অভিজ্ঞতা নেই তবুও জাতীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বে আমলারা

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

দেশের জাতীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর বড় একটি অংশ পরিচালিত হচ্ছে সরকারি আমলাদের দিয়ে। তাদের অনেকেরই আবার সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রায়োগিক অভিজ্ঞতা নেই। শিক্ষাজীবনে পড়াশোনার ক্ষেত্রও ছিল পুরোপুরি ভিন্ন। কেউ কেউ পদাধিকারবলে আবার কেউ সরকারের নিয়োগের ভিত্তিতে এসব প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।  অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, অন্তত এক ডজনের মতো গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা সংস্থার নেতৃত্ব দিচ্ছেন সরকারি আমলারা। সম্পূর্ণ ভিন্ন খাতের অন্য একটি সংস্থা বা প্রকল্প পরিচালনার অভিজ্ঞতার জোরেই এসব সংস্থার নেতৃত্বে উঠে এসেছেন তারা।

দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদ, শিল্পোদ্যোক্তা, পরিকল্পনাবিদ, নীতিনির্ধারক, শিক্ষার্থী-শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত তথ্যসেবা দেয়ার জন্য স্থাপন করা হয়েছে বাংলাদেশ ন্যাশনাল সায়েন্টিফিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল ডকুমেন্টেশন সেন্টার (ব্যান্সডক)। মহাপরিচালক হিসেবে প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্বে রয়েছেন সরকারের অতিরিক্ত সচিব মীর জহুরুল ইসলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এ শিক্ষার্থী দশম বিসিএসে যোগদান করেন। মাঠ পর্যায়ে নানা দায়িত্ব পালনের পর তিনি চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের পরিচালক পদে ছিলেন। তার আগে ব্যান্সডকের মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন একজন অতিরিক্ত সচিব ও দুজন যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা।

নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন সরকারের যুগ্ম সচিব আবু হোরায়রা। এর আগে তিনি ২০২১ সালে রংপুরের গুচ্ছগ্রাম প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। পরে রংপুরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নভোথিয়েটার স্থাপন শীর্ষক প্রকল্পের পরিচালক ছিলেন। জাতীয় স্থানীয় সরকার ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন অতিরিক্ত সচিব সালেহ আহমদ মোজাফফর। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্টের মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন শিল্প মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ সালাউদ্দিন। 

দেশে মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ও দূর অনুধাবন প্রতিষ্ঠান (স্পারসো) প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৮০ সালে। মহাকাশবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান হলেও সংস্থাটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন একজন কৃষিবিদ। যদিও বিশ্বের অন্যান্য দেশে মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব দিচ্ছেন জ্যোতির্বিদরা। সম্প্রতি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত সফলভাবে চাঁদে মহাকাশযান উৎক্ষেপণের পর বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়। 

স্পারসোর বর্তমান চেয়ারম্যান মো. আব্দুস সামাদ বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারের পঞ্চদশ ব্যাচের কর্মকর্তা। স্পারসোয় যোগদানের আগে বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের পরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন তিনি। ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে যোগদানের পর কেন্দ্রীয় ও মাঠ প্রশাসনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য ডিগ্রি নিয়েছেন মানবসম্পদ উন্নয়ন, নীতিনির্ধারণী ধারণা, উন্নয়ন প্রশাসন, পরিবেশ উন্নয়ন ইত্যাদি বিষয়ে। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেইন ভূঁইঞা  বলেন, ‘‌ভারত চাঁদ জয় করছে এটা তো একদিনের প্রক্রিয়া না, ’৪৭ থেকে তাদের যাত্রা শুরু হয়েছে। স্পারসো শুরু হয়েছে আশিতে। এখানে একসময় বিজ্ঞানীরা দায়িত্ব পালন করতেন। এখন ব্যুরোক্র্যাটরা দায়িত্ব পালন করছেন। ব্যুরোক্র্যাট খুবই কম থাকে। এখন কেন দেয়া হয়েছে, তা আমার জানা নেই। একটা প্রতিষ্ঠানে কারা দায়িত্ব পালন করবে এটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।’ 

বাংলাদেশ শিল্প কারিগরি সহায়তা কেন্দ্রের (বিটাক) মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্বে আছেন আনোয়ার হোসেন চৌধুরী। এর আগে তিনি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন। শেখ হাসিনা জাতীয় যুব উন্নয়ন ইনস্টিটিউটে মহাপরিচালক পদে দায়িত্ব পালন করছেন বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) প্রশাসন ক্যাডারের ১৫তম ব্যাচের কর্মকর্তা আবু তাহের মো. মাসুদ রানা। 

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবন ও কর্ম নিয়ে গবেষণার জন্য ১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয় নজরুল ইনস্টিটিউট। এ ইনস্টিটিউটের পরিচালকের দায়িত্বে রয়েছেন ১১তম বিসিএস ক্যাডারের কর্মকর্তা এএফএম হায়াতুল্লাহ। এর আগে তিনি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, লোকপ্রশাসন কেন্দ্র, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন দপ্তরে দায়িত্ব পালন করেছেন। মন্ত্রণালয়ে আসার আগে কুষ্টিয়া, কিশোরগঞ্জ, শেরপুরসহ বেশকিছু জায়গায় মাঠ পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করেন। পড়াশোনাও করেছেন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। তবে ২০১৫ সালের পর কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে তার কয়েকটি বই প্রকাশ হয়েছে।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্দেশ্য সরকারের নীতি নির্ধারণে সহায়তা করা। কিন্তু এসব জায়গায় বিশেষজ্ঞদের পরিবর্তে আমলাদের নিয়োগের প্রধান কারণ হলো সরকারের নির্দেশনা বাস্তবায়ন করা। এতে সরকারের নীতিনির্ধারণে যথাযথ সহায়তা না হলেও শুধু কিছু মানুষের পদের সংস্থান হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানগুলো যে উদ্দেশ্য নিয়ে গঠিত হয়েছিল, তা আর বজায় থাকেনি। এসব দুঃখজনক ঘটনা।’  

