শিক্ষার বেহাল দশা ও শিক্ষকের দুর্দিন

অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী |

নানা দিক থেকে বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়েছে৷ এক সময়ের 'তলাবিহীন ঝুড়ির দেশ' এখন 'অপার সম্ভাবনার বাংলাদেশ'৷ বিশ্ব এখন বিস্ময়ে বাংলাদেশকে তাকিয়ে দেখে৷ বাংলাদেশ আজ পৃথিবীতে উন্নয়নের রোল মডেল৷ কিন্তু টেকসই ও স্থায়ী উন্নয়নের জন্য যেটি সবচেয়ে বেশি দরকার সেই শিক্ষার আজ বেহাল দশা৷ দেশের শিক্ষক সমাজ সবচে' উপেক্ষিত জনগোষ্ঠী৷  বিষয়টি উদাহরণসহ সংজ্ঞা দিয়ে বুঝিয়ে বলার দরকার পড়ে না৷ একেবারে সাধারণ মানুষও সেটি উপলব্ধি করতে সক্ষম৷ মানসম্মত শিক্ষা আমাদের দেশে এখন বাঘের দুধ৷ দক্ষ শিক্ষকের আকাল৷ পৃথিবীর কোথাও আমাদের মতো শিক্ষার বেহাল দশা ও শিক্ষকের দুর্দিন নেই৷

আমাদের পড়ালেখার মান নিয়ে বহু তর্ক-বিতর্ক আছে৷ সৃজনশীল প্রশ্নের সুবাদে যেভাবে পরীক্ষায় পাসের হার বেড়েছে তা অব্যাহত থাকলে আর লেখাপড়ার প্রয়োজন পড়ে না৷ এমনিতেই লেখাপড়া লাটে উঠে গেছে৷ ছেলেপেলেরা লেখাপড়ার চেয়ে ফেসবুকে সময় বেশি অপচয় করে৷ টেক্সটবুক থেকে ফেসবুক তাদের অধিকতর প্রিয়৷ এক সময় টিক চিহ্ন দেয়া জানলে পাসের চিন্তা ছিল না৷ এখন বৃত্ত ভরাট করতে জানলেই হলো৷

মা বাবা সন্তানের হাতে আদর করে এন্ড্রয়েড মোবাইল কিংবা স্মার্টফোন তুলে দিলে শিক্ষকের কিছু করার থাকে না৷ জিপিএ ফাইভের জোয়ারে আমরা এতদিন ভেসে বেড়িয়েছে৷ এখন আবার সিজিপিএ ফোর না কি যেন কি শোনা যাচ্ছে৷ নতুন বোতলে পুরনো মদ কী না, কে জানে? পাঠ্যপুস্তকের প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ নেই৷ নীতি-নৈতিকতা বিবর্জিত কিংবা কাঠিন্যে ভরা পাঠ্যপুস্তক শিক্ষার্থীদের কাছে দুর্বোধ্য মনে হওয়া স্বাভাবিক৷ কারিকুলাম ও সিলেবাসে তালগোল পাকানো৷ সৃজনশীল প্রশ্ন কয়জন শিক্ষকে বুঝেন? শিক্ষকদের আগে থেকে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ না দিয়ে এবং পাঠ্যপুস্তক সে আদলে প্রণয়ন না করে তা চালু করা কতটুকু সঙ্গত হয়েছে? সেটিই আমাদের কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে৷ অনেকগুলো বিষয় আছে যাদের কোনো পরীক্ষা নেই৷ ধারাবাহিক মূল্যায়নের কথা বলা আছে৷ কয়টা স্কুলে ধারাবাহিক মূল্যায়ন হয় কিংবা বিষয়গুলো পড়ানো হয়? এভাবে আমাদের শিক্ষায় চলছে নানা প্রহসন৷

