অস্তিত্বহীন মাদরাসার নামে টাকা লোপাটের চেষ্টা

শরীয়তপুর প্রতিনিধি |

নেই কোনো মাদরাসা ভবনের অস্তিত্ব। আদৌ এখানে মাদরাসা ছিল কি না তা-ও সঠিকভাবে বলতে পারছেন না স্থানীয়রা। এরপরও একটি গুদামঘর ও একটি ক্লাব ঘরকে মাদরাসার ভবন দেখিয়ে স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ প্রকল্পের ৪৬ লাখ ৭৫ হাজার ৭৫৮ টাকা আত্মসাতের চেষ্টায় মরিয়া প্রভাবশালী একটি চক্র।

এখানেই শেষ নয়, এরই মধ্যে চক্রটির হাতে পৌঁছেছে অধিগ্রহণের নোটিশ। এবার টাকা পাওয়ার পালা। কীভাবে এটা সম্ভব, তা নিয়ে জনমনে দেখা দিয়েছে কৌতূহল! এ বিষয়ে সুষ্ঠু তদন্ত করলে ব্যাপক অনিয়মের চিত্র উঠে আসবে বলে মনে করছে সচেতনমহল।

এমনই ঘটনা ঘটেছে শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার নশাসন ইউনিয়নের মাঝিরহাট এলাকায়। মাঝিরহাটে ‘নশাসন ইবতেদায়ি স্বতন্ত্র মাদরাসা’ নামে কোনো মাদরাসার  

অস্তিত্ব না থাকলেও ওই প্রতিষ্ঠানের সভাপতি দাবি করে একজন বলছেন, মাদরাসার স্থাপনা রয়েছে। কিন্তু ওই একই কমিটির সাধারণ সম্পাদক জানিয়েছেন, ওখানে মাদরাসার ভবন বহু বছর আগে ছিল। এখন কোনো ভবন নেই। জমি অধিগ্রহণে মাদরাসার নামে আসা ৭ ও ৮ ধারার (স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুমদখল আইন, ২০১৭) কোনো নোটিশ তিনি পাননি। সভাপতি এ বিষয়ে তাকে কিছু জানাননি বলে দাবি করেছেন সাধারণ সম্পাদক।

জেলা প্রশাসন ও সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শরীয়তপুরের জাজিরার নাওডোবা প্রান্ত থেকে জেলা শহর পর্যন্ত ২৭ কিলোমিটার এলাকায় এক হাজার ৬৮২ কোটি ৫৪ লাখ টাকা ব্যয়ে ১০৫ দশমিক ৫ হেক্টর জমিতে শরীয়তপুর-জাজিরা ও নাওডোবা পদ্মা সেতু অ্যাপ্রোচ সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলছে। এ প্রকল্পের জন্য সড়ক বিভাগের প্রস্তাব অনুযায়ী জমি ও স্থাপনা অধিগ্রহণের কার্যক্রম শুরু করেছে জেলা প্রশাসন। জেলা প্রশাসন, গণপূর্ত বিভাগ এবং বন বিভাগ যৌথ তদন্ত শেষ করে ৭ ধারার নোটিশ দিয়েছে জমি ও স্থাপনার মালিকদের।

সম্প্রতি শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার নশাসন গাগ্রীজোড়া ও ডগ্রী এলাকাসহ কয়েকটি এলাকায় ৮ ধারার নোটিশ দেয় শরীয়তপুর জেলা প্রশাসন। প্রকল্প স্থাবর ভূমি অধিগ্রহণের আওতাভুক্ত নড়িয়া উপজেলার নশাসন ইউনিয়নের মাঝির হাট এলাকায় বিআরএস ২৩ নম্বর নশাসন মৌজার ৬ নম্বর খতিয়ানের ৩৩০৩, ৩৩০৪ ও ৩৩০৫ নম্বর দাগে ৩৪ শতাংশ জমি অস্তিত্বহীন ওই মাদরাসার নামে বিআরএস রেকর্ড রয়েছে। কিন্তু এ রেকর্ডীয় জমি কীভাবে মাদরাসার নামে বিআরএস রেকর্ডভুক্ত হয়েছে তার কোনো দলিলাদি খুঁজে পাওয়া যায়নি।

