অভিন্ন নীতিমালা হলেই কি শিক্ষার মানোন্নয়ন হবে

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

ইউজিসির মতে, রাজনৈতিক প্রভাব ও অর্থের বিনিময়ে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের লাগাম টানতে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা এবং ডামি ক্লাসের বিধান রেখে অভিন্ন শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালার খসড়া চূড়ান্ত করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। ইউজিসির কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমানে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যদের পছন্দের প্রার্থীরাই নিয়োগ পাচ্ছেন। কিভাবে এ নীতিমালা দিয়ে রাজনৈতিক প্রভাব ও দুর্নীতির লাগাম টানা যাবে, তা অনেকের কাছেই বোধগম্য নয়। যদিও এ নীতিমালায় রাজনৈতিক প্রভাব ও উপাচার্য বা উপ-উপাচার্যদের স্বেচ্ছাচারিতা নিয়ন্ত্রণ করতে কোনো কিছু উল্লেখ নেই। তবে এ ধরনের নীতিমালা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্বায়ত্তশাসনের পরিপন্থী বলে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যায়গুলোর শিক্ষকরা এরই মধ্যে তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। রোববার (১৫ সেপ্টেম্বর) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।

ইউজিসির ভাষ্য মতে, ‘শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তৈরি হবে। এর পরপরই লিখিত পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। এদিনই ভাইভা ও ডামি ক্লাসের মাধ্যমে পরীক্ষার সব প্রক্রিয়া শেষ হবে। ওই দিনই ফলাফল প্রকাশের মাধ্যমে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা হবে।’ গ্রেড পয়েন্ট বাড়িয়ে আর লিখিত পরীক্ষা নিয়ে ইউজিসি কাদের লাগাম টানতে চাচ্ছে? এসব করে বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যদের পছন্দের প্রার্থীদের নিয়োগ বন্ধ বা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে বলে মনে হয় না। নির্ধারিত ৩.৫ বা তার ওপরে পাওয়া প্রার্থীদের মধ্যে কি আস্থাভাজন প্রার্থী থাকতে পারেন না বা তৈরি করা যাবে না? আবেদনকারীর মধ্য থেকে যে অর্থের বিনিময়ে কাউকে নিয়োগ দেওয়া যাবে না, সেটির নিশ্চয়তা কে দেবে? সাজানো প্রশ্ন দিয়ে পছন্দের প্রার্থীকে সুযোগ দিয়ে কি স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা যাবে? এর মধ্যে যে অসৎ উদ্দেশ্য অন্তর্নিহিত, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

 যে শিক্ষার্থী প্রায় দুই শতাধিক ছোট-বড় স্নাতক পরীক্ষায় নিজেকে প্রমাণ করে প্রথম, দ্বিতীয় বা তৃতীয় হয়েছেন, তাঁকে মাত্র ১০০ নম্বরের একটি পরীক্ষায় অযোগ্য প্রমাণ করবেন, এটি কেমন করে হয়? আবার কোনোভাবে ৩.৫ পাওয়া দশম শিক্ষার্থীটি হঠাৎ আয়োজিত একটি পরীক্ষায় নিজেকে পণ্ডিত প্রমাণ করবেন, তা-ও কী করে হয়? তবে শিক্ষার্থী প্রতিবন্ধী কি না এবং ডেলিভারি কী রকম, তা অবশ্যই যাচাই হতে পারে, তবে তা আসল বিষয়কে ছাপিয়ে নয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা অন্য পেশার মতো না যে আপনি ৯টা-৫টা করবেন বা সময় বেঁধে দেবেন। যাঁরা ফুলটাইম দলীয় রাজনীতি ও লেজুড়বৃত্তি করেন তাঁরা যদি অন্য কোথাও ক্লাস না নেন বা কনসালট্যান্সি না করেন, তাহলে তাঁদের সময়টাকে কিভাবে দেখবেন? আর যাঁরা ঠিকমতো ক্লাস নেন ও মানসম্পন্ন গবেষণা করে দিনরাত পরিশ্রম করছেন, তাঁদের মূল্যায়ন কিভাবে হবে? এ বিষয়গুলো কোন নীতিমালায় আছে?

