অস্ত্রের প্রশিক্ষণ হতে পারে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার অতিরিক্ত যোগ্যতা!

রাজীব নূর |
অস্ত্রহাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মতিয়ার। ছবি: সংগৃহীত
অস্ত্রহাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মতিয়ার। ছবি: সংগৃহীত

কাল সকালবেলা ফেসবুকে ঢুকতেই একটা স্ট্যাটাসে চোখে পড়ল। কবিবন্ধু সুমন রহমান পাশাপাশি দুটি ছবি দিয়ে লিখেছেন, ‘প্রথমজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গোল্ড মেডাল পাওয়া। কিন্তু শিক্ষক হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জায়গা হয়নি ওর। ইউল্যাবে পড়িয়েছে, সুনামের সাথে। পরে, গোল্ড মেডাল স্যুটকেসে ভরে কানাডায় চলে গেছে। কিন্তু সে ভেবেই পায়নি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তার জায়গা হয়নি কেন। ফার্স্ট ক্লাশ ফার্স্ট হয়েও। কী বাকি ছিল? দ্বিতীয়জন সহজাত প্রতিভায় সেই প্রশ্নের জবাব দিয়ে দিয়েছে। শিরদাঁড়ায় মৃদু কাঁপুনিসহ তাকে অভিনন্দন!’

ছবিতে দেখতে পেলাম প্রথমজনকে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ একটি পদক পরিয়ে দিচ্ছেন, দ্বিতীয়জন অস্ত্র উঁচিয়ে আছেন। এই দুই জনের কারোর সঙ্গেই আমার পরিচয় নেই। তবে অচেনা ওই স্বর্ণপদক বিজয়ীর প্রসঙ্গে মনে এল আরেকজনের কথা, সে আমার অত্যন্ত প্রিয়ভাজন কাজী আনিছ, যাকে আমরা কাছের মানুষরা জুয়েল নামে ডাকি। আমাদের জুয়েলও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের একজন।

রাষ্ট্রপতির হাত থেকে পদক নিচ্ছেন মেধাবী কাজী আনিস। ছবি: সংগৃহীত
রাষ্ট্রপতির হাত থেকে পদক নিচ্ছেন মেধাবী কাজী আনিস। ছবি: সংগৃহীত

যাই হোক, আনিছের কথা বলার আগে, সুমন রহমানের দেওয়া ছবির দ্বিতীয়জনের কথা বলি। খবরের কাগজের বদৌলতে বহুদিন ধরেই আরও অনেকের মতো আমারও চেনা হয়ে আছেন তিনি। তার নাম মতিয়ার রহমান। এই মতিয়ার প্রথম খবরের শিরোনাম হয়েছিলেন ২০১৪ সালের ৮ সেপ্টেম্বর। ওই দিন দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় একটি সচিত্র সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল, যার শিরোনাম ছিল ‘ছাত্রলীগ নেতার কাছে অস্ত্র চালানো শিখছেন শিক্ষক’ । ততদিনে মতিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগ ছেড়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন নির্জন স্থান মফিজ লেকে অস্ত্রের প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন মতিয়ার ও ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের সাবেক শিক্ষক ও বর্তমানে বিসিএস ক্যাডার (অর্থনীতি) আজিজুল হক মামুন। এ দুজনের মধ্যে মামুন ছিলেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি। মামুনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু মতিয়ার। তারা একই সঙ্গে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ পেয়েছিলেন। তাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের তৎকালীন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সজিবুল ইসলাম সজিব। সংবাদ প্রকাশের পর এ নিয়ে দেশব্যাপী তোলপাড় শুরু হয়। পরদিন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. মাহবুবর রহমানকে অব্যাহতি দেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

এ ছাড়া অস্ত্রের প্রশিক্ষক ছাত্রলীগ নেতা সজিবুল ইসলাম সজিবকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িক বহিস্কার করা হয়। দুই শিক্ষকের বিচারের দাবি উঠেছিল বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে। পরে বিষয়টি আড়ালে চলে যায়। মতিয়ার আবারও খবরের শিরোনাম হয়েছেন গতকাল। যুগান্তরের মাধ্যমেই জানা গেল ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই অস্ত্রধারী মতিয়ারই এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক।

কখন এই মতিয়ার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিলেন এটা আরও অনেকের মতো আমারও জানা ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, ২০১৬ সালের ১৭ জুলাই মতিয়ার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক পদে নিয়োগ পান। সম্প্রতি তাকে পদোন্নতি দিয়ে সহকারী অধ্যাপক করা হয়েছে বলে যুগান্তরের খবরে নিশ্চিত করা হয়েছে।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জগন্নাথ হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে পদোন্নতি ভাগিয়ে নিয়ে মতিয়ার প্রমাণ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হওয়ার যোগ্য তিনি! তবু দীর্ঘদিন ধরে সংবাদপত্রে রিপোর্টিং করার কারণে আমার কৌতূহলটা একটু বেশি, আমরা যারা সংবাদপত্রের রিপোর্টিং বিভাগে কাজ করি তারা কারণে এবং অকারণেও লোকজনকে প্রশ্ন করি। তাই ভাবলাম মতিয়ারকে জিজ্ঞেস করে দেখি তাঁর বিশেষ যোগ্যতাটা কি? মতিয়ারের মুঠোফোন নাম্বারটি পাওয়া গেলেও প্রশ্নটা করা গেল না। কাল দিনভর সেটি ছিল বন্ধ। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী-সাংবাদিকের কাছে জানতে চাইলাম, মতিয়ারের ফেসবুক একাউন্ট আছে কিনা? উত্তরে সে জানাল, আছে, কিন্তু ডিঅ্যাকটিভেট করে রেখেছেন। ভালো এটাকেই বোধ হয় বালিতে মুখ গুঁজে রাখা বলে। মতিয়াররা অন্ধ হলে প্রলয় বন্ধ থাকে না। অবশ্য প্রলয়েও টনক না নড়ে না বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ কর্তাদের। মতিয়ার কেমন করে নিয়োগ পেল জানেন না, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক এম এ জলিল এবং বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক মো. আবদুল আজিজও। চেয়ারম্যানের সরল স্বীকারোক্তি তিনি চাকরি করেন মাত্র। যেন আদার বেপারির জাহাজের খবর জানার দরকার নেই। ডিন এ ধরনের ‘জটিল প্রশ্নের’ উত্তর দিতে অপারগতা প্রকাশ করে  ‘উপাচার্য মহোদয়ের’ সঙ্গে কথা বলতে পরামর্শ দিয়েছেন। উপাচার্য অধ্যাপক ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেছেন, বিষয়টি তাঁর জানা নেই। খোঁজ নিয়ে দেখছেন।

