অবৈধ অধ্যক্ষের বডি ম্যাসাজ

রুম্মান তূর্য |

কলেজের দুটি শ্রেণিকক্ষ দখল করে দীর্ঘদিন বসবাস করছেন অধ্যক্ষ। পাঁচ বছর ধরে প্রতিষ্ঠানের ফান্ড থেকে অবৈধভাবে বাড়িভাড়াও নিয়েছেন তিনি। একসময় প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের আপত্তির মুখে বেতনের সঙ্গে বাড়িভাড়া নেয়া বন্ধ করলেও ‘ভুয়া ভাউচার’ তৈরি করে ঠিকই তুলে নিয়েছেন সমপরিমান টাকা। তার বাসার ইউটিলিটি বিল পুরোটাই বহন করছে কলেজ। সব কাজের কাজি ওই অধ্যক্ষ প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের দিয়ে বডি ম্যাসাজও করিয়ে নেন।  

শিক্ষকদের অভিযোগ, নিজের সুবিধার জন্য সবাইকে তোপের মুখে রাখেন তিনি। প্রতিষ্ঠান প্রধান পদ থেকে পদত্যাগ করলেও অবৈধভাবে তিনি ওই পদেই রয়ে গেছেন। নিজের কর্তৃত্ব টিকিয়ে ওই অবৈধ অধ্যক্ষ শিক্ষকদের এমপিওভুক্তও করতেও চান না।

রাজধানীর উত্তরার নওয়াব হবিবুল্লাহ মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ওই অধ্যক্ষের নাম মো. শাহিনুর মিয়া। তার বিরুদ্ধে ওঠা এসব অনিয়মের অভিযোগ তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিলো মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর। গত ফেব্রুয়ারিতে শুরু হওয়া ওই তদন্ত শেষে প্রতিবেদন জমা দেয়া হলেও অদ্যাবধি কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। 
এসব বিষয়ে কথা বলতে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে অধ্যক্ষ মো. শাহিনুর মিয়া কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। পরোক্ষভাবে অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, প্রতিষ্ঠানে আসেন, বসে এক সঙ্গে চা খাই, তখন সব কথা হবে। 

শ্রেণিকক্ষেই বাস, বিল দেয় কলেজ 

পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষকরা দৈনিক আমাদের বার্তাকে জানান, ২০১০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে অধ্যক্ষ শাহিনুর মিয়া প্রতিষ্ঠানে বসবাস করছেন। ৪ হাজার ৫০০ বর্গফুটের যে বাসাটিতে তিনি থাকেন তা মূলত দুটি শ্রেণিকক্ষ। তৎকালীন গভর্নিং বডির রেজুলেশন জাল করে তিনি সেখানে বসবাসের অনুমতি নেন। মৃত সদস্যদের স্বাক্ষর জাল করে ভুয়া রেজুলেশন তৈরি করেন। ২০১০ থেকে ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি বাসাভাড়া দেননি। উল্টো বেতনের সঙ্গে কলেজ ফান্ড থেকে ৫০ শতাংশ বাসাভাড়া নিয়েছেন। ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন গভর্নিং বডি প্রতিষ্ঠানে বসবাস করেও বাসাভাড়া নেয়া নিয়ে আপত্তি তুললে তিনি বেতনের সঙ্গে আর বাসাভাড়া নিচ্ছেন না। তবে, হিসাবরক্ষক কামাল হোসেনকে দিয়ে বাসাভাড়ার সমপরিমান ভাউচার তৈরি করে প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা নিচ্ছেন। ২০১০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে তার বাসায় ইউটিলিটি বিলও দিচ্ছে কলেজ কর্তৃপক্ষ। পাঁচ সদস্যের পরিবারটি একাধিক এসি, ফ্রিজ ব্যবহার করলেও অধ্যক্ষের বাসার কোনো আলাদা মিটার নেই। এ খাতে ২০১০ থেকে ২০২২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ইউটিলিটি চার্জ বাবদ তিনি ১৪ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন।  

জাল-জালিয়াতিতে উপাধি পেয়েছেন ‘ভাউচারম্যান’ 

শিক্ষকদের অভিযোগ, জাল জালিয়াতিতে পারদর্শী এ অধ্যক্ষকে উত্তরার প্রতিষ্ঠান প্রধানরা ‘ভাউচারম্যান’ উপাধি দিয়েছেন। ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে বরখাস্ত করা হলেও হাইকোর্টে রিট করে তিনি ফের পদে বসেন। গভর্নিং বডি তখন তার কাছে বাড়িভাড়া চাইলে তিনি ভুয়া কাগজ বানিয়ে জমা দেন। 

শিক্ষকদের এমপিওভুক্তিতে অনিহা 

শিক্ষকরা দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, শিক্ষক-কর্মচারীদের এমপিওভুক্ত হতে দিচ্ছেন না তিনি। কৌশলে তিনি বারবার প্যাটার্নভুক্ত ও প্যাটার্নের বাইরে থাকা সব শিক্ষকের এমপিওভুক্তির আবেদন করেন, ফলে আবেদন রিজেক্ট হয়ে যায়। তিনি গত ১৯ বছর প্রতিষ্ঠানটিতে কর্মরত। তার সময়ে মাত্র ২ থেকে ৩ জন শিক্ষক-কর্মচারী এমপিওভুক্ত হতে পেরেছেন। প্রতিষ্ঠানে ভোকেশনাল শাখা এমপিওভুক্ত করতে তিনি ১১ জন শিক্ষক কর্মচারীর কাছ থেকে ২২ লাখ টাকা নিয়েছেন, কিন্তু এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগই নেননি। 

