অর্থনৈতিক সাংবাদিকতার পথিকৃৎ জাহিদুজ্জামান ফারুক

দৈনিক শিক্ষা ডেস্ক |

ফারুক ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুহসীন হলে। তিনি অর্থনীতি বিভাগে আমার দুই ব্যাচ সিনিয়র ছিলেন। যতদূর মনে পড়ে, ১৯৭২ সালে ছাত্র অবস্থায় ইত্তেফাকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংবাদদাতা হিসেবে সাংবাদিকতা শুরু করেন। তখন অর্থনীতি বিভাগের ছাত্রদের ঈপ্সিত পেশা ছিল সিভিল সার্ভিস, স্ব-শাসিত সংস্থা, ব্যাংক, নিদেনপক্ষে কলেজে শিক্ষকতার চাকরি। পছন্দের তালিকায় সাংবাদিকতা ছিল না। সাংবাদিকতা তখন করতেন ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে পাস করা ছাত্ররা (তখনো  গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ প্রতিষ্ঠা হয়নি) এবং দুর্জনদের মতে অন্য কোথাও চাকরি না পাওয়া গ্র্যাজুয়েটরা! ব্যতিক্রম ছিলেন মাহফুজ আনাম, আব্বাসউদ্দীন আফসারী ও ফারুক ভাই। ফারুক ভাই পড়াশোনা শেষ করে দৈনিক ইত্তেফাকে যোগ দেন এবং অর্থনীতিবিষয়ক সংবাদ ও নিবন্ধ লিখতে থাকেন। সোমবার (২৩ আগস্ট) বণিক বার্তা পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়। 

নিবন্ধে আরও জানা যায় সাংবাদিকতার মূল বিষয় ছিল তখন রাজনীতি, সিনেমা ইত্যাদি আর লেখকদের জন্য সাহিত্যের পাতা। এখনকার মতো, বণিক বার্তা বা দ্য ফাইন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের মতো অর্থনীতিবিষয়ক আলাদা পত্রিকা, এমনকি সংবাদপত্রে আলাদা ‘অর্থনীতির পাতা’ও ছিল না। মাহফুজ ভাই ও আফসারী ভাই সাংবাদিক হলেও তারা অর্থনীতি ছাড়াও নানা বিষয়ে লিখতে থাকেন। ফারুক ভাই মূলত অর্থনীতিবিষয়ক সাংবাদিকতায় নিয়োজিত হন।

তখনকার দিনে সবচেয়ে পাঠকপ্রিয় ও বিশ্বাসযোগ্য সংবাদপত্র ছিল দৈনিক ইত্তেফাক। রাজনৈতিক বিষয় ছাড়াও তখন দুটি কলাম খুব জনপ্রিয় ছিল। একটি ছিল ‘ওপেন সিক্রেট’, লিখতেন আবেদ খান এবং আরেকটি ‘অর্থনীতির হালচাল’, যা লিখতেন ফারুক ভাই।

মনে রাখতে হবে সত্তরের দশকে, যখন ফারুক ভাই অর্থনীতি বিষয়ে সাংবাদিকতা শুরু করেন তখন অর্থনীতিতে ব্যবহূত শব্দের বাংলা পরিভাষা পূর্ণাঙ্গ বই হিসেবে বের হয়নি, এর ব্যবহারও ব্যাপক নয়। বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থা ছিল সঙিন। তাছাড়া তখন সরকারের অর্থনীতিবিষয়ক সিদ্ধান্ত ছিল গোপনীয়তায় পরিবৃত। তাই তখন বাংলা ভাষায় অর্থনীতি বিষয়ে সাংবাদিকতা সহজসাধ্য ছিল না। যদিও তার প্রচেষ্টা সফল হয়নি, অর্থনীতি বিষয়ে বাংলায় প্রথম আলাদা পত্রিকা, আমাদের অর্থনীতি বের করার কৃতিত্ব তারই।     

