সবিনয়ে শিক্ষক নেতাদের উদ্দেশে

অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী |

গত ছাব্বিশ সেপ্টেম্বর সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলায় শিক্ষক সমিতির নতুন কমিটি হয়েছে। জালাল ভাই সভাপতি। খালেদ স্যার সচিব। দীর্ঘদিন ধরে দু’জনেই শিক্ষকতার সাথে জড়িত। শিক্ষকতা পেশায় নিবেদিত মানুষ। শিক্ষক-কর্মচারীর ন্যায়সঙ্গত আন্দোলন-সংগ্রামে সব সময় দু'জনই সামনের সারিতে থাকেন। শিক্ষক-কর্মচারীদের একান্ত সজ্জন বলেই জানি। শিক্ষা ও শিক্ষকবান্ধব বলে তাদের সুনাম আছে। কিন্তু দু'জনেই প্রতিষ্ঠান প্রধান। এ জায়গায় আমার একটু দ্বিমত। সচিব পদে একজন সহকারী শিক্ষক হলে মনে হয় ভালো হতো। কমিটি আরো  সুন্দর ও স্বতঃস্ফূর্ত হতো। এটি আমার একান্ত নিজের অভিমত। তবু তাদের দু'জনকে উষ্ণ অভিনন্দন জানিয়ে লেখাটি শুরু করতে চাই। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী মহোদয়ের নির্বাচনী এলাকার এ দু'জন শিক্ষক নেতার কাছে কেবল বিয়ানীবাজারের নয়, গোটা দেশের শিক্ষক-কর্মচারীর   প্রত্যাশা অনেক। খুব কাছের মানুষ বলে আমার ব্যক্তিগত প্রত্যাশা আরো বেশি। দু'জনেই মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর আপন মানুষ। নিজেদের নির্বাচনী এলাকার সংসদ সদস্য বলে একান্তে মাননীয় মন্ত্রীকে সারা দেশের শিক্ষকদের মনের দুঃখটা বুঝিয়ে বলতে পারেন।

এ সুযোগ দু'জনেরই আছে। কিন্তু তারপরও শিক্ষক-কর্মচারীর প্রত্যাশা পুরণে তারা কতটুকু সময় দিতে পারবেন, কতটুকু সফল হতে পারবেন, সে শুধু ভবিতব্যই বলতে পারে। আগের মেয়াদে মজির উদ্দিন আনসার সভাপতি ছিলেন। এখন শিক্ষক সমিতির কেন্দ্রীয় সহসভাপতি। সারা জীবন বাম রাজনীতি করেছেন। গত দু'তিন বছর ধরে রিটায়ার্ড। সিলেট বিভাগের শিক্ষক সমাজকে সুসংগঠিত করতে সুনামগঞ্জ-মৌলভী বাজার-হবিগঞ্জ চষে বেড়িয়েছেন। শিক্ষামন্ত্রী মহোদয়ের একান্ত কাছের লোক বলে আজো তার কাছ থেকে শিক্ষক সমাজের প্রত্যাশা ফুরিয়ে যায়নি। শিক্ষকদের জন্যে কোনদিন তার আন্তরিকায় ঘাটতি দেখিনি। সচিব ছিলেন পিএইচজি স্কুলের প্রধান শিক্ষক। তার প্রতিষ্ঠানটি সদ্য সরকারি হয়ে যাওয়ায় সঙ্গত কারণে তিনি আর সমিতিতে নেই। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর স্নেহধন্য হাসিব ভাইয়ের জন্যে অন্তত জাতীয়কৃত হওয়ায় অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানাতেই হয় ।  

মান্যবর অর্থমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী দু'জনেরই বাড়ি সিলেট জেলায় বলেই সারা দেশের শিক্ষক-কর্মচারীরা সিলেটের শিক্ষক নেতাদের দিকে চেয়ে থাকেন। আর সিলেটের শিক্ষক-কর্মচারীরা চেয়ে থাকেন বিয়ানীবাজার ও গোলাপগঞ্জের শিক্ষক নেতাদের দিকে। এভাবেই চেয়ে চেয়ে বেসরকারি স্কুল-কলেজ ও মাদরাসার শিক্ষক-কর্মচারীগণ গত দশটি বছরের বেশি সময় পার করে এসেছেন। দ্বিগুণ বাড়ি ভাড়া আর পাঁচগুণ  চিকিৎসা ভাতা ছাড়া কিছু মেলেনি তাদের। বিয়ানীবাজারের শিক্ষকনেতাদের মতো মাননীয় মন্ত্রীর নির্বাচনী এলাকার গোলাপগঞ্জের শিক্ষক নেতারা আরেকটু তৎপর হলে শিক্ষক সমাজ হয়তো আরো কিছু উপকৃত হতে পারত। 

