অনেক উপাচার্য একাডেমিক ও প্রশাসনিক পদ আঁকড়ে থাকেন

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫৩তম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে চ্যান্সেলর ও মহামান্য রাষ্ট্রপতি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান, গবেষণা, উপাচার্য ও শিক্ষার্থীদের নিয়ে যেসব কথা বলেছেন তা শুধু গুরুত্বপূর্ণই নয়, প্রণিধানযোগ্য। কথাগুলো তিনি সব বিশ্ববিদ্যালয়কে লক্ষ্য করে বলেছেন। তিনি বলেন, একজন উপাচার্যের মূল দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ও একাডেমিক কার্যক্রমের তত্ত্বাবধান, পরিচালন ও উন্নয়নকে ঘিরে। কিন্তু ইদানীং পত্রিকা খুললেই মনে হয় পরিবার-পরিজন ও অনুগতদের চাকরি দেওয়া এবং আর্থিক সুযোগ-সুবিধা নেওয়াই যেন কিছু উপাচার্যের মূল দায়িত্ব। শনিবার (২৬ নভেম্বর ) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত উপসম্পাদকীয়তে এ তথ্য জানা যায়।

উপসম্পাদকীয়তে আরও জানা যায়, আবার অনেক শিক্ষকও বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিটাকে ঐচ্ছিক দায়িত্ব মনে করেন। তিনি শিক্ষার্থীদের কাঙ্ক্ষিত সেবা দিতে ওয়ান স্টপ সেন্টার, কাউন্সেলিং অ্যান্ড সাপোর্ট সেন্টার, ক্যারিয়ার ইউনিট ইত্যাদি চালু করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে আহ্বান জানান।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার গুণগত মানের জন্য উপরোক্ত কাজগুলো করা আবশ্যিক বলে আমরা মনে করি। অন্যথায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সঠিক পথে পরিচালিত হওয়া এবং উপযুক্ত গ্র্যাজুয়েট তৈরি করার কাজ থেকে দূরে থাকবে। আমাদের দরকার এমন একটি পরিবেশ, সেখানে নেতৃত্বের ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন একজন সৎ এবং নির্লোভ উপাচার্য। যাঁর নেতৃত্বে একটি শিক্ষার্থীবান্ধব বিশ্ববিদ্যালয় হবে। তিনি সব উপাচার্য সম্পর্কে নেতিবাচক কথা বলেননি। সব উপাচার্য উপরোক্ত কাজগুলো করেন তা-ও কিন্তু নয়। কিন্তু কারো কারো অভিযোগের জন্য উপাচার্যদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।

বিশ্ববিদ্যালয় একটি বড় প্রতিষ্ঠান, এখানে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিয়োগ দেওয়া একটি কাজ। এ কাজের কর্ণধার উপাচার্য স্বয়ং। তাঁর অধীনে অনেক নিয়োগ বোর্ড থাকে। এখানে ইচ্ছা করলে নিয়োগ বোর্ডকে প্রভাবিত করে নিজের পছন্দমতো প্রার্থীকে নিয়োগ দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। একসময় শুধু মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হতো। কিন্তু বর্তমানে অনেক বিশ্ববিদ্যালয় লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ সম্পন্ন করে। এতে করে স্বচ্ছতার জায়গা একটু তৈরি হয়েছে। তার পরও মৌখিক পরীক্ষায় ইচ্ছা করলে অনিয়ম করা যায়। নিয়োগ বোর্ড তৈরি প্রসঙ্গে অনেক অভিযোগ রয়েছে। অনেকে বলেন, উপাচার্য নিজের পছন্দমতো লোক নিয়ে বোর্ড গঠন করেন, যদিও এখানে অনেক ক্যাটাগরি থাকে। ইচ্ছা করলেও নিজের মতো করে সব কিছু সাজানো যায় না। কিন্তু যেহেতু তিনি কর্ণধার, সেহেতু প্রভাব থাকতেই পারে। আবার নিজের স্বজন মেধাবী হলেও তাঁকে নিয়োগ দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। তাই এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।

অতি সম্প্রতি আমরা একজন উপাচার্যকে মেয়াদ শেষে শিক্ষকদের আন্দোলনের মুখোমুখি হতে দেখেছি। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিজের স্বজনদের চাকরি দেওয়ার গুরুতর অভিযোগ নিয়ে বিদায় নিয়েছেন, যা মোটেই কাম্য ছিল না।

অনেক উপাচার্যকে দেখা যায় নিজেই বিভিন্ন একাডেমিক ও প্রশাসনিক পদ আঁকড়ে থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনিয়র শিক্ষক থাকুন আর না-ই থাকুন এ কাজটি তিনি করেন। কখনো নিয়ম-নীতির ব্যত্যয় ঘটিয়ে কিংবা সিনিয়র শিক্ষক নেই এমন অজুহাতে তিনি কাজটি করেন। সুবিধা হলো, এ কাজে নিয়োগ বোর্ডকে প্রভাবিত করা সহজ। আরেকটি কারণ হতে পারে বিভিন্ন পদে থাকলে একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের ভাতা পাওয়া যায়। উপাচার্য একটি সম্মানীয় পদ। তাঁর বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ অসম্মানেরও বটে। একজন উপাচার্য এমন অসম্মানের কাজটি কেন করবেন? একজন সহকর্মী জুনিয়র হলেও তাঁকে সুযোগ দেওয়া উচিত, যাতে কাজ শিখতে পারেন। নচেৎ ভবিষ্যতে বড় বড় দায়িত্ব কিভাবে পালন করবেন? চার বছর একজন উপাচার্যের জন্য একেবারে কম সময় নয়। তিনি যদি বিশ্ববিদ্যালয়কে নিজের ধ্যানে রাখেন, তাহলে এর অবকাঠামোগত ও একাডেমিক উন্নয়ন করা অসম্ভব নয়। কিন্তু তিনি যদি ব্যস্ত থাকেন কিভাবে স্বজনদের চাকরি দেওয়া যায় এবং বিভিন্ন পদ ধারণ করে আর্থিক সুবিধা, নিয়োগসহ অন্যান্য কাজকে প্রভাবিত করা যায়, তাহলে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন কিভাবে করবেন?

