অরাজনৈতিক ব্যক্তিরা কেন এমপি হতে চায়

দৈনিক শিক্ষাডটকম ডেস্ক |

দৈনিক শিক্ষাডটকম ডেস্ক : অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও একটি জাতীয় মানবাধিকার কমিশন রয়েছে। এর কাজ মানবাধিকার লঙ্ঘনকে নিয়ন্ত্রণ করা। কিন্তু কমিশনের হাল-হকিকতটা কী? সাম্প্রতিক এক জরিপ বলছে, কাজকর্মের দিক থেকে এশিয়ার ৪৩টি দেশের মধ্যে আমাদের দেশের কমিশনটির স্থান নিচের দিক থেকে ঠিক প্রথম নয়, তবে দ্বিতীয়। প্রথম স্থানটি নিয়েছে আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী ও ঘনিষ্ঠতম মিত্র রাষ্ট্র ভারত। এটাও একটা সূচক বটে; মানবাধিকার ওই দুই দেশে কোন অবস্থায় রয়েছে, তারই সূচক। শুক্রবার (২৬ জানুয়ারি) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। নিবন্ধটি লিখেছেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।

নিবন্ধে আরো জানা যায়, মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন নামে একটি সংগঠন জানাচ্ছে, গত অক্টোবর মাসে রাজনৈতিক ‘অপরাধে’ গ্রেফতার হয়েছেন ২ হাজার ৫৩৮ জন, পরের মাসের সংখ্যা ২ হাজার ৬৬৩। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয় দেওয়া লোকদের হাতে গুম হয়েছেন অক্টোবরে ৯ জন, নভেম্বরে ১৬ জন। হেফাজতে মৃত্যুর সংখ্যা অক্টোবরে ১৬, নভেম্বরে ১০। আন্দোলন করতে গিয়ে পোশাক শ্রমিকের মৃত্যু ঘটেছে অক্টোবরে ১৬, নভেম্বরে ১১; আহত হয়েছেন শতাধিক (দ্য ডেইলি স্টার, ২ ডিসেম্বর)।

ভারতের জনগণের সঙ্গে আমাদের দেশের জনগণের সম্পর্ক পারস্পরিক মৈত্রী ও সহযোগিতার হবে– এটাই ছিল প্রত্যাশিত এবং স্বাভাবিক। সেটা যে হচ্ছে না, তার কারণ সেখানকার শাসকরা তা চায় না। কেন যে চায় না, তার ব্যাখ্যা খুঁজতে অন্যত্র না গেলেও চলে। তাদের মানবাধিকার কমিশনের দুর্দশার দিকে তাকানোই যথেষ্ট। রাষ্ট্রের কাজগুলো বিচ্ছিন্ন নয়; পরস্পর সংলগ্ন বটে। দেশের অভ্যন্তরে যদি মানবাধিকার বিপন্ন অবস্থায় থাকে, তাহলে প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে তার প্রতিফলন ঘটবে বৈকি। এটি তাই মোটেই অপ্রত্যাশিত নয় যে, ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন– পাকিস্তান ও বাংলাদেশ উভয় রাষ্ট্রের সীমান্তেই নজরদারি ও পাহারাদারি আরও জোরদার করা হবে। 

পাকিস্তান তো ভারতের আজন্ম শত্রু; আর বাংলাদেশ স্থায়ী মিত্র। সে অবস্থায় দু’জনকে সমান করে দেখা তখনই সম্ভব যখন দৃষ্টিতে ভ্রম ঘটে। ভারতের বহু নাগরিক বাংলাদেশে কাজ করেন। সংখ্যা নাকি দুই লাখ। আর বাংলাদেশ থেকে যারা ভারতে যেতে চান, তারাও চুরি-ডাকাতি করার জন্য নয়, কাজ করার ইচ্ছা নিয়েই যান। বৈধ এবং অবৈধ তো একটা কৃত্রিম ব্যবধান। জীবিকার অন্বেষণে ওপার থেকে এপারে আসাটা যদি অন্যায় না হয়, তবে এপার থেকে ওপারে যাওয়াটা অন্যায় হবে কেন? তবু অনবরত বলা হচ্ছে, বাংলাদেশ থেকে ‘অনুপ্রবেশকারীরা’ ভারতে ঢুকে ভারতের নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করছে।

সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া আছে। ওই বেড়াতে বিদ্যুৎও কাজ করে। সীমান্তে মারণাস্ত্র ব্যবহার না-করার ব্যাপারে দ্বিপক্ষীয় সমঝোতাও রয়েছে। তার মধ্যেই ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হাতে বাংলাদেশি মানুষদের নিহত হওয়ার সংবাদের তো কোনো বিরতি নেই। আর কাঁটাতারের বেড়াতে ফেলানীর সেই ঝুলন্ত লাশ তো একটি ঐতিহাসিক স্মৃতি হিসেবে আজও বিরাজমান। ফেলানীর মৃত্যুর স্মৃতি মুছে ফেলা তখনই যাবে, যখন উভয় দেশেই রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে প্রকৃত বন্ধুত্ব পুনঃস্থাপিত হবে; তার আগে নয়। 

বিশ্বের সবচেয়ে ধীরগতি শহর হিসেবে ঢাকা যে স্বীকৃতি পেয়েছে (সমকাল, ৩০ অক্টোবর), তাতে কেউই বিস্মিত হবেন না। তবে এ দেশে দুর্নীতি, অর্থ পাচার এবং নানাবিধ অপরাধ যে অসামান্য দ্রুতগতিতে চলে, সেটাও সমান সত্য। আদালতে বিচার পেতে বছরের পর বছর কেটে যায়। সাগর-রুনি হত্যার তদন্ত রিপোর্ট পেছানো সেঞ্চুরি করতে পারে বলে আমাদের আশঙ্কা ছিল; সে আশঙ্কাকে ভ্রান্ত প্রমাণিত করে ইতোমধ্যে তা পিছিয়েছে ১০৪ বার। 

আবার কিছু কিছু আপাত-স্থির জিনিস অত্যাশ্চর্য গতিতে ছোটে। যেমন বিএনপির একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতার মামলা। তিনি অভিযুক্ত হয়ে আটক হয়েছিলেন তথাকথিত ‘অগ্নিসন্ত্রাস’-এর এক মামলায়। তাঁর সঙ্গে যারা আটক হয়েছেন তাদের কারও জামিন হয়নি। কিন্তু মাত্র ২৪ ঘণ্টা সময়ের মধ্যে ওই বিএনপি নেতার মামলার শুনানি হলো। তিনি জামিন পেলেন; নিজ দল ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগ দিলেন এবং সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনে সরকারি দলের প্রার্থী হিসেবে জিতেও গেলেন। সিগন্যাল ক্লিয়ার থাকলে ট্রেন অমন দ্রুতগতিতেই ছুটতে পারে, আমাদের এই বাংলাদেশেও।

শুধু এই একটি ঘটনা নয় তো। বিএনপি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে দায়ের করা যেসব পুলিশি মামলা ঘুমিয়ে ছিল, সেগুলো যে কেবল দ্রুত জেগে উঠেছে, তাই নয়, ততোধিক দ্রুতগতিতে দৌড়ে বিচারের মুখোমুখি হয়ে দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত হয়ে অভিযুক্তদের কারাগারে ঢুকিয়ে দিয়েছে। যে নেতারা আগে মামলামুক্ত ছিলেন, তাদেরকে মামলাযুক্ত করে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে আটক করা হয়েছে। অন্যরা পুলিশের দ্রুতগামিতাকে কোনোমতে পরাজিত করে আত্মগোপনে চলে গেছেন। একটি সংবাদপত্র জানাচ্ছে, বিএনপি নেতাকর্মী হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছে।

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনটি যে এর আগের দুটি নির্বাচনের মতোই নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল থাকবে, তা আগেই বোঝা যাচ্ছিল। সরকারি দল এবং সে দল যাদের ‘ছাড়’ দিয়েছে, তারাই নির্বাচনে জয়ী হয়ে এসেছে। সংসদীয় গণতন্ত্রে একটি বিরোধী দল থাকা চাই; না-থাকলে চলে না। তাই এবারও সেটা আছে। তবে সেটি কোন দল, তাও সরকারের পক্ষ থেকেই ঠিক করে দেওয়া হচ্ছে। ভোট নিয়ে একটা যুদ্ধ হয়েছে, ঠিক। তবে এ যুদ্ধে বিজয় কতটা গ্রহণযোগ্য হয়েছে দেশে ও বিদেশে– সে প্রশ্ন রয়েই গেল।