এছাড়া একটি প্রজন্মকে তিনি অর্থনৈতিক বিষয়ে রিপোর্ট ও নিবন্ধ লেখায় প্রশিক্ষিত করে তোলেন। এদের কয়েকজন আমাকে বলেছেন, তারা ফারুক ভাইয়ের কাছে অর্থনীতি বিষয়ে সংবাদপত্রে লিখতে শিখেছেন। এসব কারণে তাকে আমি বাংলা ভাষায় এ দেশে অর্থনীতিবিষয়ক সাংবাদিকতার পথিকৃৎ বলে মনে করি।

পেশাগত জীবনে জাহিদুজ্জামান ফারুক ইত্তেফাকের ইকোনমিক এডিটর, দৈনিক অর্থনীতির সম্পাদক এবং জাপানের কিয়োডো নিউজ সার্ভিসের বাংলাদেশপ্রধান ছিলেন। তিনি ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ) এবং ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) স্থায়ী সদস্য ছিলেন। এছাড়া অর্থনীতিবিদদের সংগঠন বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির আজীবন সদস্য ছিলেন। 

জাহিদুজ্জামান ফারুক ১৯৫০ সালের ১ জানুয়ারি ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গায় এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬৮ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৭৩ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে অনার্স ও মাস্টার ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ওভারসিজ করেসপডেন্ট অ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশ (ওকাব) এবং সাউথ এশিয়ান ফ্রি মিডিয়া অ্যাসোসিয়েশন (সাফমা) বাংলাদেশের সভাপতি ছিলেন। এছাড়া নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির পরিচালনা বোর্ডের সদস্য, ইস্টার্ন হাউজিং সোসাইটির উপদেষ্টা কমিটির সদস্য ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের পরিচালক ছিলেন।

আমার সঙ্গে তার পরিচয় পেশাগত নয়, ব্যক্তিগত। সে সুবাদে তাকে ব্যক্তিগতভাবে আমার জানার সুযোগ হয়েছে। বিভাগে সিনিয়র ছাত্রের দাবিতে তিনি আমাকে স্নেহ করতেন এবং অর্থনীতির বিষয়-আশয় ও ব্যক্তিগত বিষয়ে পরামর্শ করতেন। সংবাদপত্র ছাড়াও তিনি চ্যানেল আইতে (তখন সিদ্ধেশ্বরীতে) শিল্প, বাণিজ্য ও অর্থনীতিবিষয়ক অনুষ্ঠান করতেন। টেলিভিশনের পর্দায় অনুষ্ঠানে হাজির হওয়ার ব্যাপারে আমার প্রবল অনীহা সত্ত্বেও কেবল ফারুক ভাইয়ের অনুরোধ ফেলতে পারিনি। তখন শিল্প, বাণিজ্য ও অর্থনীতি বিষয়ে তার গভীর জ্ঞানের সঙ্গে পরিচিত হই। অন্য কোনো চ্যানেল থেকে অনুযোগ করা হলে বলেছি, কেবল ফারুক ভাইয়ের জন্য সেখানে যাই। কেউ কেউ বলছেন, আপনার টিভি শোতে না থাকার নীতি কী হলো? হেসে তাদের বলেছি,  ‘ব্যতিক্রমই নিয়মের প্রমাণ’ (এক্সসেপশন প্রুভস দ্য রুল)। একই বাধ্যবাধকতার কারণে চিন্ময় মুত্সুদ্দির পরিচালনায় কয়েকটি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছি। এছাড়া নিয়মের বরখেলাপ করিনি কখনো! 

অর্থনীতিবিষয়ক সাংবাদিকতা করলেও রাজনীতি বিষয়ে তার অন্তর্দৃষ্টি ছিল প্রখর।

খানিকটা আবেগপ্রবণ ছিলেন ফারুক ভাই। বিশেষত ঘনিষ্ঠজনদের সঙ্গে। শোনা যায় সংবাদিক আবেদ খান ও সানজিদা আপার (আমরা ঘনিষ্ঠ বন্ধু খসরুর বোন) বিয়েতে ফারুক ভাই ম্যাচমেকারের মূল ভূমিকা পালন করেন।  আবার বিয়ের দিন তিনিই সবচেয়ে বেশি হল্লা করেছেন বলে শুনেছি। এই কতক্ষণ আগে আবেদ ভাইয়ের সঙ্গে কথা হলে তিনি অনুজের বিদায়ের গভীর বেদনার কথা জানালেন। এভাবেই ফারুক ভাই আমাদের অনেককেই স্বজনহারা করেছেন!    