শিক্ষক সমিতি নিঃসন্দেহে পেশাজীবী অন্যান্য সংগঠনগুলোর মতোই। শিক্ষকতা অন্য আর দশটা পেশার মত না হলেও শিক্ষক সমিতিগুলোর প্রধান উদ্দেশ্য থাকে শিক্ষক-কর্মচারীর ন্যায্য দাবি দাওয়া আদায় করা। শিক্ষা ও শিক্ষকের মান মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করা। আজ ক'টা বছর ধরে সমিতিগুলো শিক্ষক-কর্মচারীর প্রত্যাশা পূরণে কতটুকু সফল হতে পেরেছে, সে আজ হিসেব নিকেশ করে দেখার সময়টুকুও গত হয়ে যাচ্ছে। বৈশাখী ভাতা, ৫ শতাংশ বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট ও সরকারিকরণের মতো কমন ইস্যুতে শিক্ষক সমিতিগুলো কী কোনো সাফল্য অর্জন করতে পেরেছে? একেবারে সহজ উত্তর। না, পারেনি। শিক্ষক সমিতিগুলোর এ ব্যর্থতা সারা দেশের শিক্ষক-কর্মচারীদের দারুণ হতাশ করেছে। এর কারণ খতিয়ে দেখা একান্ত অপরিহার্য। বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদরাসার শিক্ষক-কর্মচারীদের কতটি সমিতি আছে, কে জানে? জেলায় উপজেলায় একাধিক সমিতি। একের অধিক সংগঠন। তবু তাদের কথা কেউ শোনে না। এতটুকু আমলে নিতে চায় না।    সারা দেশের পাঁচ লাখ শিক্ষক-কর্মচারীর একই কাজ। একই স্বপ্ন। একই দাবি। একই পাওয়া-না পাওয়ার বেদনা। সকলে এখন হতাশ। তবু তাদের এতো সংগঠন কেন? কেন এতো সমিতি? সাধারণ ইস্যুগুলোতে তারা কি একটিবারের জন্য এক হতে পারেন না? এক হওয়াটা কি খুবই জটিল কোনো ব্যাপার? কোনো পেশাজীবী সংগঠনের ষাট সত্তুরের বেশি সমিতি দিয়ে আর যাই হোক, দাবি দাওয়া আদায় করা বড়ো কঠিন। সারা দেশের শিক্ষক নেতারা সেটি উপলব্ধি না করলেও সাধারণ শিক্ষক-কর্মচারীরা আজ তা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করেন। 

ছোটবেলা বাবার মুখে একটি কথা অনেকবার শুনেছি। কথাটি এমন, 'হাজার পাইক মেলে তবু সর্দার মেলে না'। বড় হয়ে নেতা ও নেতৃত্বের গুণাবলী পড়তে গিয়ে কথাটি বার বার কানে বেজেছে। যে কোনো আন্দোলন-সংগ্রাম নেতার কারণেই সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে থাকে। অন্যরা নেতার কারণেই লাভবান হয়। বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু মুজিবের মতো একজন বিশ্বমাপের নেতার জন্ম হয়েছিল বলে মাত্র নয় মাসে দেশটি স্বাধীন হতে পেরেছিল। এর আগে সোহরাওয়ার্দী, ভাসানী ও শেরে বাংলার মতো জাতীয় নেতারা স্বাধীনতার প্রেক্ষাপট তৈরি করে দিতে পেরেছিলেন।                      