খোঁজ নিয়ে উপাচার্য কি করবেন জানি না। কিন্তু আবারও অন্য কোনো মতিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবেন। আর অনেক কিছুর মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়াটা যে শুধুই রাজনৈতিক পরিচয়ে আটকে গেছে, তা তো সবারই জানা আছে। যে কারণে আনিছদের জায়গা হয় না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।

কাজী আনিছকে আমি কিছুদিনের জন্য সহকর্মী হিসেবে পেয়েছিলাম প্রথম আলোয়। অপরাধ বিভাগে কাজ করত আনিছ। আমি তখন ছুটে বেড়াচ্ছি, আজ সাতক্ষীরা তো পরশু ময়মনসিংহে। মাঝেমধ্যে অফিসে বসলে কথা হতো আনিছের সঙ্গেও। ও ভালো রিপোর্টার। তবে আমার মনে হতো সাংবাদিকতা নিয়ে ওর কথা বলার ভঙ্গিটা যতটা সাংবাদিকের, তার চেয়ে বেশি সাংবাদিকতার শিক্ষকের মতো। তাই একদিন বললাম, ‘তোমার তো মাস্টার হওয়া উচিত।’ জানতাম আনিছ সাংবাদিকতার ছাত্র ছিল, জানা ছিল না দারুণ ফলাফলও আছে ওর। অবশ্য সেদিনই প্রথম নয়, আগে থাকতেই জানা ছিল যোগ্যতা থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়া যায় না। লাগে বিশেষ যোগ্যতা। আনিছ বলল, মাস্টারই হতে চেয়েছিলাম। আমার মাস্টাররা নিল না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নেয়নি বলে কাজী আনিছদের শিক্ষকতা করতে হলে যেতে হয় স্টেট ইউনিভার্সিটির মতো কোথাও। প্রথম আলো ছেড়ে আনিছ এখন স্টেইট ইউনিভার্সিটিতে আছে। শুনেছি, বেশ ভালো পড়ায় সে।

সুমন রহমানের ফেসবুক স্ট্যাটাস দেখার পর কাল আবার আনিছের কথা মনে পড়ল। ফেসবুকের ইনবক্সে জানতে চাইলাম, ‘জুয়েল তুমি গোল্ড পেয়েছিলে না?’ উত্তরে সে বলল, ‘হুম, ওইটা বিক্রি করব, নেবেন?’ আমার অনুরোধে সে পদক গ্রহণের ছবিটা পাঠাল, রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান পদক গলায় পরিয়ে দিচ্ছেন আনিছকে।

এর  কিছুক্ষণ পর দেখি আনিছ ওর ফেসবুক ওয়ালেও লিখেছে, ‘বিক্রয় বিজ্ঞপ্তি : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একদা একটা গোল্ড মেডেল পেয়েছিলাম। বিক্রি করবো এটা।  দাম : আলোচনা সাপেক্ষে, আগ্রহীরা যোগাযোগ করুন…’।

আমি দুঃখিত, আনিছ, ‘কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে?’


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
কাল থেকে শিক্ষা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী চলবে সব প্রাথমিক বিদ্যালয় - dainik shiksha কাল থেকে শিক্ষা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী চলবে সব প্রাথমিক বিদ্যালয় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান বাড়ানোর নির্দেশ রাষ্ট্রপতির - dainik shiksha বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান বাড়ানোর নির্দেশ রাষ্ট্রপতির ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার দাবিতে দেশজুড়ে সংহতি সমাবেশ - dainik shiksha ফিলিস্তিনের স্বাধীনতার দাবিতে দেশজুড়ে সংহতি সমাবেশ সব মাদরাসার ওয়েবসাইট ও তথ্য হালনাগাদের নির্দেশ - dainik shiksha সব মাদরাসার ওয়েবসাইট ও তথ্য হালনাগাদের নির্দেশ অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক : দুই মন্ত্রণালয় যা করবে - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক : দুই মন্ত্রণালয় যা করবে নার্সিং-মিডওয়াইফারি ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ - dainik shiksha নার্সিং-মিডওয়াইফারি ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় সিনিয়র আইনজীবীরা বিচার বিভাগের স্বার্থে কথা বলবেন, আশা প্রধান বিচারপতির - dainik shiksha সিনিয়র আইনজীবীরা বিচার বিভাগের স্বার্থে কথা বলবেন, আশা প্রধান বিচারপতির দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0056021213531494