সিভিল সার্ভিস একাডেমির  অধ্যক্ষ ও আমাদের গুরু খালিদ শামসের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। তারা দীর্ঘদিন একই বিল্ডিংয়ে থেকেছেন। আমরা কখনো কখনো খালিদ শামস স্যারের বাসায় মিলিত হতাম। অমায়িক শব্দটির প্রতিমূর্তি ছিলেন ফারুক ভাই। আপ্যায়নে তার ও ভাবীর জুড়ি মেলা ভার। ঢাকা মাওয়া সড়কের পাশে হাঁসাড়ায় তার একটা বাড়ি ছিল। বর্ষায় সেখানে খানিকটা পথ নৌকায় যেতে হতো। সুদিনে পায়ে হেঁটে যাওয়া যেত। সেখানে তার মুরগির ফার্ম, মাছের পুকুর ও শাকসবজির ক্ষেত ছিল। অত্যন্ত নিসর্গপ্রেমিক ছিলেন তিনি। শীত শুরুর আগেই বলতেন, কবির, হাঁসাড়া যেতে হবে।  সস্ত্রীক সেখানে গেছি। পিঠাপুলি, তাজা মাছ ও সবজিতে আপ্যায়িত হয়েছি। বিলাসী নয়, প্রাকৃতিক ছিল সেসব আয়োজন।

সেসব আয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রতিপত্তিশীল মানুষের সঙ্গে দেখা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর পরিবারের স্বজনদের সঙ্গে দেখা হয়েছে কিন্তু ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা এতসব নামিদামি মানুষের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা, তার আচরণে কখনো প্রভাব ফেলেনি। হাঁসাড়া থেকে ফিরে ড্রাইভার গাড়ির চাবি ফেরত দিতে এসে একটা ব্যাগ নিয়ে আসে। আমি জিজ্ঞেস করি, এগুলো কী? ড্রাইভার বলে, ফারুক স্যার দিয়েছেন। ব্যাগ খুলে দেখি ডিম, মাছ ও সবজি। এমন আন্তরিক মানুষ এখন বিরল।

ফারুক ভাই ছাত্রাবস্থায় ছাত্রলীগের রাজনীতি করতেন। সম্ভবত বঙ্গবন্ধুর বৃহত্তর পরিবারের সঙ্গে তার আত্মীয়তা ছিল। কিন্তু সাংবাদিক হিসেবে তার মতামত ছিল রাজনীতি-নিরপেক্ষ। তিনি যা সত্যি তা-ই বলতেন। তার সমর্থিত দলের ভালো কাজের প্রশংসা ও মন্দ কাজের নিন্দা করতেন। একই সঙ্গে ভালো মানুষ ও ভালো পেশাজীবী ছিলেন তিনি। আমি তার আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাই। পরপারে ভালো থাকুন ফারুক ভাই।

লেখক : মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান,  সাবেক সচিব ও অর্থনীতিবিদ


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
সফটওয়্যারে কারিগরি ত্রুটি/ ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের তথ্য ইমেইলে আহ্বান - dainik shiksha সফটওয়্যারে কারিগরি ত্রুটি/ ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের তথ্য ইমেইলে আহ্বান শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বৈত নীতি! - dainik shiksha শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বৈত নীতি! হিটস্ট্রোকে শিক্ষকের মৃত্যু - dainik shiksha হিটস্ট্রোকে শিক্ষকের মৃত্যু লিখিততে প্রক্সি দিয়ে পার, মৌখিক পরীক্ষায় এসে ধরা - dainik shiksha লিখিততে প্রক্সি দিয়ে পার, মৌখিক পরীক্ষায় এসে ধরা কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে - dainik shiksha এসএসসির খাতা চ্যালেঞ্জের আবেদন যেভাবে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে শিক্ষক কেনো বদলি চান - dainik shiksha শিক্ষক কেনো বদলি চান ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের লিখিত পরীক্ষা হতে পারে জুলাইয়ে - dainik shiksha ১৮তম শিক্ষক নিবন্ধনের লিখিত পরীক্ষা হতে পারে জুলাইয়ে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0027849674224854