অধ্যক্ষ নিয়োগ হচ্ছে না চার বছর, মাদরাসা চালান বাবা-ছেলে

মির্জাগঞ্জ প্রতিনিধি |

পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জের সুবিদখালী দারুসসুন্নাত ফাজিল মাদরাসায় বিধি ও জ্যেষ্ঠতা না মেনে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দ্বায়িত্ব পালনের অভিযোগে উঠেছে এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে। কোনো নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা না করেই মাদরাসার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। এর আগের জ্যেষ্ঠতা না মেনে একই মাদরাসার অধ্যক্ষের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো তার বাবাকে। চার বছরের বেশি সময় ধরে মাদরাসায় অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ হচ্ছে না।

ওই এ সময় বাবা-ছেলে অবৈধভাবে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের পদে দায়িত্ব পালন করছেন। বিষয়টি জানাজানি হলে একজন সিনিয়র শিক্ষককে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব দেয়া হলেও তাকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়া হচ্ছে না। এ বিষয়ে মাদরাসার শিক্ষক-কর্মচারীরা উপজেলা নির্বাহী অফিসারসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।

মাদরাসার শিক্ষক কর্মচারীদের অভিযোগ ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দ থেকে মাদরাসায় অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ নিয়োগের কোনো উদ্যোগ না নেয়া হচ্ছে না। অবৈধভাবে সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মো. খাইরুল্লাহ ক্ষমতা পেয়ে মাদরাসার বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। 

অভিযোগে জানা যায়, ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ আগস্ট সুবিদখালী দারুসসুন্নাত ফাজিল মাদরাসার অধ্যক্ষ মো. শামসের আলী অবসরে যাওয়ার পরে জ্যেষ্ঠতা ভঙ্গ করে ও উপাধ্যক্ষকে বাদ দিয়ে মাদরাসা পরিচালনা কমিটি ও পরিচালনা কমিটির ক্ষমতাবলে মাদরাসার সহকারী অধ্যাপক মো. খলিলুর রহমানকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব দেয়া হয়। এরপরে তিনিও গত ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ ফেব্রুয়ারি অবসরে যাওয়ার পরে আবারও জ্যেষ্ঠতা ভঙ্গ করে ও সরকারি নিয়মকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তার ছেলে প্রভাষক মো. খায়রুল্লাহকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব দেয়া হয়। পরে বিষয়টি জানাজানি হলে মাদরাসার সিনিয়র শিক্ষক ও সহকারী অধ্যাপক (আরবী) মো. হাবিবুর রহমানকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব দেন। কিন্তু তাকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়া হয়নি। বাবা-ছেলে মিলে এই মাদরাসায় প্রায় চার বছর পর্যন্ত ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন।

ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধান অনুযায়ী কোনো মাদরাসার অধ্যক্ষের পদ শূন্য হলে পরবর্তী ৬ মাসের মধ্যে অধ্যক্ষের পদ পূরণ করার কথা থাকলেও নিয়োগ প্রক্রিয়ায় চার বছর অতিক্রম করেছে। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ পদে থেকে বাবা সহকারী অধ্যাপক মো. খলিলুর রহমান, ছেলে প্রভাষক মো. খলিলুর রহমান মাদরাসার ভর্তি ও ফরম পূরণে অতিরিক্ত ফি আদায়, বিভিন্ন পরীক্ষার ফল বিবরণী ও পরীক্ষার খাতা যাচাই-বাছাইয়ের ফি, ভর্তির অতিরিক্ত ফি, উপবৃত্তি ফি, স্টল ভাড়া, রেজিস্ট্রেশন ফিসহ নানাভাবে অতিরিক্ত টাকা আদায় করে তা আত্মসাৎ করেছেন।

মাদরাসা সূত্রে জানা যায়, মাদরাসায় বর্তমানে চারশ’র বেশি ছাত্র রয়েছেন। অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষসহ শূন্যপদ রয়েছে ১৫টি ও কর্মচারী ৫ জনের জায়গায় আছেন ২ জন। মাদরাসায় অধ্যক্ষ ও কমিটি না থাকায় শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগে জটিলতা রয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মাদরাসার একাধিক শিক্ষক দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, সরকারি নিয়মকে তোয়াক্কা না করে বিধি বর্হিভূতভাবে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হয়েছেন প্রভাষক মো. খায়রুল্লাহ। গত বছরের ২৫ মার্চ তিনি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিষ্ট্রারের স্বাক্ষর জাল করে ভুয়া কমিটি করেন এবং মার্চ থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ৫ মাসের বেতন বিলে অবৈধভাবে স্বাক্ষর করে আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছেন। অবসরে যাওয়া সাবেক অধ্যক্ষের ৩ লাখ টাকা ভুয়া ভাউচার করে তহবিলে জমা না দিয়ে নিজেই খরচ করেছেন। তাদের কারণে মাদরাসার শিক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। মাদরাসায় সরকারি ১৪টি কম্পিউটারসহ ল্যাব ছিলো। বর্তামানে ল্যাবের ভবন থাকলেও কম্পিউটার নেই। মাদরাসায় দান করা করা এয়ারকন্ডিশনার (এসি) চলছে সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের বাসভবনে। প্রতিষ্ঠানের জমিতে অগ্রিম টাকা নিয়ে ১৬টি স্টল নির্মাণ করেন এবং স্টলের ভাড়ার কোনো হিসাব নেই। সাবেক এই অধ্যাক্ষের নিজের নামেও একটি ও ভাইয়ের নামে দুইটিসহ ৩টি স্টল দখল করে আছেন এবং ভাড়ার টাকা জমা না দিয়ে বছরের পর বছর তা আত্মসাৎ করেন।

ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ থাকাকালীন ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারীদের চাকরি দেয়ার কথা বলে ঘুষ বাবদ টাকা তুলেছেন। ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ২০২১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত মাদরাসার আয়-ব্যয়ের কোনো হিসাব নেই। এ অনিয়ম জানাজানি হলে মাদরাসার শিক্ষক ও কর্মচারীদের চাপের মুখে গত বছর আগস্ট মাসে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মো. খাইরুল্লাহ মাদরাসার সিনিয়র শিক্ষক ও সহকারী অধ্যাপক (আরবী) মো. হাবিবুর রহমানকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব দেন। কিন্তু এখনও তাকে মাদরাসার কোনো চার্জ বুঝিয়ে না দিয়ে সাবেক অধ্যক্ষ মো. খাইরুল্লাহ ভয়ভীতি দেখান ও বাবাকে গভর্নিং বডির সদস্য নেয়ার জন্য গোপনে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এছাড়া মাদরাসার সংযুক্ত এতিমখানায় তার বাবা সাবেক অধ্যক্ষ মো. খলিলুর রহমান ৪০ বছর সেক্রেটারি হিসেবে রয়েছেন।

জানতে চাইলে মাদরাসার সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মো. খাইরুল্লাহ দৈনিক শিক্ষাডটকমকে বলেন, অভিযোগ দেয়া হয়েছে বলে আমি শুনেছি। এটা মাদরাসার একটি পক্ষ আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। এখানে অনিয়মের কিছু নেই। মাদরাসার স্বার্থে পরিচালনা কমিটি আমাকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। আমি অধ্যক্ষের পদ ছেড়ে দিয়েছি। একজন শিক্ষক অসুস্থ ছিলেন তাই পরিচালনা কমিটি আমাকে যোগ্য মনে করেছেন বলে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব দিয়েছিলো। আর এখন আমি অধ্যক্ষের পদে নেই। যে দায়িত্বে আছেন তার কাছে জানতে চান। 

বর্তমান ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মো. হাবিবুর রহমান অভিযোগের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তিনি অভিযুক্তদের সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন। 

জানতে চাইলে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মো. রেজাউল কবীর বলেন, জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে মাদরাসায় ভারপ্রাপ্ত অধ্যাক্ষ নিয়োগ দিতে হবে। এটা না করে থাকলে বিধি না মেনে কাজ করেছে পরিচালানা কমিটি। এখানে সিনিয়দের বাদ দিয়ে প্রভাষককে অধ্যক্ষের দায়িত্ব দেয়া অন্যায়। 

উপজেলা নির্বাহী অফিসার সাইয়েমা হাসান বলেন, নীতিমালা বহির্ভূতভাবে কোনো পদের দায়িত্ব পেয়ে থাকলে ও অনিয়মের বিষয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
জোর করে প্রতিষ্ঠান প্রধানদের পদত্যাগ, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের করা হুঁশিয়ারি - dainik shiksha জোর করে প্রতিষ্ঠান প্রধানদের পদত্যাগ, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের করা হুঁশিয়ারি রাজনীতি করি না, ভবিষ্যতেও করবো না: ঢাবির নতুন ভিসি - dainik shiksha রাজনীতি করি না, ভবিষ্যতেও করবো না: ঢাবির নতুন ভিসি চার তারিখের মধ্যে মাদরাসা শিক্ষকদের এমপিওর আবেদন - dainik shiksha চার তারিখের মধ্যে মাদরাসা শিক্ষকদের এমপিওর আবেদন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন উপাচার্য অধ্যাপক আমানুল্লাহ - dainik shiksha জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন উপাচার্য অধ্যাপক আমানুল্লাহ দীপু-টিপু-রতন সিন্ডিকেটের ঘুষের সাম্রাজ্য - dainik shiksha দীপু-টিপু-রতন সিন্ডিকেটের ঘুষের সাম্রাজ্য এনসিটিবির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের শাস্তি দাবি বৈষম্যবিরোধীদের - dainik shiksha এনসিটিবির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের শাস্তি দাবি বৈষম্যবিরোধীদের কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0025579929351807