প্রশাসনিকভাবে নয়, শিক্ষার্থীদের দেওয়া নাম ‘আল্লামা কাশগরী রহঃ হল’ ও ‘ইব্রাহীম হল’। এ দুটি হলে ৩৫০ শিক্ষার্থী থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। সরকারি মাদরাসা-ই-আলিয়া ঢাকার শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় পাঁচ হাজার। আবাসনের এই অপ্রতুলতার মধ্যেও হল দুটির নিয়ন্ত্রণ নেই মাদরাসা কর্তৃপক্ষের হাতে। হল দুটিতে কারা থাকবে কিংবা চলে যাবে তা নির্ধারণ করে মাদরাসাটির ছাত্রলীগ শাখা কমিটির নেতারা। অভিযোগ রয়েছে, নিয়মবহির্ভূতভাবে মাদরাসার বাইরের প্রতিজন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে পাঁচ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা নিয়ে হল দুটিতে থাকার ব্যবস্থা করে দিচ্ছে শাখা ছাত্রলীগ। অথচ অর্থ দিয়েও ঠাঁই হয় না মাদরাসাটির শিক্ষার্থীদের।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, ৩৫০ শিক্ষার্থী থাকার ব্যবস্থা থাকলেও রাখা হচ্ছে ৬৫০ জন। ছাত্রনেতারা নিজেদের সুবিধায় ঢাকা কলেজ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, কবি নজরুল সরকারি কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের টাকার বিনিময়ে থাকার সুযোগ করে দিচ্ছে। বিনিময়ে দলীয় বিভিন্ন কর্মসূচিতে তাদের থাকা নিশ্চিত করে। আর বৈধ হয়েও বঞ্চিত হচ্ছে মাদরাসার শিক্ষার্থীরা। ছাত্রাবাসে এক বছরের খরচ এক হাজার ৫০০ টাকা হলেও আদায় করা হয় পাঁচ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকা।
মাদরাসা-ই-আলিয়ায় সপ্তম শ্রেণি থেকে কামিল ও অনার্সের মোট পাঁচটি বিষয়ে প্রতিবছর প্রায় দুই হাজার শিক্ষার্থী ভর্তি হয়। পাস করে প্রতিবছর বেরিয়ে যায় প্রায় সমানসংখ্যক শিক্ষার্থী। ছাত্রাবাস দুটির মধ্যে তিনতলার আল্লামা কাশগরী রঃ হলের ৭৮টি কক্ষে ৩১২ জন আর ইব্রাহীম হলের ১২টি কক্ষে ৪৮ শিক্ষার্থী থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। প্রতি কক্ষে চারজন করে শিক্ষার্থী থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। ইব্রাহীম হলটি নির্মাণ করা হয়েছিল একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য। কিন্তু শিক্ষার্থীরা দখল করে ছাত্রাবাস হিসেবে ব্যবহার করছে।
সম্প্রতি সরেজমিনে আল্লামা কাশগরী রঃ হলে গিয়ে দেখা যায়, মূল ফটকে তালা দেওয়া। হলের পেছন দিয়ে কিছুদূর এগোতেই ডান পাশে ছাত্রাবাসে প্রবেশের দ্বিতীয় গেট। তা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলেই হাতের ডান পাশে ক্যান্টিন। হলের নিচতলায় ৮ নম্বর কক্ষে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানে আটজন শিক্ষার্থী বাস করছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী জানায়, চারজন থাকার কথা থাকলেও প্রতিটি কক্ষে থাকতে হচ্ছে ৮-৯ জন করে। রুম ছোট হলেও কিছু করার নেই।
একই তলায় ১১৩ নম্বর কক্ষের সামনে লেখা ‘ভাইজান’। জানা যায়, ওই কক্ষে ছাত্রলীগের শাখা কমিটির কয়েকজন নেতা থাকেন। আরেকটু সামনে ১২০ নম্বর কক্ষে থাকেন শাখা কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক আজাদ হোসাঈন নিরব ও তাঁর কয়েকজন অনুসারী। দ্বিতীয় তলার ২৩৬ নম্বর কক্ষের দরজায় সভাপতির নেমপ্লেট ঝোলানো। ভবনটিতে রয়েছে হল সুপারের কক্ষ, ছাত্রলীগের অফিস, মসজিদ, পাঠাগার, ইমাম ও শিক্ষকদের কক্ষ।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, ক্যান্টিন ও পাঠাগার বেহাল। বিভিন্ন কক্ষ ঘুরে বহু বহিরাগত শিক্ষার্থীকে থাকতে দেখা গেছে। এর মধ্যে ১০২ নম্বর কক্ষে থাকে প্রিন্স নামে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের এক শিক্ষর্থী। দ্বিতীয় তলার ২২৯ নম্বর কক্ষে থাকে পরান আহমেদ নামে ঢাকা কলেজের এক শিক্ষার্থী। পরানের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে সে রাজি হয়নি।
শিক্ষার্থীদের হলে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়ে টাকা আদায়ের বিষয়ে জানতে চাইলে সরকারি মাদরাসা-ই-আলিয়ার ছাত্রলীগের সভাপতি মো. শাহাদাৎ হোসেন বলেন, ‘আমি কোনো ধরনের টাকা নেই না। নতুন শিক্ষার্থী হলে ওঠানোর আগে তার বাড়ি কোথায়, আগে কোন সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিল এসব তথ্য জানতে চাই। এর বাইরে কিছু না।’
হলে বহিরাগত শিক্ষার্থীদের বিষয়ে হল সুপার মোহাম্মদ মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘নিয়মিত শিক্ষার্থীরা তাদের পরিচিতদের হলে তোলে। জিজ্ঞেস করলে বলে, বেড়াতে এসেছে কিংবা পরীক্ষা দিতে এসেছে। এভাবে হলে তোলার পর ওই শিক্ষার্থীরা আর যায় না। ফলে কিছুসংখ্যক বহিরাগত শিক্ষার্থী হলে থাকছে।’
বিষয়টি জানতে চাইলে সরকারি মাদরাসা-ই-আলিয়ার উপাধ্যক্ষ মুহাম্মদ আবদুর রশীদ বলেন, ‘রাজনৈতিকভাবে কিছু শিক্ষার্থী হলে উঠছে। এ কারণে নতুন শিক্ষার্থীরা ছাত্রাবাসে ওঠার সুযোগ পাচ্ছে না। আর টাকা-পয়সা নেওয়ার বিষয়টি সবাই জানে। হলে শিক্ষার্থী ওঠানো-নামানোর বিষয়ে মূলত আমাদের কোনো হাত নেই। নামকাওয়াস্তে একজন হল সুপার আছেন বটে।’
সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