বায়নের এ যুগে আমাদের নানা কারণে ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করতে হয়। তাই বলে সেটা বাংলাকে একেবারে অবহেলা করে নয়। প্রথমে আমাদের বাংলাভাষাকে হূদয়ে লালন করতে হবে, বাংলাভাষাকে জানতে হবে, বুঝতে হবে। বিশ্বের দরবারে আমাদের মাতৃভাষা বাংলাকে উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত করতে, ভাষাকে আরও উজ্জ্বল করতে চাইলে ভাষার এই বিকৃতি রোধে এগিয়ে আসতে হবে আমাদের সকলকেই।
লেখক: শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।