বিশ্বব্যাংকের ‘ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট ২০১৮: লার্নিং রিয়ালাইজ এডুকেশন প্রমিজ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, বিদ্যালয়ে নিয়মিত যাতায়াত করার মানেই শেখা নয়। বাংলাদেশের তৃতীয় শ্রেণির ৩৫ শতাংশ শিক্ষার্থী বাংলা বিষয়টিও সঠিকভাবে পড়তে পারে না। আর পঞ্চম শ্রেণির মাত্র ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থী সঠিকভাবে গণিত বোঝে, অর্থাৎ ৭৫ শতাংশ শিক্ষার্থীই গণিত বোঝে না। অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া পরিবারের শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রেই এ ঘটনা বেশি ঘটছে। বাংলাদেশে প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণিতে ভর্তি হয় ৩১ লাখেরও বেশি শিক্ষার্থী, এদের মধ্যে মেয়ে শিক্ষার্থী ৪৯ দশমিক ৮ শতাংশ।
আর প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীর ৬০ শতাংশ প্রাক-প্রাথমিক শেষ করে আসে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের শিক্ষার্থীদের তুলনায় শিখন মানে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রাক-প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক শেষ করা পর্যন্ত বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের স্কুল সময় হচ্ছে ১১ বছর। কিন্তু বাংলাদেশের শিশুরা ১১ বছরে যা শিখছে, অন্য দেশের শিশুরা মাত্র সাড়ে ছয় বছরেই তা শিখছে। অর্থাৎ একজন শিক্ষার্থীকে অন্য দেশের শিক্ষার্থীদের তুলনায় একই বিষয় শিখতে সাড়ে চার বছর সময় বেশি ব্যয় করতে হচ্ছে। বিশ্বব্যাংক এর কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেছে। প্রধান কারণটি হচ্ছে, স্কুল ব্যবস্থাপনার দুর্বল মান। আরেকটি হচ্ছে, বাংলাদেশের সরকারি শিক্ষাব্যবস্থায় সামগ্রিক ব্যয় কম। বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার কথা বলা হয়েছে প্রতিবেদনে।
এ বিষয়টি আমরা ভালোভাবেই জানি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সরকারদলীয় লোকজন ও তাদের আত্মীয়স্বজনরা কমিটির বিভিন্ন পদ দখল করে রাখে মূলত দুটি কারণে। একটি হচ্ছে এলাকায় প্রভাব বিস্তার করা। দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিক ফায়দা লুটা। শিক্ষা ও শিক্ষার মান নিয়ে তাদের বোঝারও কথা নয়, আর এসব নিয়ে তাদের কোনো চিন্তাও নেই। রাজনৈতিক লোকদের কমিটির পদ দখলের কারণে শিক্ষাদান, শিক্ষার মান ইত্যাদি বিষয় বরাবরই অবহেলিত থেকে যাচ্ছে, আর মানসম্মত শিক্ষাগ্রহণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম, তাতে ক্ষতি হচ্ছে দেশের। এ সমস্যা দেশের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল। শিক্ষার মঙ্গল চাইলে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে কী ধরনের লোকজন বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সদস্য হতে পারবেন।
মাধ্যমিকে মোট শিক্ষকের ৬৬ দশমিক ৮৬ শতাংশ প্রশিক্ষিত। ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দের তুলনায় প্রশিক্ষিত শিক্ষক প্রায় ৩ শতাংশ বেড়েছে। তবে ৩৩ শতাংশ শিক্ষকের কোনো প্রশিক্ষণই নেই। গুণগত শিক্ষার জন্য গুণগত মানের শিক্ষকের প্রয়োজন সর্বাগ্রে। এখানে প্রশিক্ষিত শিক্ষক এক কথা আর প্রশিক্ষণের বিষয়গুলো শ্রেণিকক্ষে ব্যবহার করা আরেক কথা। শতকরা কতজন শিক্ষক প্রশিক্ষণের পরে শ্রেণিকক্ষে প্রশিক্ষণে অর্জিত পদ্ধতিগুলো ব্যবহার করেন, তার কোনো হিসাব, পরিসংখ্যান বা গবেষণা আমাদের কাছে নেই। শিক্ষক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে এসেছেন আর মানসম্মত শিক্ষাদান—এ দু’য়ের মধ্যে কোনো সম্পর্ক না-ও থাকতে পারে। এর কারণ হচ্ছে একজন শিক্ষক যদি তার অর্জিত জ্ঞান ও পদ্ধতিগুলো শ্রেণিকক্ষে ব্যবহার না করেন, যদি সব ধরনের শিক্ষার্থীকে কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ না করান তাহলে তার প্রশিক্ষণ গ্রহণের উপকারিতা বিদ্যালয় কিংবা শিক্ষার্থীরা কীভাবে পাবেন?
