অনলাইন ক্লাস এবং কিছু প্রশ্ন

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

আমরা জ্ঞানী-গুণী-বিজ্ঞরা বৃহত্তর কল্যাণে অনেক সিদ্ধান্ত নিই, আবার অনেক সিদ্ধান্ত চাপিয়েও দিই। সেসব সিদ্ধান্তে হয়তো ৮০ শতাংশ সুবিধাভোগী আনন্দিত হন। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত ২০ শতাংশ দেয়ালে মাথা কুটে—তাদের প্রশ্নের উত্তর কেউ দেন না। এ দেশে শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষাঙ্গন বরাবরই গোবেচারা গোছের। সরকারিভাবে শিক্ষাঙ্গন পরিচালনার জন্য রাজনীতির বলয়ের বাইরে যোগ্য বিদগ্ধ শিক্ষাবিদদের আমরা কখনো পাইনি। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা তো একেবারেই অনুগত রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত। তাই সরকারি ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটানোর বাইরে মুক্তচিন্তা প্রকাশের তেমন সুযোগ এ অঞ্চলে নেই। সোমবার (৬ জুলাই) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত উপসম্পাদকীয়তে এ তথ্য জানা যায়।

উপসম্পাদকীয়তে আরও জানা যায়, ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা তো আমরা অনেক শুনেছি। এ ক্ষেত্রে অনেক উন্নতিও হয়েছে। ইন্টারনেট সেবা গ্রামগঞ্জেও পৌঁছে গেছে। ব্যাংকিং কাজ, কেনাকাটা, বিভিন্ন বিল দেওয়া অনেক কিছুই ঘরে বসে সম্পন্ন করা যাচ্ছে। অনেক স্কুলে ল্যাপটপ দেওয়া হয়েছে। দেওয়া হয়েছে মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর। এসবে শিক্ষার মান বেড়েছে। কিন্তু দেশের শিক্ষাব্যবস্থার দেখভাল যাঁরা করেন তাঁদের কাছে কি পরি্সখ্যান রয়েছে কত শতাংশ স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী আর শিক্ষকের কাছে এই সেবা পৌঁছেছে? সংখ্যাটি নিশ্চয়ই খুব বড় হবে না। অনেক ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসগুলোতে মাল্টিমিডিয়ার মাধ্যমে শিক্ষকরা তাঁদের ক্লাস তৈরি করছেন। তবে এসব জ্ঞান আর অনলাইন ক্লাস নেওয়া এক কথা নয়। করোনা মহামারির মুখোমুখি হওয়ার আগে আমাদের বেশির ভাগ স্কুল-কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীর কাছে অনলাইন ক্লাস নেওয়াটা অপরিচিত ছিল। ‘গুগল ক্লাসরুম’, ‘গুগল জুম’—এসব শব্দের সঙ্গে অনেকেরই পরিচয় ছিল না। প্রয়োজন পড়েনি বলে এই প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত হননি বড়সংখ্যক শিক্ষক-শিক্ষার্থী। প্রশিক্ষণের প্রশ্ন তো আরো পরে।

করোনাকালে তিন থেকে চার মাস সব কিছু স্থবির হয়ে আছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সব বন্ধ। কবে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরবে কেউ জানে না। তাই শিক্ষার্থী ও শিক্ষার ভবিষ্যৎ নিয়ে দায়িত্বশীল অনেকেই চিন্তিত। এরই মধ্যে বিত্তবৈভবে এগিয়ে থাকা প্রথম শ্রেণির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনলাইন ক্লাস-পরীক্ষা নেওয়া শুরু করেছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছেন যেসব অভিভাবক তাঁরা কমপক্ষে ১০-১২ লাখ টাকা সন্তানের পেছনে খরচ হবে ভেবেই প্রস্তুতি নিয়েছেন। তাই আর বাড়তি কিছু গেলেও সামাল দেওয়া যাবে। অমন জাহাজের সঙ্গে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক অনেকেই তাঁদের ডিঙি নৌকা বাঁধতে পারবেন না। তার পরও শিক্ষার্থীদের শিক্ষার ভবিষ্যৎ চিন্তা করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিধায়ক, ইউজিসি ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জ্ঞানী-প্রাজ্ঞ মানুষ অনলাইন ক্লাস চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। শিক্ষার্থীরা যাতে পিছিয়ে না পড়ে, সেশনজট যাতে না বাড়ে, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে যাতে হতাশা ছড়িয়ে না পড়ে, তাই এই মহৎ সিদ্ধান্ত। এর মধ্যে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছুসংখ্যক শিক্ষক ও শিক্ষার্থী অনলাইনে মাঝেমধ্যে ক্লাস নিচ্ছেন। কারো কারো ক্লাস ফরমাল নয়। বিভিন্ন একাডেমিক বিষয় নিয়ে আলাপচারিতা। একে অবশ্যই আমরা পজিটিভ বলব। আবার কেউ কেউ কোর্সভিত্তিক ক্লাস নিয়ে যাচ্ছেন ২০ থেকে ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থীকে বাইরে রেখেই। শিক্ষা বোর্ড, মন্ত্রণালয় আর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় তো আদেশ দিয়ে দিয়েছে অনলাইন ক্লাস নেওয়ার। কিন্তু আদেশদাতারা জরুরি কয়েকটি প্রশ্নের সমাধান না করেই এগিয়ে যাচ্ছেন।