মাদরাসার ওই রেকর্ডীয় সম্পত্তির ৩৩০৫ নম্বর দাগসহ আরও কয়েকটি দাগের সম্পত্তি এসএ রেকর্ড অনুযায়ী পৈতৃক মালিকানা দাবি করে ২০১৯ সালে আব্দুল খালেক ব্যাপারী জেলা প্রশাসক ও অস্তিত্বহীন মাদরাসাসহ পাঁচজনকে বিবাদী করে আদালতে মামলা করেন। খালেক ব্যাপারীর মৃত্যুর পর তার স্ত্রী নিলুফা বেগম ওই মামলা এখনো পরিচালনা করছেন।

জমি অধিগ্রহণের জন্য জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে ৮ ধারার নোটিশ দেওয়ার পর মামলার বাদী আব্দুল খালেক ব্যাপারীর স্ত্রী নিলুফা বেগম গত ৩১ আগস্ট ৩৩০৫ দাগসহ মামলার আরজি অনুযায়ী আদালতে অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা চেয়ে আবেদন করেন। তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত ওই মামলার পাঁচজন বিবাদীকে ১০ দিনের মধ্যে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেন। 

অধিগ্রহণে ৮ ধারার নোটিশে মাদরাসার নামে স্থাপনা হিসেবে দেখানো হয়েছে ৩৩০৫ নম্বর দাগের একটি ক্লাব ঘর। কিন্তু ওই ক্লাব ঘরটির নিজস্ব মালিকানা দলিল থাকলেও ক্লাব কর্তৃপক্ষ ৮ ধারার নোটিশ পায়নি। ক্লাব ঘরের দক্ষিণ পাশে রয়েছে আব্দুল খালেক ব্যাপারীর একটি বাগান। তিনিও ৮ ধারার নোটিশ পাননি। বাগানের পাশেই বাজারের মধ্যে জলিল মাঝির একটি গুদামঘর। ওই গুদামঘরটিও মাদরাসার নামে আসা ৮ ধারার নোটিশে দেখানো হয়েছে। আব্দুল জলিল মাঝির মৃত্যুর পর তার উত্তরাধিকারী স্ত্রী ফেরদৌস জাহান, মেয়ে লায়লা জিয়াসমিন ও বোন জাহানারা বেগম ৮ ধারার কোনো নোটিশ পাননি।

স্থানীয়দের দাবি, নশাসন ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান কামরুল আহসান মাঝি ও অস্তিত্বহীন মাদরাসার সভাপতি গোলাম মোস্তফা মাঝি গুদামঘরসহ ওই ক্লাব ঘরের ভবন দুটি মাদরাসার ভবন হিসেবে দেখিয়ে সরকারি অর্থ লোপাটের চেষ্টা চালাচ্ছেন। এ বিষয়ে সুষ্ঠু তদন্ত করলে আরও অনিয়মের চিত্র উঠে আসবে।

স্থানীয় বাসিন্দা মোহাম্মদ সরদার (৮০) বলেন, ‘৫০ বছর আগে কয়েকজন বাচ্চাকে মক্তবে পড়তে দেখছিলাম। কিন্তু কোনো মাদরাসা ছিল না। আমরা তো জানি এ জায়গাটা মৃত খালেক ব্যাপারীর।’

মামলার বাদী নিলুফা বেগম (৭০) বলেন, ‘৩৩০৫ নম্বর দাগের জমিতে নশাসন ইবতেদায়ি মাদরাসা নামে মাদরাসার কোনো ঘর নেই। সরেজমিনে তদন্ত করলে ঘরের কোনো অস্তিত্বও খুঁজে পাবে না। ওই দাগের জায়গাটি আমার স্বামী খালেক ব্যাপারীর নামে। এ জায়গা নিয়ে এখনো আদালতে মামলা চলমান, যা আমি পরিচালনা করছি।’

এদিকে ৮ ধারার নোটিশ পাওয়ার বিষয়ে কিছুই জানেন না বলে দাবি করেছেন অস্তিত্বহীন ইবতেদায়ি স্বতন্ত্র মাদরাসা কমিটির সাধারণ সম্পাদক চুন্নু মাঝি।