জাতীয় বাজেটে শিক্ষাখাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দের কথা বলা হয়৷ কথাটি সঠিক নয়৷ শিক্ষাখাতে বরাদ্দ দেখিয়ে অন্য খাতে কেটে নেবার নজির আর কারো নেই৷ এ কাজটি আমাদের এখানে হয়ে থাকে৷ দুনিয়ার আর কোথাও জাতীয় বাজেটে শিক্ষাখাতকে এত অবহেলার চোখে দেখা হয় না৷ তারপরও গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে দিনরাত শিক্ষায় আমরা নানা উন্নয়নের কথা বলে থাকি৷ শিক্ষক প্রশিক্ষণের নামে বছরে কোটি কোটি টাকার অপচয় হয়৷ জুন মাস এলে তা খুব ভালো করে টের পাওয়া যায়৷ ব্যাচের পর ব্যাচ টানা প্রশিক্ষণের আয়োজন করে রাতারাতি টাকা হালাল করার মহরত যে কারো সহজে চোখে পড়ে৷ বিদেশে শিক্ষক প্রশিক্ষণের নামে কত রকমের বাণিজ্য হয়, সে খবর কে রাখে?

ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধার জন্য শিক্ষকদের রাজপথে সংগ্রামে নামতে হয়৷ অনশনে শিক্ষক মৃত্যুবরণ করেন৷ এ লজ্জা কার? শিক্ষকের না রাষ্ট্রের? শিক্ষা যদি নাগরিকের মৌলিক অধিকার হয়ে থাকে তবে রাষ্ট্র কিংবা সরকার এ দায় এড়িয়ে যেতে পারে না৷ আমাদের দেশে শিক্ষার সকল দায়ভার শিক্ষকের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়৷ পরীক্ষায় নকলের দায়, প্রশ্নফাঁসের দায়,পরীক্ষায় ফেলের দায়-সব দায় একা শিক্ষকের৷ আর যেন কারো কোন দায় নেই৷

শিক্ষায় সরকারি ও বেসরকারি বিভাজন বৈষম্যের পাহাড় রচনা করে রেখেছে৷ অশিক্ষিত ব-কলমেরা শিক্ষার দেখভাল করতে গেলে শিক্ষার উন্নতি আশা করা দুরাশার সমান৷ ম্যানেজিং কমিটি ও গভর্নিং বডিগুলোতে বেশিরভাগ এ শ্রেণির লোকেরাই জায়গা করে নেয় এবং মাতব্বরি করে৷

দেশে হাজার হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এমপিও নেই৷ লাখের উপর শিক্ষক-কর্মচারীর কোনো বেতনই পান না৷ এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীর চিকিৎসা ভাতা পাঁচশ' আর বাড়ি ভাড়া এক হাজার৷ তা দিয়ে চলে কী করে? বদলি নেই, পদোন্নতি নেই৷ বোনাস মাত্র ২৫ শতাংশ৷ জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা-২০১৮'র কোনো খবর নেই৷ জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০'র কী হলো-কে জানে? 
শিক্ষা নিয়ে কারো গরজ নেই৷ শিক্ষকদের প্রতি কারো দায় নেই৷ এমন হলে বাংলাদেশ এসডিজি'র লক্ষ্যমাত্রা কতটুকু অর্জন করতে পারবে? বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ সুদূর পরাহত থেকে যাবে৷ শিক্ষা ও শিক্ষকদের নিয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির আশু পরিবর্তন সবার একান্ত কাম্য হওয়া দরকার৷ অন্যথায়, মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হবার অহংকারটি অন্যদের কাছে মিথ্যাই প্রতিপন্ন হবে৷

লেখক : অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট এবং দৈনিক শিক্ষার নিজস্ব সংবাদ বিশ্লেষক ৷


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ঢাকার তাপমাত্রা দেখে স্কুল বন্ধের সিদ্ধান্ত নয়: শিক্ষামন্ত্রী - dainik shiksha ঢাকার তাপমাত্রা দেখে স্কুল বন্ধের সিদ্ধান্ত নয়: শিক্ষামন্ত্রী আরো ৭২ ঘণ্টার হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha আরো ৭২ ঘণ্টার হিট অ্যালার্ট জারি ফাঁস হওয়া প্রশ্নেই প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা - dainik shiksha ফাঁস হওয়া প্রশ্নেই প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা এসএসসি পরীক্ষার ফল ১০ বা ১১ মে - dainik shiksha এসএসসি পরীক্ষার ফল ১০ বা ১১ মে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে কুমিল্লায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি ঘণ্টা চালুর নির্দেশ - dainik shiksha কুমিল্লায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি ঘণ্টা চালুর নির্দেশ দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে - dainik shiksha প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0028121471405029