অটোমেশন পদ্ধতি : বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে ভর্তিতে অনিশ্চয়তা

দৈনিকশিক্ষা প্রতিবেদক |

দেশের বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলোতে ২০২২-২০২৩ শিক্ষাবর্ষে এমবিবিএস প্রথম বর্ষে ভর্তিতে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। সংশ্লিষ্টদের বিরোধিতা সত্ত্বেও প্রথম বারের মতো অটোমেশন চালু করা হয়। এতে প্রথমে শিক্ষার্থীদের পাঁচটি মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির চয়েস রাখা হয়। পরবর্তী সময়ে এই নীতি পরিবর্তন করে ছেলেদের জন্য ৬০টি মেডিক্যাল কলেজ ও মেয়েদের জন্য ৬৬টি চয়েস রাখা হয়। চয়েসের এ ধরনের নিয়ম শুধু বাংলাদেশে জন্য নয়, সারা বিশ্বে নজিরবিহীন। 

দেশের উচ্চ মাধ্যমিকে প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের চয়েস দেওয়া যায়। কিন্তু স্বাস্থ্য-অধিদপ্তর দেশ-বিদেশের সব নিয়মনীতি উপেক্ষা করে ৬৬টি মেডিক্যাল কলেজের অপশন দেয়। বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজ অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএমসিএ) এ ব্যাপারে প্রথম থেকেই আপত্তি জানিয়ে আসছে। 

বিপিএমসিএর বিরোধিতা সত্ত্বেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর গত ১৩ জুন কলেজ ঠিক করে দিয়ে শিক্ষার্থীদের কাছে মোবাইলে খুদে বার্তা পাঠায়। এ খুদে বার্তা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, তাদের দেওয়া পছন্দের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ পাননি অনেকে। ছাত্রছাত্রীদের মেধাক্রম অনুসারে ভর্তির কথা বলা হলেও কলেজের রেংকিংয়ের বিষয়টি অজানা রেখে কীভাবে মেধাক্রম অনুসরণ করা হলো তা কারোই বোধগম্য নয়। তিন মাস আগে সরকারি মেডিক্যাল কলেজে ভর্তিপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হলেও বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলো ভর্তি প্রক্রিয়া এখনো শুরুই করতে পারেনি। যা নিয়ে দেশের মেডিক্যাল ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী ও অভিভাকদের মধ্যে চরম হতাশা দেখা দিয়েছে। অভিভাবকদের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে হাইকোর্টে রিট করা হয়েছে। আগামী সাত দিনের মধ্যে বিষয়টি নিষ্পত্তি করতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট।

বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজ অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তারা বলেছেন, তিন মাসে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তারা। তারা বলেন, অতীতে নীতিমালা অনুযায়ী ভর্তি করা হয়েছে। এখন হঠাৎ করে কেন এই অটোমেশন পদ্ধতি। পৃথিবীর কোনো দেশে মেডিক্যাল শিক্ষায় এই ধরনের নিয়ম নেই। নীতিমালা বাস্তাবয়ন করতে না পারাটা প্রশাসনের ব্যর্থতা। কেউ নীতিমালা না মানলে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আছে।     
 
নিয়মনীতি মেনে চলতে হবে। নীতিমালা বাস্তবায়ন না করে অটোমেশন পদ্ধতি চাপিয়ে দেওয়া হলো, তা-ও আবার নির্বাচনের বছরে। অনেকে ধারণা করছেন, নির্বাচনের বছরে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে একটি মহল কলকাঠি নাড়ছে। এটা কেন? এর পেছনে কারোর কোনো অসৎ উদ্দেশ্য আছে কি না, খতিয়ে দেখা জরুরি। 

এদিকে এমবিবিএস কোর্সে ভর্তির যোগ্যতার ক্ষেত্রে আগের নিয়ম বহাল রাখার দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজ অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএমসিএ)। একই সঙ্গে বিদেশি শিক্ষার্থীদের জীববিজ্ঞানে ন্যূনতম জিপিএ-৪-এর পরিবর্তে আগের মতো ৩.৫০ জিপিএ বহাল রাখার আবেদন জানিয়েছে সংগঠনটি। অন্যথায় ছাত্র হারাবে বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ, রাজস্ব হারাবে দেশ। বিদেশি শিক্ষার্থীরা অন্য দেশে পড়তে চলে যাবেন।

বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. এম এ মুবিন খান এবং সাধারণ সম্পাদক ড. আনোয়ার হোসেন খান এমপি বৃহস্পতিবার স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাছে এ বিষয়ে লিখিত আবেদন জানিয়েছেন। আবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২-২০২৩ শিক্ষাবর্ষে বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে এমবিবিএস কোর্সে দেশি শিক্ষার্থী ভর্তি পরীক্ষায় সরকারি নিয়মে উত্তীর্ণ সব শিক্ষার্থীদের সাংবিধানিকভাবে তাদের মৌলিক অধিকার বহাল রেখে ভর্তির সুযোগ প্রদান করতে হবে। একই সঙ্গে বিদেশি শিক্ষার্থীদের জীববিজ্ঞানে হঠাৎ করে এককভাবে ন্যূনতম জিপিএ-৪-এর পরিবর্তে আগের মতো ৩.৫০ জিপিএ বহাল রাখতে হবে। 

২০২২-২০২৩ শিক্ষাবর্ষে বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে দেশি ও বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির বিষয়ে বিপিএমসিএ তাদের আবেদনে পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন। আবেদনে বলা হয়েছে, মেডিক্যালে ভর্তি পরীক্ষায় ১ লাখ ৪০ হাজার পরীক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেছেন। এর মধ্যে সরকার নির্ধারিত নিয়ম প্রতিপালন করে নির্ধারিত পাশ মার্ক ৪০ নম্বর পেয়ে প্রায় ৪৯ হাজার শিক্ষার্থী উত্তীর্ণ হয়েছেন। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী তাদের বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের শূন্য আসনে ভর্তি হতে আইনগত ও মৌলিক অধিকার রয়েছে।

সরকার নির্ধারিত ভর্তির যোগ্য ঘোষিত শিক্ষার্থীকে ভর্তির সুযোগ না দিয়ে হঠাৎ নিয়ম পরিবর্তন করে ৩৫ হাজার পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের ভর্তির সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। এতে করে একজন উত্তীর্ণ ও সরকার কর্তৃক যোগ্য ঘোষিত প্রার্থীর সাংবিধানিকভাবে তাদের মৌলিক অধিকার বহাল রাখা সরকারের দায়িত্ব। নতুবা এতে সংক্ষুব্ধ হয়ে অনেকে বিজ্ঞ আদালতের শরণাপন্ন হতে পারেন এবং আইনি জটিলতা সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। মেডিক্যাল শিক্ষার কর্ণধার ও সংশ্লিষ্ট অনেকে এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় এ বিষয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। আবেদনে আরও বলা হয়েছে, মেডিক্যালে ভর্তি পরীক্ষা দেশে প্রথমে অনুষ্ঠিত হয়েছে। অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট এবং অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এখনো ভর্তি পরীক্ষা শেষ হয়নি। অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে যে, এসব প্রতিষ্ঠানে অনেক শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পেলে বেসরকারি মেডিক্যালে ভর্তি হবেন না এবং অনেকের আর্থিক সচ্ছলতা নেই। উল্লিখিত পরিস্থিতিতে সরকার কর্তৃক গত ১০-১২ বছরের চলমান নিয়ম হঠাৎ পরিবর্তন করলে অনেক বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজের আসন ফাঁকা থাকবে। তাই বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজ অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএমসিএ) উদ্বেগ প্রকাশ করছে। আবেদনপত্রে আরও বলা হয়েছে, দেখা যাবে যারা ভর্তির যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও মেডিক্যালে ভর্তির সুযোগ পাবেন না, তাদের মধ্যে অনেকে বিদেশে চলে যাবেন। যা বর্তমান প্রেক্ষাপটে অর্থাৎ ডলার-সংকটের সময়ে দেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতির কারণ হবে। আবার বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে যে, অনেক দেশের মেডিক্যাল শিক্ষার মান নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। রাশিয়া, চীন ও আরও অনেক দেশের রোগী ও রোগের প্যাটার্ন আমাদের চেয়ে ভিন্ন প্রকৃতির, তাই দেশে এসে ঐসব চিকিৎসকদের চিকিৎসা দিতে সমস্যায় পড়তে হয়।

বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির প্রায় ১০ বছরের চলমান নিয়ম হঠাৎ পরিবর্তন করে জীববিজ্ঞানে এককভাবে জিপিএ-৫-এর মধ্যে জিপিএ-৪ নির্ধারণ করা হয়। দেশের বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলোতে এ মুহূর্তে প্রায় ১২ হাজারের মতো বিদেশি শিক্ষার্থী এমবিবিএস পড়ছেন। যার ফলে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় হচ্ছে। ভারত ও নেপালে এমবিবিএস ভর্তির যোগ্যতায় জীববিজ্ঞানে জিপিএ ৩.০০ পয়েন্ট রয়েছে। এখানে জীববিজ্ঞানে জিপিএ ৪.০০ করাতে যেসব বিদেশি শিক্ষার্থী আসত, তারা অন্য দেশে পড়তে চলে যাবে। যার বিরূপ প্রভাব পড়বে দেশের চলমান সামগ্রিক অর্থনীতিতে এবং সেই সঙ্গে দেশ প্রায় ১০ (দশ) মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয়ের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে। এছাড়া আইনি জটিলতা তৈরি হতে পারে। বাংলাদেশের ভারতীয় দূতাবাস থেকে একটি প্রতিনিধিদল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ভারতীয় শিক্ষার্থীদের ভর্তি জটিলতা নিয়ে আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন এবং তারাও জীববিজ্ঞান এককভাবে ৩.৫০ জিপিএ বহাল রাখার কথা জানিয়েছে। এ অবস্থায় ২০২২-২০২৩ শিক্ষাবর্ষে বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে এমবিবিএস কোর্সে ভর্তি পরীক্ষায় যারা উত্তীর্ণ হয়েছেন, সাংবিধানিকভাবে আগের নিয়মে ভর্তি করে তাদের মৌলিক অধিকার বহাল রাখার জন্য জোর দাবি জানিয়েছেন নেতৃবৃন্দ। একই সঙ্গে বিদেশি শিক্ষার্থীদের জীববিজ্ঞানে আগের মতো ৩.৫০ জিপিএ নির্ধারণের জন্য বিশেষ অনুরোধ জানায় বিপিএমসিএ।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এডুকেশন বিভাগের শীর্ষ একজন কর্মকর্তা বলেন, আমরা এখনো হাইকোর্টের আদেশ পাইনি। অটোমেশন পদ্ধতিতে বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজে এমবিবিএস ভর্তির কার্যক্রম চলমান রয়েছে।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আবারো ভর্তি পরীক্ষা চালু হবে - dainik shiksha জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আবারো ভর্তি পরীক্ষা চালু হবে সরকারি-বেসরকারি স্কুলে ভর্তি: দুই দিনে আবেদন প্রায় দুই লাখ - dainik shiksha সরকারি-বেসরকারি স্কুলে ভর্তি: দুই দিনে আবেদন প্রায় দুই লাখ শিক্ষক নিয়োগেও নামকাওয়াস্তে মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা হয়: গণশিক্ষা উপদেষ্টা - dainik shiksha শিক্ষক নিয়োগেও নামকাওয়াস্তে মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা হয়: গণশিক্ষা উপদেষ্টা পাঠ্যপুস্তক থেকে শেখ মুজিব ও শেখ হাসিনার বিষয়বস্তু অপসারণের দাবি - dainik shiksha পাঠ্যপুস্তক থেকে শেখ মুজিব ও শেখ হাসিনার বিষয়বস্তু অপসারণের দাবি এসএসসির ফরম পূরণ শুরু ১ ডিসেম্বর - dainik shiksha এসএসসির ফরম পূরণ শুরু ১ ডিসেম্বর কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের গল্প - dainik shiksha পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের গল্প কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক পাঠ্যপুস্তকে একক অবদান তুলে ধরা থেকে সরে আসার আহ্বান হাসনাতের - dainik shiksha পাঠ্যপুস্তকে একক অবদান তুলে ধরা থেকে সরে আসার আহ্বান হাসনাতের ৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণির বাদপড়া শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ - dainik shiksha ৬ষ্ঠ ও ৮ম শ্রেণির বাদপড়া শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশনের সুযোগ দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0050210952758789