প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের পাশাপাশি উচ্চশিক্ষার পরিস্থিতিও উঠে এসেছে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে। বেশ কয়েকটি সুপারিশ এসেছে এ সংস্থার কাছ থেকে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বছরে যে বাজেট, তার ১ শতাংশও গবেষণার জন্য ব্যয় করা হয় না, যা খুবই হতাশাজনক। তবে কিছু বিশ্ববিদ্যালয় পৃথক প্রকল্প থেকে গবেষণার জন্য বরাদ্দ পাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় গবেষণা ব্যয় বাড়ানো প্রয়োজন। তবে শিক্ষকদেরও গবেষণার ইচ্ছা থাকতে হবে। প্রাক-শৈশবে শিশুদের ঠিকমতো উন্নয়ন হচ্ছে না, দুর্বল শিক্ষাদান পদ্ধতি, বিদ্যালয় পরিচালনা ব্যবস্থায় দুর্বলতা এবং সরকারি শিক্ষাব্যবস্থায় সামগ্রিক ব্যয় কম। বিশ্বব্যাংক তাদের প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে বাংলাদেশের অ্যানুয়াল প্রাইমারি স্কুল সেনসাস-২০১৬ ও যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা ইউএসএ আইডির মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে। বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর বব সাম বলেন, ‘বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় সব শিশুই স্কুলে ভর্তি হচ্ছে। এর মধ্যে মেয়েদের সংখ্যা বেশি, যা খুবই ভালো। কিন্তু ক্লাসে যা শেখানো হচ্ছে, তাতে অন্য দেশের তুলনায় পিছিয়ে থাকছে বাংলাদেশ। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে শিক্ষাখাতে সরকারি ব্যয় অনেক কম। বাংলাদেশের বাজেটে শিক্ষাখাতে যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়, তাতে মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা কঠিন।’
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে দেশের শিক্ষা পরিস্থিতির যে চিত্র এসেছে, তাতে সম্পূর্ণ না হলেও বেশকিছু সঠিক তথ্য উদ্ঘাটন হয়েছে। প্রাথমিকে প্রায় শতভাগ স্কুলে গেলেও শিক্ষার মান যে প্রত্যাশিত মাত্রায় আসেনি, তা সরকারি কর্মকর্তারাও স্বীকার করেছেন। শিক্ষা বিশেষজ্ঞরা এজন্য বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের আরো বেশি মনোযোগী হওয়ার কথা বলছেন। স্কুলে শিক্ষকদের উপস্থিতিও ঠিকমতো নেই। প্রাথমিক থেকেই শিশুদের কোচিং সেন্টারে নিয়ে যাচ্ছেন অভিভাবকরা। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে যোগ্য ও দক্ষ শিক্ষকের অভাব রয়েছে। সার্বিক সুপারিশে বলা হয়, বাংলাদেশের শিক্ষার মান মূল্যায়নের ব্যবস্থা থাকতে হবে। প্রাথমিক পর্যায়ে বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা ও শিক্ষকদের মান বাড়াতে হবে। প্রাক-শৈশব পর্যায়ে মানসম্পন্ন শিক্ষা এবং শিশুদের পুষ্টির প্রতি অধিকতর গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষার্থীদের মেধা শাণিত করতে পুষ্টির দিকে নজর দিতে হবে। এজন্য স্কুলে ‘মিড ডে মিল’ চালু করা প্রয়োজন। আমাদের দেশে দারিদ্র্য ও অন্যান্য কারণে ৪০ শতাংশের মতো শিক্ষার্থী মাধ্যমিক শেষ করার আগেই ঝরে পড়ে। শিক্ষার্থীরা কী শিখল, তার মূল্যায়ন কেবল পরীক্ষানির্ভর; যা শিক্ষার্থীদের কোনো কিছু অর্জনের আসল কথা বলে না। এ বিষয়টি উপেক্ষিতই থেকে গেছে।
বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) ‘বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ২০১৮’-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, মাধ্যমিকে সার্বিকভাবে ঝরে পড়ার হার কমলেও এখনো ৩৭ দশমিক ৬২ শতাংশ শিক্ষার্থী দশম শ্রেণি শেষ করার আগেই ঝরে পড়ছে। এর মধ্যে আবার এক বছরের ব্যবধানে ছেলেদের ঝরে পড়ার হার আড়াই শতাংশ বেড়েছে। নতুন তথ্য বলছে, এখন মাধ্যমিকে ছেলেদের ঝরে পড়ার হার ৩৬ দশমিক শূন্য ১ ভাগ, যা আগের বছর ছিল ৩৩ দশমিক ৪৩ শতাংশ। ছাত্রীদের ঝরে পড়ার হার ১ শতাংশের কিছু বেশি কমলেও এখানে সেই হার ৪০ দশমিক ১৯ শতাংশ। ২০১১ খ্রিষ্টাব্দের মাধ্যমিকে ঝরে পড়ার কারণ হিসেবে বলা হয়েছিল অভিভাবকদের নিম্ন আয়, বাল্যবিবাহ ও দারিদ্র্য। অল্প বয়সে মেয়েদের বিয়ে হয়ে যায়, তাদের মধ্যে ৯০ শতাংশই ঝরে পড়ে। এদিকে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ‘বাংলাদেশের আদিবাসী ও দলিত জনগোষ্ঠী: অধিকার ও সেবায় অন্তর্ভুক্তির চ্যালেঞ্জ এবং করণীয়’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন পেশ করে ১০ মার্চ (২০১৯)।
প্রতিবেদনে সব নাগরিকের অধিকার নিশ্চিতে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও দলিতদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিয়ে খসড়া বৈষম্য বিলোপ আইন কার্যকর করাসহ ১৩ দফা সুপারিশ করেছে সংস্থাটি। প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘ইতিবাচক অগ্রগতি সত্ত্বেও বাংলাদেশে অদিবাসী ও দলিতদের অধিকার ও সেবাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে বঞ্চনা, অনিয়ম ও দুর্নীতির শিকার হওয়ার চিত্রটি বেশ প্রকট। এক্ষেত্রে আইনি ও সাংবিধানিক কাঠামোতেও দুর্বলতা রয়েছে। আদিবাসী ও দলিতদের পেছনে রেখে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন অসম্ভব। সব নৃগোষ্ঠী ও অবাঙালি দলিত শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষালাভের অধিকার নিশ্চিত করতে তাদের মাতৃভাষায় পাঠ্যবই প্রণয়ন ও পাঠদানের জন্য শিক্ষক নিয়োগ করা, সমতলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও দলিতদের ভূমি সমস্যা সমাধানে পৃথক ভূমি কমিশন গঠন ও সামাজিক নিরাপত্তা বিধানের কথা বলা হয়েছে।
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকদের নানা দাপ্তরিক ও সরকারি নানা কাজ, যেমন নির্বাচনের দায়িত্ব, জরিপ ও নানা তথ্যানুসন্ধানে নিয়োজিত করা হয়। এসব কাজে অবশ্য তাদের অন্যান্য দক্ষতা বৃদ্ধি পায়। তবে শিক্ষকস্বল্পতা হেতু এসব অতিরিক্ত কাজ শিক্ষকদের সঠিক শিক্ষাদানকে কিছুটা বাধাগ্রস্ত করে। শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘যত কিছুই লক্ষ্য ঠিক করি, তার মূলে রয়েছে মানসম্মত শিক্ষা।’ আর যখন মানসম্মত শিক্ষা বলব, তখন পড়ানোর বাইরে আরো অনেকগুলো দিক রয়েছে। সেটি যদি হতে হয়, তাহলে মানসম্মত শিক্ষক প্রয়োজন। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি শিক্ষাখাতে ১২ থেকে ১৪ শতাংশ খরচ করা হয় বলে জানান।
মানসম্মত শিক্ষা বাস্তবায়নের জন্য পর্যায়ক্রমে শিক্ষাখাতে অর্থ বরাদ্দ আরো বাড়ানো হবে বলে জানান। আমাদের মনে রাখতে হবে মানসম্মত শিক্ষা একটি ব্যাপক বিষয়, একটি সার্বিক বিষয়, এটি শর্টকাট কোনো পদ্ধতি নয় যে হুট করে তা নিশ্চিত করা যাবে। শিক্ষক, অভিভাবক, সরকার ও শিক্ষার সার্বিক ব্যবস্থাপনা এজন্য দায়ী। একজন শিক্ষার্থী গান গাইয়ে দর্শকদের তাক লাগিয়ে দিতে পারে। তার শ্রোতা হাজার হাজার। আরেকজন শিক্ষার্থী ক্রিকেট খেলায় নৈপুণ্য দেখাতে পারে। অন্য একজন ভালো ছবি আঁকতে পারে। আরেকজন চমৎকার লিখতে পারে। এগুলো আমরা কী দিয়ে বিচার করব? প্রচলিত মূল্যায়ন পদ্ধতিতে এগুলোর কোনো স্থান আছে কি? এগুলো বিশাল গুণাবলির প্রকাশ, যা আমাদের মূল্যায়ন পদ্ধতিতেও থাকা প্রয়োজন।
লেখক: শিক্ষা গবেষক ও বিশেষজ্ঞ ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত
সূত্র: বণিকবার্তা