শিক্ষার্থীদের সেবাকে সহজীকরণের জন্য আমাদের অনেক কিছু করার আছে। আমরা অনলাইনে তাঁদের বিভিন্ন ফি আদায় করতে পারি। তাঁদের যাবতীয় কাগজপত্র অনলাইনে সাবমিট করার জন্য ডিজিটাল সেবার উন্নয়ন ঘটাতে পারি, যাতে তাঁরা তাঁদের সুবিধামতো সময় এ কাজগুলো করতে পারেন। নিজ বিভাগ, পরীক্ষা দপ্তর ও রেজিস্ট্রার দপ্তরে গিয়ে যেন তাঁদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে না হয়, তার জন্য সেবাকে সহজ করতে পারি। আমার জানা মতে, এমন কিছু সুবিধা কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় চালু করেছে, কিন্তু তা পূর্ণাঙ্গ নয়। সরকার যেখানে প্রতিটি স্কুলে বুলিং প্রতিরোধে একজন শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেওয়ার কথা চিন্তা করছে, সেখানে আমাদের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিটি বিভাগে ছাত্র উপদেষ্টার পদ পর্যন্ত নেই। প্রাতিষ্ঠানিক সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন সেবাটা থাকা জরুরি, যেখানে শিক্ষার্থীরা কথা বলার জন্য একটি স্পেস পান।

একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার জন্য আমাদের ভালো প্রস্তুতি দরকার, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বড় ভূমিকা পালন করবে। আমরা এমন গ্র্যাজুয়েট তৈরি করব, যাঁরা শুধু লেখাপড়ায় নাম্বার ওয়ান হবেন না, একজন মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন মানুষ হবেন। শুধু মোটা বেতনে চাকরিই করবেন না, পরিবার ও সমাজের উন্নয়নে মানবিক হবেন। আমরা এমন উপাচার্য চাই, যিনি শুধু একাডেমিক জ্ঞানেই নয়, সৎ, দক্ষ ও নেতৃত্বসম্পন্ন হবেন। তিনি যখন বিদায় নেবেন তখন শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা তাঁকে হাসিমুখে বিদায় জানাবেন। তাঁকে অনেকটা পালিয়ে বিদায় নিতে হবে না। তিনি কোনো অভিযোগ নিয়ে বিদায় নেবেন না, বরং তাঁর ভালো কাজের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেক সদস্য বছরের পর বছর তাঁকে স্মরণ করবেন।

লেখক : ড. নিয়াজ আহম্মেদ, অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষা কমিশনসহ আরো কিছু সংস্কারের পরিকল্পনা রয়েছে - dainik shiksha শিক্ষা কমিশনসহ আরো কিছু সংস্কারের পরিকল্পনা রয়েছে শাবিপ্রবির উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষকে শপথ পড়ালেন শিক্ষার্থীরা - dainik shiksha শাবিপ্রবির উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষকে শপথ পড়ালেন শিক্ষার্থীরা বায়তুল মোকাররমে দু‘পক্ষের সংর্ঘষ, আহত কয়েকজন মুসল্লি - dainik shiksha বায়তুল মোকাররমে দু‘পক্ষের সংর্ঘষ, আহত কয়েকজন মুসল্লি শর্তসাপেক্ষে এমপিও পাবেন বিপিএড শিক্ষকরা - dainik shiksha শর্তসাপেক্ষে এমপিও পাবেন বিপিএড শিক্ষকরা ঢাবিতে হ*ত্যার ঘটনায় ৬ ছাত্র আদালতে - dainik shiksha ঢাবিতে হ*ত্যার ঘটনায় ৬ ছাত্র আদালতে নির্যাতনে তোফাজ্জলের শরীর থেকে মাংস খসে পড়ে - dainik shiksha নির্যাতনে তোফাজ্জলের শরীর থেকে মাংস খসে পড়ে ১৩ চ্যালেঞ্জ শিক্ষাখাতের, অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি হচ্ছে - dainik shiksha ১৩ চ্যালেঞ্জ শিক্ষাখাতের, অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি হচ্ছে এমপিওভুক্ত হচ্ছেন আরো ১ হাজার ৮৮৭ শিক্ষক - dainik shiksha এমপিওভুক্ত হচ্ছেন আরো ১ হাজার ৮৮৭ শিক্ষক জাবিতে ছাত্রলীগ নেতা হত্যার ঘটনায় সমন্বয়কসহ ৮ শিক্ষার্থীর নামে মামলা - dainik shiksha জাবিতে ছাত্রলীগ নেতা হত্যার ঘটনায় সমন্বয়কসহ ৮ শিক্ষার্থীর নামে মামলা দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.00347900390625