শিক্ষক সমিতিগুলোর এখনকার নেতৃত্বে নিয়ে নানা কথা শোনা যায়। জায়গায় জায়গায় অবসরপ্রাপ্ত প্রিন্সিপ্যাল কিংবা প্রধান শিক্ষক হয়তো সভাপতি নয়তো সচিব। কোনো কোনো জায়গায় উভয় পদেই তারা। তারা জ্ঞানী ও বিদগ্ধজন বটে। কিন্তু শিক্ষক-কর্মচারীর দাবি দাওয়ায় এখন আর তাদের লাভ-ক্ষতির কিছু নেই। জাতীয়করণ হলেই কী আর না হলেই কী? ইনক্রিমেন্ট এবং বৈশাখী ভাতায় তাদের কিছু যায় আসে না। তাদের তো এমপিওই নেই। শেষ জীবনে পদ-পদবী নিয়ে বাঁচাটাই সার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাধারণ শিক্ষকরা সম্মান করে কিছু বলতে ও পারে না। আবার সইতে ও কষ্ট হয়। সমিতিগুলোর গঠনতন্ত্রে এসব অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের সম্মান দেখিয়ে উপদেষ্টা পদ সৃজন করা যেতেই পারে। তাদের অভিজ্ঞতা ও বুদ্ধিশুদ্ধি কাজে লাগিয়ে উপকার পাওয়া যেতে পারে বটে কিন্তু আন্দোলনের লাগাম তাদের হাতে রেখে সফলতা অর্জন করা একেবারে কঠিন কাজ। অনেক জায়গায় প্রতিষ্ঠান প্রধান সভাপতি আবার সচিবও তাই। তাদের দিয়ে জোরালো ও ফলপ্রসূ আন্দোলন কতটুকু আশা করা যায়? প্রতিষ্ঠান প্রধানের নানা জায়গায় ধরা থাকে। ম্যানেজিং কমিটি ও গভর্নিং বডির কাছে। প্রশাসনের কাছে। সরকারের কাছে। কতভাবে কত ধরা থাকে। এত ধরা খাওয়ার মাঝে তারা আন্দোলন-সংগ্রামের কর্মসূচি কতটুকুই বা দিতে পারেন? তারপরও যদি বা দিয়ে থাকেন, তাতে সহকারী শিক্ষকদের স্বতঃস্ফূর্ততা তেমন ফুটে ওঠে না। সব হেডস্যার আর প্রিন্সিপ্যালরা নেতা। সহকারীরা হীনমন্যতায় ভুগতেই পারেন। আন্দোলন-সংগ্রামে নিজেদের অপ্রয়োজনীয় মনে করতেই পারেন।

আরেকটা বিষয় অনেক সময় লক্ষ্যনীয় হয়ে উঠেছে। আর তা হলো, আজকাল নামধারী শিক্ষক নেতার সংখ্যা বেশি। এরা নিজেদের স্বার্থে পেশাকে ব্যবহার করেন। শিক্ষকতা তাদের একটা সাইনবোর্ড মাত্র। তারা রাজনীতি করেন। ব্যবসা-বাণিজ্য করেন৷ শিক্ষকনেতা সেজে নির্বাচনে দলের টিকিট পেতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। বৈশাখী ভাতা না নিয়ে ঘরে যাব না। ইনক্রিমেন্ট আদায় না করে ছাড়ব না। সরকারিকরণ না করে বাড়ি ফিরব না। তাদের ইত্যাদি রকম বড় বড় কথায় আনন্দ উচ্ছ্বাসে সাধারণ শিক্ষকরা বাড়ি ছেড়ে ঢাকা যান। রিক্ত হস্তে ব্যথিত হৃদয়ে আবার বাড়ি ফিরে আসেন। কিন্তু নেতাদের ঘরে ফেরা কিংবা বাড়ি ফেরা-কোনটিরই প্রয়োজন পড়ে না। কারণ তাদের বেশির ভাগের বাড়িই ঢাকায়। সাধারণ শিক্ষকদের লেলিয়ে দিয়ে তারা নিজেদের হিসেবটা হয়তো বা ঠিকই বুঝে নেন। কাউকে দিয়ে এক গেলাস শরবত কিংবা পানি খাইয়ে আন্দোলন স্থগিত কিংবা প্রত্যাহার করেন। আর এভাবেই মাঝপথে মারা যায় শিক্ষক-কর্মচারীর সাধের আন্দোলন। প্রত্যাশার মৃত্যু ঘটে। অ-নে-ক প্রত্যাশা। অ-নে-ক পাওনার হিসেব। কেবলই না পাওয়ার হিসেবটা দিনে দিনে লম্বা হতে থাকে। আর কত লম্বা হবে-কে জানে? তাই সব জায়গায় সবখানে শিক্ষা ও শিক্ষকবান্ধব নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত না হলে বেসরকারি শিক্ষকদের কপালে আরো দুর্গতি আছে। এ দুর্গতি গোটা দেশের। গোটা জাতির।                                  

লেখক: অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট ও দৈনিক শিক্ষার নিজস্ব সংবাদ বিশ্লেষক।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের এমপিওর চেক ছাড় - dainik shiksha স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের এমপিওর চেক ছাড় গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটে প্রথম লামিয়া - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটে প্রথম লামিয়া প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে দ্বিতীয় ধাপের চূড়ান্ত ফল আগামী সপ্তাহ - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে দ্বিতীয় ধাপের চূড়ান্ত ফল আগামী সপ্তাহ ছাত্রলীগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিলিস্তিনের পতাকা উড়াবে কাল - dainik shiksha ছাত্রলীগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিলিস্তিনের পতাকা উড়াবে কাল চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রী যা জানালেন - dainik shiksha চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রী যা জানালেন গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ, পাস ৩৬.৩৩ শতাংশ - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ, পাস ৩৬.৩৩ শতাংশ কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0050961971282959