অবৈধ নিয়োগের অভিযোগ :

অধ্যক্ষ পদে মো. শাহিনুর মিয়ার বহাল থাকা অবৈধ বলে অভিযোগ করেছেন প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষকরা। তারা দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে প্রতিষ্ঠানটি  কলেজ শাখায় পাঠদানের অনুমোদন পায়। কিন্তু এর চার মাস আগেই অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ পান তিনি। ডিজির প্রতিনিধি না থাকায় তার নিয়োগ বাতিল করা হয়েছিলো। পরে তিনি প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেখান। 

কর্মচারীদের দিয়ে বডি ম্যাসাজ 

শিক্ষকরা বলছেন, চাকরি থেকে বাদ দেয়ার ভয় দেখিয়ে বেলাল নামে প্রতিষ্ঠানের এক গার্ডকে দিয়ে বডি ম্যাসাজ করান অধ্যক্ষ। কর্মচারীরা অধ্যক্ষের বাসার কাঁচা বাজার, জামা কাপড় ধোয়া, রান্না ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ করেন। আমাদের বার্তার হাতে আসা এক ভিডিওচিত্রে দেখা যায়, একজন কর্মচারী অধ্যক্ষের শরীর ম্যাসাজ করে দিচ্ছেন। 

দোকান ভাড়ার টাকা আত্মসাতের অভিযোগ 

শিক্ষকরা বলছেন, মো. শাহিনুর মিয়া ক্যাম্পাসের উত্তর-পশ্চিম পাশে ১০০ বর্গফুট আয়তনের দুটি দোকান ভাড়া দিতে ১০ লাখ টাকা অগ্রীম নিয়েছেন। প্রতিমাসে দোকান দুটি থেকে ৪০ হাজার টাকা ভাড়া তোলেন তিনি। ক্যাম্পাসের পূর্বদিকের গেট সংলগ্ন ১৬০ বর্গফুট আয়তনের দোকানের মাসিক ভাড়া নেন ৩০ হাজার টাকা। এজন্য অগ্রীম নিয়েছেন ৩ লাখ টাকা। এছাড়া প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক ভবনের চতুর্থ তলার ফ্লোর ভাড়া দিয়েছেন ঝিনুক ট্রেডার্স নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে। প্রতিষ্ঠানটির কাছে কলেজ কর্তৃপক্ষের ১৬ লাখ টাকা পাওনা ছিলো। কিন্তু অধ্যক্ষকে ৫ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে বিষয়টি সুরাহা করা হয়। 

তদন্ত কর্মকর্তা যা বললেন :

অধ্যক্ষ শাহিনুর মিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে অভিযোগ দিয়েছিলেন একজন অভিভাবক। দুদকের নির্দেশে গত ফেব্রুয়ারিতে সেসব অভিযোগ তদন্ত শুরু করে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর। গত ১০ ফেব্রুয়ারি এসব অভিযোগ তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় সবুজবাগ সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ শামীম আরাকে। 
অধ্যক্ষ শামীম আরা দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়েছে এক মাস আগে। তার ( অভিযুক্ত অধ্যক্ষ) বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে আমি ডিজি স্যারকে সরাসরি বলে এসেছি। 

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
গুচ্ছ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির কমপ্লেইন বক্স বন্ধ - dainik shiksha গুচ্ছ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির কমপ্লেইন বক্স বন্ধ পদত্যাগে বাধ্য করা অধ্যক্ষকে ফুলেল শুভেচ্ছায় ফেরালেন শিক্ষার্থীরা - dainik shiksha পদত্যাগে বাধ্য করা অধ্যক্ষকে ফুলেল শুভেচ্ছায় ফেরালেন শিক্ষার্থীরা শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফেরার আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার - dainik shiksha শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফেরার আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কম দামে বিটিসিএলের ইন্টারনেট দেয়া হবে: তথ্য উপদেষ্টা - dainik shiksha শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কম দামে বিটিসিএলের ইন্টারনেট দেয়া হবে: তথ্য উপদেষ্টা শিক্ষকের ছোড়া স্কেলের আঘাতে শিক্ষার্থীর চোখ হারানোর অভিযোগ - dainik shiksha শিক্ষকের ছোড়া স্কেলের আঘাতে শিক্ষার্থীর চোখ হারানোর অভিযোগ দুই শিক্ষকের বহিষ্কারের দাবিতে বাউবি শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ - dainik shiksha দুই শিক্ষকের বহিষ্কারের দাবিতে বাউবি শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ হলগুলোকে সন্ত্রাসমুক্ত করে ছাড়বো : রাবি উপাচার্য - dainik shiksha হলগুলোকে সন্ত্রাসমুক্ত করে ছাড়বো : রাবি উপাচার্য কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0041830539703369