আইডিয়াল স্কুলের কর্মচারী সেই আতিকের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু

নিজস্ব প্রতিবেদক |

রাজধানী ঢাকার মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রশাসনিক কর্মকর্তা কাম উপ-সহকারী প্রকৌশলী আতিকুর রহমানের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতি তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। গত ১ আগস্ট মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ থেকে জারি করা এ আদেশে অভিযোগটি তদন্ত করতে বলা হয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরকে। মঙ্গলবার (৩ আগস্ট) আদেশটি প্রকাশ পেয়েছে।

আদেশে উপ-সচিব আনোয়ারুল হক স্বাক্ষরিত আদেশে প্রশাসনিক কর্মকর্তা আতিকুরের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তদন্ত করে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে শিক্ষা অধিদপ্তরকে।

তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হলেও আতিকুর রহমানের বিরুদ্ধে ব্যাংকে শতকোটি টাকা লেনদেনের বিষয়ে অভিযোগ আছে। বিষয়টি নিয়ে দৈনিক শিক্ষাডটকমে ‘মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের কর্মচারী আতিকের এত সম্পদ!’ শিরোনামে  সংবাদ প্রচারিত হয়। আতিকের দুর্নীতি নিয়ে বেশকিছু গণমাধ্যমসহ কিছু বেসরকারি টিভি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এ প্রেক্ষিতে অভিযোগগুলো তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। [nside-ad-1]

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অফিস আদেশে জানানো হয়,  মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রশাসনিক কর্মকর্তা/উপ-সহকারী প্রকৌশলী আতিকুর রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতি সংক্রান্ত অভিযোগ আনা হয়েছে।  এমতাবস্থায় ওই বিষয়ে প্রশাসনিক কার্যক্রম গ্রহণ করে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগকে অবহিত করার জন্য অনুরোধ করা হলো।

অভিযোগে জানা গেছে, আতিকুর রহমান খান ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে উপ-সহকারী প্রকৌশলী পদে যোগদান করেন। ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে থেকে তিনি প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন। এমপিওভুক্ত উচ্চ মাধ্যমিক কলেজে প্রশাসনিক কর্মকর্তার কোনও পদ নেই।  অবৈধভাবে এই সৃষ্টি করে তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

অভিযোগ মতে, দেশের ১৫টি ব্যাংকে আতিকুর রহমান খানের ৯৭টি ব্যাংক হিসাবের তথ্য পাওয়া গেছে। এসব ব্যাংকে ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দ থেকে চলতি বছরের ২৮ মার্চ পর্যন্ত ১১০ কোটি ৬৯ লাখ ৯২ হাজার ৩৯২ টাকা লেনদেন হয়েছে। 

প্রতিষ্ঠানে অবৈধ ভর্তিসহ সব বাণিজ্যের হোতা এই আতিক। তিনটি ক্যাম্পাসের প্রায় ২৭ হাজার শিক্ষার্থীর ড্রেস (পোশাক), ক্যান্টিন, লাইব্রেরি সবই বেনামে তাঁর নিয়ন্ত্রণে। এমনকি স্কুলের সামনে ফুটপাতে শতাধিক দোকান বসিয়েও তিনি আয় করেন মোটা অঙ্কের টাকা। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানে যত ধরনের কেনাকাটা, উন্নয়ন ও সংস্কারকাজ হয় তার সবই করেন আতিক। দরপত্রেও অংশ নেয় নামে-বেনামে তাঁরই প্রতিষ্ঠান। সেখানে চলে বড় ধরনের লুটপাট। গত ১২ বছরে প্রতিষ্ঠানে পাঁচ শতাধিক শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ দেয়া হয়েছে। বেশির ভাগ শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে পাঁচ থেকে ১০ লাখ টাকা এবং কর্মচারী নিয়োগে দুই থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত লেনদেন হয়েছে। এর বেশির ভাগই হয়েছে আতিকের মাধ্যমে।

আতিকুর রহমান। ছবি : দৈনিক শিক্ষা

জানা যায়, স্কুলের মতিঝিল শাখায় শিক্ষকদের বসার স্থান সংকুলান না হলেও আতিকের জন্য আছে এসি লাগানো বড় কক্ষ। এমপিওভুক্ত স্কুল-কলেজের জনবল কাঠামোতে শিক্ষক ও কর্মচারী ছাড়া আর কোনো পদ নেই। তবে আতিক বর্তমানে ‘সহকারী ইঞ্জিনিয়ার’ পদের বেতন নিচ্ছেন। যদিও এ ধরনের কোনো পদই জনবল কাঠামোতে নেই। আতিকের বিষয়ে অধ্যক্ষ সব জেনেও না জানার ভান করেন। গভর্নিং বডির বর্তমান সভাপতি সরকারের যুগ্ম সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামানও নিশ্চুপ।

প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ শাহান আরা বেগম বলেন, ‘ইঞ্জিনিয়ার আতিকের স্কুলে কোনো ব্যবসা-বাণিজ্য নেই। তবে স্কুলের কাজকর্ম দেখে। স্কুলে তার কোনো রুম নেই। তবে একটি রুমে টেন্ডারসংক্রান্ত জিনিসপত্র রাখা হয়, সেখানে আতিকসহ নির্মাণসংক্রান্ত কমিটির লোকজন বসেন।’