তিনি বলেন, ‘আমি স্থানীয় একটি মসজিদ কমিটির সাধারণ সম্পাদক। গোলাম মোস্তফা মাঝি আমাকে ইবতেদায়ি স্বতন্ত্র মাদরাসা কমিটির সাধারণ সম্পাদক করেছেন বলে জানিয়েছেন। তিনি সভাপতি আর আমি সাধারণ সম্পাদক। এছাড়া এ কমিটির অন্য কোনো সদস্য আছে বলে আমার জানা নেই।’

ওই মাদরাসা কমিটির সভাপতি দাবি করা গোলাম মোস্তফা মাঝি বলেন, ‘আমরা মাদরাসা ভবনের ভূমি অধিগ্রহণের ৮ ধারার নোটিশ পেয়েছি। ওই তিনটি দাগের (৩৩০৩, ৩৩০৪ ও ৩৩০৫ নম্বর) ভূমি আমাদের মাদরাসার নামেই। ওই জায়গায় একটি পাকাঘর আছে, সেটিই মাদরাসা। ছাত্রছাত্রীরা এখন পড়তে আসে না বলে আমরা ওই পাকা ঘরটি ভাড়া দিয়েছি।’

নশাসন ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান কামরুল আহসান মাঝি বলেন, ‘ক্লাবঘর ও গুদামঘর ভবনের ৮ ধারার নোটিশ মাদরাসার নামে হয়েছে। কীভাবে এটা হয়েছে তা মাদরাসার সভাপতি ভালো বলতে পারবেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘গোলাম মোস্তফা মাঝির সঙ্গে মিলে মাদরাসার নামে বরাদ্দের টাকা বা অধিগ্রহণের সঙ্গে জড়িত কোনো বিষয়ের অর্থ আত্মসাতের সঙ্গে আমি জড়িত নই। স্থানীয়দের অভিযোগ ভিত্তিহীন ও সম্পূর্ণ মিথ্যা।’

এ বিষয়ে শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ নিজাম উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, নশাসন ইবতেদায়ি স্বতন্ত্র মাদরাসার যদি কোনো অস্তিত্ব না থাকে, তবে বিল পাবে না।

তিনি বলেন, রেকর্ড গ্রহণযোগ্য দলিল। মাদরাসার জমি নিয়ে আদালতে বিরোধপূর্ণ মামলা থাকলে তা নিষ্পত্তি হওয়ার পর প্রকৃত মালিককে স্থাপনা ও জমির ন্যায্যমূল্য দেওয়া হবে।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
সচিবালয় ও প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের আশপাশে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ - dainik shiksha সচিবালয় ও প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের আশপাশে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ মাউশি অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের অতিরিক্ত দায়িত্বে রেজাউল করীম - dainik shiksha মাউশি অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের অতিরিক্ত দায়িত্বে রেজাউল করীম শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর একদিনের বেতন ত্রাণ তহবিলে - dainik shiksha শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর একদিনের বেতন ত্রাণ তহবিলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পদত্যাগের জন্য বল প্রয়োগ করা যাবে না: শিক্ষা উপদেষ্টা - dainik shiksha শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পদত্যাগের জন্য বল প্রয়োগ করা যাবে না: শিক্ষা উপদেষ্টা গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে বিভ্রান্ত না হওয়ার অনুরোধ বৈষম্য বিরোধী ছাত্রদের - dainik shiksha গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে বিভ্রান্ত না হওয়ার অনুরোধ বৈষম্য বিরোধী ছাত্রদের শিক্ষায় আমূল সংস্কারের উদ্যোগ নেবো: ড. ইউনূস - dainik shiksha শিক্ষায় আমূল সংস্কারের উদ্যোগ নেবো: ড. ইউনূস মাউশি অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের অতিরিক্ত দায়িত্বে রেজাউল করীম - dainik shiksha মাউশি অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের অতিরিক্ত দায়িত্বে রেজাউল করীম শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর একদিনের বেতন ত্রাণ তহবিলে - dainik shiksha শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর একদিনের বেতন ত্রাণ তহবিলে অধ্যাপকদের অনলাইনে বদলির আবেদন শুরু ১ সেপ্টেম্বর - dainik shiksha অধ্যাপকদের অনলাইনে বদলির আবেদন শুরু ১ সেপ্টেম্বর কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0026319026947021