অনলাইন শিক্ষার বাস্তবতা ও সফলতা

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। দেশ হয়েছে ডিজিটাল। সেই ডিজিটালের ছোঁয়া ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। মানুষ এখন ঘরে বসেই অনলাইন সুবিধার মাধ্যমে করছে ব্যবসা-বাণিজ্য, লেনদেনসহ ব্যাংকিং সব কার্যক্রম। এরই ধারাবাহিকতায় শিক্ষাব্যবস্থায় করা হয়েছে আধুনিকায়ন। শিক্ষাব্যবস্থা উন্নত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন স্কুল-কলেজে করা হয়েছে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম। দেওয়া হয়েছে ল্যাপটপ, কম্পিউটার। কিন্তু কথা হলো, শতকরা কত ভাগ স্কুল-কলেজ এই সুবিধা পেল, সেই পরিসংখ্যান কি আমাদের জানা আছে?

বিশ্ব মহামারি করোনা ভাইরাসের কারণে ১৭ মার্চ থেকে বাংলাদেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। শিক্ষাব্যবস্থা চালু রাখার জন্য বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনলাইন ক্লাস শুরু করে। শিক্ষার্থীরা জুম অ্যাপস, গুগল ক্লাসরুম, ফেসবুক রুম, ফেসবুক লাইভসহ বিভিন্ন সাইট ব্যবহার করে শিক্ষাকদের সঙ্গে অনলাইন ক্লাস করছে। ল্যাপটপ, কম্পিউটার, ট্যাব, স্মার্টফোনের মাধ্যমে তারা ক্লাসে অংশগ্রহণ করছে, পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করছে। এছাড়া সরকারিভাবে সংসদ চ্যানেলের মাধ্যমেও রেকর্ডিং করা ক্লাস করানো হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। অনাকাঙ্ক্ষিত এই পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা গৃহবন্দি সময়টাকে যেন অবহেলায় হারিয়ে না ফেলে, তাই অনলাইন ক্লাস সিদ্ধান্ত একটি সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত।

কিন্তু প্রশ্ন হলো, অনলাইন পদ্ধতিতে শিক্ষাগ্রহণের ব্যবস্থা কতটুকু মানসম্মত এবং শতকরা কত জন শিক্ষার্থী এই সুবিধা পাচ্ছে? দেশের প্রায় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ শিক্ষার্থী শুধু এই সুবিধার মাধ্যমে শিক্ষা গ্রহণ করছে। এর বহুবিধ কারণ থাকতে পারে।

আমি আমার স্কুল আলোক শিক্ষালয়ের কথাই বলতে পারি। আমাদের স্কুলের শিক্ষার্থীরা প্রায় সবাই সুবিধাবঞ্চিত শিশু। এরা সবাই স্বল্প আয়ের পরিবারের সদস্য। তাদের কাছে কম্পিউটার তো দূরের কথা, স্মার্টফোন থাকাটা অনেকটা বিলাসিতার মতোই। যদিও ১০ শতাংশ শিক্ষার্থীর স্মার্টফোন থাকলেও সমস্যা রয়েছে ইন্টারনেট ব্যবহারের। সেক্ষেত্রে তাদের সম্ভব হচ্ছে না অনলাইনে ক্লাস করানো। এক্ষেত্রে আমরা এনালগ ফোনের মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। বাসায় পৌঁছে দিচ্ছি ওয়ার্কশিট, প্রশ্নপত্র। আবার ফোনের মাধ্যমে নিচ্ছি মৌখিক পরীক্ষা। মোবাইল কোম্পানি যেভাবে কলরেট বাড়িয়ে দিয়েছে, তাতে এই পদ্ধতি খুবই ব্যয়বহুল।

অনলাইন ক্লাসে যে সমস্যাগুলো উঠে এসেছে, তার একটি সংক্ষিপ্ত চিত্র যদি তুলে ধরা যায়। তাতে দেখা যাচ্ছে, শিক্ষার্থী অনলাইন ক্লাসে বসেই শিক্ষকের অগোচরে বিভিন্ন অ্যাপসের মাধ্যমে স্লিট স্ক্রিন সুবিধা গ্রহণ করে ক্লাসের ফাঁকে বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করে চলেছে। শিক্ষক কিছুই বুঝতে পারছেন না। এ যেন পাঠ্যবইয়ের ভেতরে উপন্যাসের বই লুকিয়ে পড়ার মতোই। ক্লাসের বাইরেও অন্য সময় শিক্ষার্থীরা পড়ে আছে অনলাইনে, ভার্চুয়াল জগতে। দিনের প্রায় দীর্ঘ একটা সময় অনলাইনে থাকার কারণে শিক্ষার্থীর চোখের সমস্যার পাশাপাশি দেখা দিচ্ছে অন্যান্য সমস্যা। ক্লাসে ছাত্রদের যে মনোযোগ বা আকর্ষণ পাওয়া যায়, অনলাইন ক্লাসে তা দেখা যায় না। এছাড়া ক্লাসে যেসব ছাত্র চুপচাপ বসে থাকে, অনলাইন ক্লাসে তারা আরো বেশি চুপ মেরে থাকে। ক্লাসে একটা বিষয়বস্তু বা ধারণা বোঝাতে যে সময় লাগছে, অনলাইনে অপেক্ষাকৃত বেশি সময় লাগছে, কখনো কখনো তা সাবলীল হচ্ছে না। কেননা, অনলাইন ক্লাস শব্দটি শিক্ষক-শিক্ষার্থীর কাছে একটি অপরিচিত শব্দ। গুগল ক্লাসরুম, ফেসবুক রুম শব্দের সঙ্গে পরিচয় ছিল না অনেকেরই। আর প্রয়োজন পড়েওনি কোনো দিন। আর এতে করে প্রশিক্ষণের অভাবে শিক্ষকেরা সাবলীলভাবে ক্লাস করাতে পারছেন না। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মুখোমুখি শিক্ষা প্রক্রিয়ার মনস্তাত্ত্বিক সুবিধা এতে নেই।