ইউজিসির চেয়ারম্যান বলেন, ‘শিক্ষার মান বজায় রাখতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একই মানে উন্নীতকরণের চেষ্টা করা হচ্ছে এবং শিক্ষক নিয়োগ নীতিমালা কার্যকর হলে গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয়ে শিক্ষকদের গবেষণার প্রবণতা বাড়বে এবং মানসম্পন্ন শিক্ষার পরিবেশ তৈরি হবে।’ গবেষণাপিপাসু শিক্ষকদের এখনো গবেষণাপ্রবণতা যথেষ্ট আছে, যেটি নেই সেটি হচ্ছে পর্যাপ্ত গবেষণা অনুদান ও মূল্যায়ন। ইউজিসির দেওয়া মাত্র দু-তিন লাখ টাকা (যার মাত্র এক-তৃতীয়াংশেরও কম ব্যয় করার সুযোগ থাকে গবেষণাকাজে) দিয়ে মানসম্মত গবেষণা কতটুকু হবে, নীতিমালা প্রণয়নকারীদের কাছে সে প্রশ্ন করা যেতেই পারে। অধিকন্তু শিক্ষক ও গবেষক যাঁদের পিএইচডি ও পোস্টডক্টরাল ট্রেনিং গুরুত্বপূর্ণ, তাঁদের এসব কাজে যেখানে অনুপ্রেরণা জোগানোর কথা, সেখানে পিএইচডি ইনক্রিমেন্ট বন্ধ করা, শিক্ষা ও গবেষণা জনিত শিক্ষাছুটিতে প্রতিবন্ধতকা তৈরি করা হচ্ছে। শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য যেখানে যুগোপযোগী কোর্স-কারিকুলাম, সিলেবাস, ব্যাবহারিক জ্ঞানসমৃদ্ধ করতে যুগোপযোগী গবেষণাগার ও গবেষণা, শিক্ষক নিয়োগে স্বচ্ছতা ও উন্নত প্রশিক্ষণ নিয়ে গুরুত্ব থাকার কথা, সেখানে শিক্ষকদের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে উঠেপড়ে লাগা হচ্ছে। সমস্যার প্রকৃত সমাধান না খুঁজে অযাচিত নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলে শিক্ষার মানোন্নয়ন কখনোই সম্ভব নয়। শিক্ষকদের গবেষণায় পর্যাপ্ত অনুদান, প্রণোদনা, স্বীকৃতি ও মূল্যায়ন না হলে জোর করে কোনো কিছুই আদায় করা যাবে না। শিক্ষকদের নৈতিকতা ধরে রাখতে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা প্রদান সাপেক্ষে জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ শিক্ষকদের মর্যাদা ও সুযোগ-সুবিধার বিষয়ে আলাদা পে স্কেলের কথা বলা হলেও তার বাস্তবায়ন হচ্ছে না।

সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপাচার্যদের নিয়ে তদন্ত প্রতিবেদন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। বিভিন্ন সময় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনিয়ম ও দুর্নীতির খবরও পাওয়া যায়। এগুলোর সঙ্গে কারা জড়িত, নিয়োগ বাণিজ্য কিভাবে হয়, তা-ও দেশবাসীর অজানা নয়। যাঁরা এসব করেন তাঁদের বিষয়ে অভিন্ন নীতিমালা করা জরুরি। নিয়োগ যদি সঠিক দিতে হয়, তাহলে এই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের লাগাম আগে টানতে হবে। সাধারণ শিক্ষক যাঁরা শিক্ষা ও গবেষণা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, তাঁদের লাগাম না টেনে নিয়োগ বোর্ডকে কিভাবে স্বচ্ছ করা যায়, জবাবদিহিমূলক করা যায়, সেটির জন্য নীতিমালা হলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় আগামী দিনগুলোতে উপযুক্ত প্রার্থীকে নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হবে।

কোনো শিক্ষক যদি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন না করেন, সেটি দেখার জন্য সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী উপাচার্য তো আছেন। বিষয়টি চাইলে ইউজিসিও মনিটর করতে পারে। দু-চারজনের জন্য কি অভিন্ন নীতিমালা প্রয়োজন আছে? দায়িত্ব পালন নিয়ন্ত্রণ করা আর মেধা ও যোগ্যতা দিয়ে কারো কিছু অর্জনকে নিয়ন্ত্রণ বা বঞ্চিত করা নিশ্চয়ই এক বিষয় নয়। ১২ বছরে যদি কোনো কোনো ক্যাডার থেকে ১ নম্বর গ্রেডে যাওয়া যায়, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যোগ্যতা অর্জন করলেও তাঁদের ঠেকাতে হবে কেন? শিক্ষকদের শিক্ষাছুটি, পদোন্নয়ন অন্যান্য পেশার মতো কখনোই হবে না। তাই অন্য ক্যাডারের বা পেশার সঙ্গে তুলনা করে জাতীয় গ্রেড স্কেল পাওয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলে শিক্ষাব্যবস্থা হুমকির মুখে পড়বে। আর এ জন্যই শিক্ষকদের আলাদা পে স্কেল, গবেষণা সুযোগ-সুবিধাসহ আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এ উঠে এসেছে। শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন না করে গ্রেড পাওয়াকে নিয়ন্ত্রণ করলে শিক্ষার মানোন্নয়ন কখনোই আশা করা ঠিক হবে না।

দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার মান কখনোই সমান হবে না। যদি তা-ই হতো, তাহলে প্রতিযোগিতা এবং র্যাংকিংয়ের ব্যবস্থা থাকত না। হার্ভার্ড, এমআইটি, অক্সফোর্ডের শিক্ষক ও শিক্ষার গুণগত মান ও সুযোগ-সুবিধা সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার মান ও সুযোগ-সুবিধা কখনোই এক নয় এবং এটি সম্ভবও নয়। জানামতে, বিশ্বের কোথাও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে অভিন্ন নীতিমালা নেই, প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় নিজস্ব স্বকীয়তায় চলে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ন্যূনতম মান বজায় রাখতে হলে গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষক থাকা অবশ্যই প্রয়োজন। তাই শিক্ষক নিয়োগে ইউজিসি বা সরকারের একটি নির্দেশনা থাকা উচিত। যেমন—পিএইচডি ছাড়া বিশ্বের কোথাও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়া যায় না আবার পিএইচডি ও মানসম্মত গবেষণা প্রকাশনা ছাড়া কেউ কখনো অধ্যাপক হতে পারেন না। তবে পদোন্নয়ন, শিক্ষাছুটি ও আনুষঙ্গিক বিষয়গুলো নির্ভর করে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব আইন ও নিয়ম-নীতির ওপর। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক বডি, সিন্ডিকেট ও সিনেট রয়েছে নীতি নির্ধারণের জন্য প্রয়োজনে তারা সিদ্ধান্ত নেবে কিভাবে নিয়োগ ও পদোন্নয়ন আরো যুগোপযোগী করা যায়।

পিএইচডি ও উন্নত গবেষণা অভিজ্ঞতা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ কোনোভাবেই কাম্য নয়। আমরা সরাসরি সহকারী অধ্যাপক হিসেবে অভিজ্ঞ শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার সংস্কৃতি চালু করতে পারি এবং অস্থায়ীভাবে লেকচারার বা অ্যাসিস্ট্যান্ট লেকচারার নিয়োগ দিয়ে বিভিন্ন কোর্স পড়িয়ে নিতে পাড়ি। এমনকি পিএইচডি ও পোস্টডক্টরাল গবেষক দিয়েও সাময়িকভাবে কিছু কোর্স পড়ানো যেতে পারে। এতে যেমন বিশ্ববিদ্যালয় উপকৃত হবে, তেমনি ছুটি উপভোগের বিষয়টিও কমে আসবে।

মেধাবীদের মূল্যায়ন ও উপযুক্ত সুযোগ-সুবিধা না দিয়ে অযোগ্যদের মূল্যায়ন করে দেশের টেকসই উন্নয়ন কখনোই সম্ভব নয়। দলবাজি বা রাজনৈতিক পরিচয় যদি শিক্ষক ও শিক্ষার মূল্যায়ন এবং মূল্যায়নকারী বা নিয়ন্ত্রণকারীদের যোগ্যতা হয়, তাহলে এ শিক্ষা রক্ষা করা কঠিন হবে। শিক্ষার প্রকৃত মানোন্নয়ন করতে চাইলে বা বাংলাদেশকে স্বপ্নের কোনো দেশের সঙ্গে তুলনা করতে চাইলে সেই দেশের শিক্ষাব্যবস্থার পরিপূর্ণ প্যাকেজ নিয়ে আসতে হবে। তাহলে সমাধান সহজ হয়ে যাবে।

লেখক : ড. মো. সহিদুজ্জামান, অধ্যাপক, বাংলাদেশ কৃষি, বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস - dainik shiksha শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল - dainik shiksha সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0036730766296387