তবে এটা সত্য হয়ে থাকবে, সংসদে নির্বাচিত হওয়ার অর্থ মস্ত বড় একটি সরকারি চাকরি পাওয়া, যে চাকরি ক্ষমতা ও অর্থ উভয়ই প্রাপ্তির মস্ত মস্ত সুযোগ এনে দেয়। সে জন্যই তো এত প্রার্থী, এত অর্থের আদান-প্রদান। ব্যবসায়ীরা তো আছেনই, থাকবেনও। তাদের লোকেরাও থাকবে। নামকরা ক্রিকেট খেলোয়াড়, অভিনেতা, গায়িকা, সাবেক আমলা– সবাই মহা উৎসাহী। কোনোকালে রাজনৈতিক কর্মের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না, ভুলেও জনগণের পাশে গিয়ে দাঁড়াননি, তাকে কী? গরমে বিলের পানি কমেছে; মাছেরা খলবল করছে; ধরতে ছুটবেন না– এমন বোকা এরা নন। নির্বাচন এক ধরনের খেলা বটে। 
তবে নির্বাচনী খেলায় তো একটি মাত্র দল থাকলে চলে না। এ খেলা তো অনেকটা ফুটবলের মতো; দু’পক্ষ ছোটাছুটি করবে। কে কয়টা গোল করতে পারে, তা দিয়েই মীমাংসা। 

তবে এবার অপর দল অনুপস্থিত দেখে যারা ভেবেছিলেন, প্লেয়ার বুঝি হায়ার করে আনতে হবে– তারা ভুল প্রমাণিত হয়েছেন। বহু প্লেয়ার তোষামোদ, তদবির করছেন; কান্নাকাটিও– খেলার মাঠে ঢোকার আশায়। টাকাও ঢালছেন। দলের ভেতর থেকে ‘স্বতন্ত্র’ প্রার্থীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় উৎসাহিত করা হয়েছে। এদের আগে ‘বিদ্রোহী’ বলা হতো এবং শাস্তি দেওয়া হতো দল থেকে বের করে দিয়ে। এবার বলা হয়েছে– এরা বিদ্রোহী নয়, স্বতন্ত্র বটে। স্বতন্ত্রভাবেই নির্ভয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। ফলে নির্বাচনে যারা জিতেছেন, তারা যেমন সরকারি দলের; তেমনি হেরেছেন যারা, তারাও সরকারি দলের। ব্যবস্থাটাকে অভিনব বলা কতটা ঠিক হবে, কে জানে!

লেকক : অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির মূল্যায়ন ও বার্ষিক পরীক্ষার নির্দেশনা - dainik shiksha ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির মূল্যায়ন ও বার্ষিক পরীক্ষার নির্দেশনা রাজশাহী কলেজে নতুন অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ - dainik shiksha রাজশাহী কলেজে নতুন অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ রাষ্ট্রের কাছে অতিরিক্ত নিরাপত্তা চাইনি : হাসনাত - dainik shiksha রাষ্ট্রের কাছে অতিরিক্ত নিরাপত্তা চাইনি : হাসনাত ছাত্র আন্দোলনে নিহত ৬৩১, আহত ১৯ হাজার - dainik shiksha ছাত্র আন্দোলনে নিহত ৬৩১, আহত ১৯ হাজার সৃজনশীলেই হবে ২০২৬ খ্রিষ্টাব্দের মাধ্যমিকের পরীক্ষা - dainik shiksha সৃজনশীলেই হবে ২০২৬ খ্রিষ্টাব্দের মাধ্যমিকের পরীক্ষা বিশ্ব শিক্ষক দিবসে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেসব কর্মসূচি - dainik shiksha বিশ্ব শিক্ষক দিবসে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেসব কর্মসূচি একাদশের রেজিস্ট্রেশন শুরু ১৫ সেপ্টেম্বর - dainik shiksha একাদশের রেজিস্ট্রেশন শুরু ১৫ সেপ্টেম্বর কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0023667812347412