বাংলাদেশ ফলিত পুষ্টি গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের (বারটান) নির্বাহী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন সরকারের অতিরিক্ত সচিব মো. আব্দুল ওয়াদুদ। ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করলেও স্নাতকোত্তর করেন ব্যবসায় প্রশাসনে। তিনি কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী, ঢাকা মাস র‌্যাপিড ট্রানজিট উন্নয়ন প্রকল্পের মহাব্যবস্থাপক ও প্রকল্প পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। 

বাংলাদেশ রেশম গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন সরকারের যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা। সর্বশেষ এখানে পূর্ণাঙ্গ নিয়োগপ্রাপ্ত পরিচালক ছিলেন একেএম আমিরুল ইসলাম। বর্তমানে সংস্থাটির ভারপ্রাপ্ত পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন গবেষণা ও প্রশিক্ষণ শাখার পরিচালক মো. মামুনুর রশিদ। সরকার থেকে এখানে যুগ্ম সচিব পদমর্যাদারই কাউকে পূর্ণাঙ্গ নিয়োগ দেয়ার কথা রয়েছে। 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, ‘বিজ্ঞানবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রধানকে বিজ্ঞানী হতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। দেশ-বিদেশে এমন অনেক উদাহরণ আছে, যেখানে সরকারের ‍সুবিধাভোগী বা সরকারের সাহায্য নিয়ে চলে এমন প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে সরকারি কর্মকর্তাদের নিয়োগ দেয়া হয়।’ 

জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের (নিপোর্ট) মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন সরকারের অতিরিক্ত সচিব মো. শফিকুল ইসলাম। তিনি এর আগে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স একাডেমির পরিচালক হিসেবেও সাধারণত অতিরিক্ত সচিব বা যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার কাউকে নিয়োগ দেয়া হয়ে থাকে।  

পানি সম্পদ পরিকল্পনা সংস্থার (ওয়ারপো) মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন মো. রেজাউল মাকছুদ জাহেদী। তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগের মহাপরিচালক এবং সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের উপসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। নানা সময়ে তিনি লোকপ্রশাসন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, প্রকল্প ব্যবস্থাপনা বিষয়ে ডিগ্রি নিয়েছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘প্রত্যেকটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে গবেষকরা নেতৃত্ব দেবেন, সিদ্ধান্ত নেবেন, নীতি নির্ধারণ করবেন, এমনটাই হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, গবেষকরা নেতৃত্ব না দিয়ে সরকারি আমলারা এখানে চলে আসছে। এটা রাষ্ট্রের জন্য সুখকর কিছু নয়। আমাদের রাষ্ট্রীয় কাঠামো এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সর্বত্রই আমলাতন্ত্রের জয়জয়কার।’ 

তিনি বলেন, ‘এটা বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়। রাষ্ট্রই এগুলোর জন্য দায়ী। এখানে জনগণের কাছে কোনো জবাবদিহিতা নেই। সবার জবাবদিহিতা একমাত্র সরকারের কাছে। যার কারণে যে যার মতো ইচ্ছা চালাচ্ছে এখানে।’

সূত্র : বণিক বার্তা


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
গুচ্ছ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির কমপ্লেইন বক্স বন্ধ - dainik shiksha গুচ্ছ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির কমপ্লেইন বক্স বন্ধ পদত্যাগে বাধ্য করা অধ্যক্ষকে ফুলেল শুভেচ্ছায় ফেরালেন শিক্ষার্থীরা - dainik shiksha পদত্যাগে বাধ্য করা অধ্যক্ষকে ফুলেল শুভেচ্ছায় ফেরালেন শিক্ষার্থীরা শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফেরার আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার - dainik shiksha শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফেরার আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কম দামে বিটিসিএলের ইন্টারনেট দেয়া হবে: তথ্য উপদেষ্টা - dainik shiksha শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কম দামে বিটিসিএলের ইন্টারনেট দেয়া হবে: তথ্য উপদেষ্টা শিক্ষকের ছোড়া স্কেলের আঘাতে শিক্ষার্থীর চোখ হারানোর অভিযোগ - dainik shiksha শিক্ষকের ছোড়া স্কেলের আঘাতে শিক্ষার্থীর চোখ হারানোর অভিযোগ দুই শিক্ষকের বহিষ্কারের দাবিতে বাউবি শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ - dainik shiksha দুই শিক্ষকের বহিষ্কারের দাবিতে বাউবি শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ হলগুলোকে সন্ত্রাসমুক্ত করে ছাড়বো : রাবি উপাচার্য - dainik shiksha হলগুলোকে সন্ত্রাসমুক্ত করে ছাড়বো : রাবি উপাচার্য কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.015283107757568