যেমন ছাত্র-শিক্ষক অনেকেই অনলাইন ক্লাস নেওয়া এবং যুক্ত হওয়ায় প্রশিক্ষিত নয়। ধরে নিই দায়ে পড়ে শিখে নিলেন কিন্তু হাতের নাগালে অনেকেই নেই, চলে গেছেন যাঁর যাঁর বাড়িতে। অনেকেরই ল্যাপটপ নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় প্রোভিসি জানিয়েছেন, তাঁরা জরিপ করে দেখেছেন ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থীর হাতে স্মার্টফোন আছে, তাই ক্লাস নেওয়ায় অসুবিধা নেই। ধরে নিলাম ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থীর ফোন আছে। এই সত্যটি কেন এড়িয়ে যাচ্ছি, বাংলাদেশের সর্বত্র ইন্টারনেট সুবিধা সমান নয়। অনেক জায়গায় চলছে ধীরগতির নেট। এই গ্রীষ্মে বিদ্যুৎ বিভ্রাট ঘটছে অনেক জায়গায়। অনেক অভিভাবক ডাটা কিনে দেওয়ার সামর্থ্য রাখেন না। ঢাকার দুটি নামি সরকারি কলেজের শিক্ষক জানালেন, তাঁরা অনলাইন ক্লাসে ৫০ শতাংশের বেশি শিক্ষার্থীকে যুক্ত করতে পারছেন না।

আমি আমার কয়েকজন ছাত্র-ছাত্রীর প্রশ্নে বিব্রত। হতাশ হয়ে টেলিফোনে বলল, স্যার, নেট সমস্যা ও আর্থিক সমস্যার কারণে আমরা বঞ্চিত হব অনলাইন ক্লাস থেকে। ঠাকুরগাঁওয়ের এক অভিভাবক বললেন, করোনা পরিস্থিতি না থাকলে প্রতিকার চেয়ে তিনি উচ্চ আদালতে রিট করতেন। নেট সংকটে তাঁর মেয়েটি ক্লাসবঞ্চিত হবে। এমন বৈষম্য কি সংবিধানসম্মত?

আমি কম জানা মানুষ। নিজের জ্ঞানের এত খামতি নিয়ে এই অসহায় অভিভাবকের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিনি।

লেখক : এ কে এম শাহনাওয়াজ, অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ঢাকার তাপমাত্রা দেখে স্কুল বন্ধের সিদ্ধান্ত নয়: শিক্ষামন্ত্রী - dainik shiksha ঢাকার তাপমাত্রা দেখে স্কুল বন্ধের সিদ্ধান্ত নয়: শিক্ষামন্ত্রী আরো ৭২ ঘণ্টার হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha আরো ৭২ ঘণ্টার হিট অ্যালার্ট জারি ফাঁস হওয়া প্রশ্নেই প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা - dainik shiksha ফাঁস হওয়া প্রশ্নেই প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা এসএসসি পরীক্ষার ফল ১০ বা ১১ মে - dainik shiksha এসএসসি পরীক্ষার ফল ১০ বা ১১ মে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে কুমিল্লায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি ঘণ্টা চালুর নির্দেশ - dainik shiksha কুমিল্লায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি ঘণ্টা চালুর নির্দেশ দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে - dainik shiksha প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শনিবারের ছুটি বহাল থাকছে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0037119388580322