এছাড়া আরো একটি প্রকট সমস্যা হচ্ছে গ্রামাঞ্চল, দুর্গম ও চর এলাকায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত্ ও নেটওয়ার্কের সমস্যা। ঢাকাসহ অন্যান্য বিভাগীয় শহরে ইন্টারনেটের যে সুবিধা পাওয়া যায়, গ্রামে সেই সুবিধা নেই। দুর্বল নেটওয়ার্কের কারণে কখনো কখনো শিক্ষার্থীরা ক্লাস বুঝতে পারছে না, আবার অনেকে ক্লাসেই অংশগ্রহণ করতেই পারছে না। নিম্ন আয়ের মানুষের করোনাকালীন আয় ও তাদের সামর্থ্যের অভাবও এই অনলাইন ক্লাসের একটি বড় চ্যালেঞ্জ। বাড়ির একটিমাত্র আয়ের উত্স গাভি-গরু বিক্রি করে মেয়েকে অনলাইন ক্লাসের জন্য স্মার্টফোন কিনে দেওয়ার কথা আমরা শুনেছি। ঘরে বসে নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না, তাই গাছের ডালে বসে অনলাইনে ক্লাস করার সময় ডাল ভেঙে মাটিতে পড়ে হাত-পা ভাঙার কথা আমরা শুনেছি। এমন হাজারো সমস্যার দরুন অনলাইন ক্লাস সার্বজনীন সম্ভব হচ্ছে না।

তবু একটি কথা বলা যায়, ‘নেই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো’। রাজা ম্যাকগির ভাষায় বলতে হয়, ‘এতদিনের টানা ছুটিতে ওরা যাতে পড়াশোনার খেই হারিয়ে না ফেলে, সে জন্যই অনলাইন ভরসা।’ এটা শুধু সময়ের প্রয়োজনে। টানা ছয় মাসের ছুটিতে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা থেকে দূরে থাকলে ক্ষতির পাল্লাটা হয়তো আরো ভারী হতো।

সর্বোপরি, এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, দীর্ঘমেয়াদি এই অনলাইন শিক্ষাগ্রহণের ব্যবস্থা যে সার্বজনীন ও ফলপ্রসূ হবে না, তা সহজেই অনুমেয়। শিক্ষক-শিক্ষার্থী উভয়েই আজ স্কুলে বা বিদ্যালয়ে ফেরার স্বপ্নে বিভোর। ঘণ্টার সেই টুংটাং শব্দ অথবা বেলের ক্রিং ক্রিং আওয়াজে তালাবদ্ধ ক্লাসরুম একদিন মুখরিত হবে শিক্ষার্থীদের প্রাণচাঞ্চল্যে। বসন্তের মতো জেগে উঠবে স্কুলের খেলার মাঠ। দূষণমুক্ত পরিবেশে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সারিবদ্ধ হয়ে আবারও একদিন গলায় গলা মিলিয়ে সবাই একসঙ্গে গেয়ে উঠবে— ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি ...।

লেখক : শাওলিন আকতার, সহকারী শিক্ষক

সূত্র: ইত্তেফাক


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপের মৌখিক পরীক্ষা শুরু ৯ মে - dainik shiksha প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপের মৌখিক পরীক্ষা শুরু ৯ মে প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের নতুন নির্দেশনা - dainik shiksha প্রাথমিকের তৃতীয় ধাপে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের নতুন নির্দেশনা ঢাকার তাপমাত্রা দেখে স্কুল বন্ধের সিদ্ধান্ত নয়: শিক্ষামন্ত্রী - dainik shiksha ঢাকার তাপমাত্রা দেখে স্কুল বন্ধের সিদ্ধান্ত নয়: শিক্ষামন্ত্রী তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রির বেশি হলে স্থানীয়ভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হতে পারে - dainik shiksha তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রির বেশি হলে স্থানীয়ভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হতে পারে বঙ্গবন্ধুকে হারিয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিক্ষাখাত - dainik shiksha বঙ্গবন্ধুকে হারিয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শিক্ষাখাত আরো ৭২ ঘণ্টার হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha আরো ৭২ ঘণ্টার হিট অ্যালার্ট জারি কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0064730644226074