অধ্যক্ষ আরও বলেন, ‘আতিকের শ্বশুরের দুটো মেয়ে। তাদের বহু জায়গাজমি দিছে, যা আমার জানার ব্যাপার না। আতিকের বাবারও অনেক প্রপার্টিজ ছিল। চেষ্টা করলে সেগুলোও বাড়তে পারে।’

জানা যায়, আইডিয়ালের তিন শাখায় প্রতিবছরই হাজারখানেক শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয় অবৈধভাবে। ওই ধরনের ভর্তির ক্ষেত্রে প্রতি শিক্ষার্থীর কাছ থেকে নেওয়া হয় দুই থেকে তিন লাখ টাকা। আর এই টাকার পুরোটাই লেনদেন হয় আতিকের হাত দিয়ে। তবে গত বছর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের চাপে ভিন্ন কৌশলের আশ্রয় নেয়া হয়। ভর্তি পরীক্ষার উত্তরপত্রে ঘষামাজা করে অবশ্য ধরাও পড়ে যান আতিকসহ ছয়জন। ঘষামাজা করে নতুনভাবে লিখে অবৈধভাবে ভর্তি করার বিষয়টি প্রমাণিত হয় ঢাকা জেলা প্রশাসনের তদন্তে। ওই জালিয়াতিতে জড়িত হিসেবে আতিকসহ ছয়জনের নাম উঠে আসে তদন্তে। 

একজন অভিভাবক এ বছর তিন লাখ টাকা দিয়ে ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর সন্তানকে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি করিয়েছেন মতিঝিল শাখায়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ‘আমার কথা হয়েছে মতিঝিল শাখার একজন কর্মকর্তার সঙ্গে। তাঁর কথামতোই শান্তিনগর এলাকার একটা দোকানে আমি টাকা দিয়ে আসি। আমাকে বলা হয়েছিল, পরীক্ষার খাতায় কিছু না লিখলেও চলবে। সেই অনুযায়ী প্রথম দুই পৃষ্ঠা লিখে বাকিটা খালি রেখে এসেছে। এরপর দেখলাম আমার ছেলের রোল নম্বর প্রথম দিকেই রয়েছে।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেকজন অভিভাবক বলেন, ‘২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে আমার বাচ্চাকে বনশ্রী শাখায় দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভর্তি করিয়েছি। কথা হয়েছে মতিঝিল শাখার একজনের সঙ্গে। বনশ্রীর একটা ফার্মেসিতে (ওষুধের দোকান) তিন লাখ ২০ হাজার টাকা দিয়ে এসেছিলাম। এরপর ভর্তি করে নিয়েছে।’

অনুসন্ধানে জানা যায়, আতিক নিজে চলাফেরা করেন একটি দামি নোয়া গাড়িতে (ঢাকা মেট্রো চ-১৫-১৩৪৮)। স্কুলে বই পাঠ্য করে কমিশন বাণিজ্য এবং নিজের টেইলার্স দোকান থেকে পোশাক বানাতে বাধ্য করেন তিনি। আশিক ও বিশ্বাস লাইব্রেরি এবং আইডিয়াল স্কুলের প্রতিটি ক্যাম্পাসের ক্যান্টিনও বেনামে তিনিই চালান। বনশ্রীর ‘ডি’ ব্লকের ১০ নম্বর রোডের ১২ নম্বর বাড়ির দ্বিতীয় তলায় থাকেন নিজের এক হাজার ৬০০ বর্গফুট আয়তনের ফ্ল্যাটে। আফতাবনগর ‘বি’ ব্লকের ৩৪ নম্বর বাড়িটি তাঁর স্ত্রীর নামে। বনশ্রীর ‘সি’ ব্লকের ১ নম্বর রোডের ৩৩ নম্বর বাড়িতে বিশাল শোরুম ভাড়া দিয়েছেন। ওই এলাকায় আছে একাধিক দোকান। ভিশন-৭১ নামে আছে ‘ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি’। বনশ্রীর ‘সি’ ব্লকের ১৩ নম্বর রোডে তাঁরই কোম্পানি থেকে তৈরি করা বাড়িতে আছে একাধিক ফ্ল্যাট। মেরুল বাড্ডার আনন্দনগর হাজী ওয়াকিল উদ্দিন সড়কের ১ নম্বর রোডের ৭৪৭ নম্বর বাড়িটি আতিকের শ্বশুরের। তাঁর টাকায় সেখানে উঠেছে সাততলা ভবন। গাজীপুরের কালীগঞ্জে প্রায় ৩০ বিঘা জমিতে তিনি গড়ে তুলেছেন বাগানবাড়ি ও পিকনিক স্পট। একাধিক মাল্টিপারপাস সমিতির মালিকানা আছে তাঁর। সেখানে নিজের অবৈধ টাকা খাটান তিনি। সম্প্রতি তার ভিশন-৭১ ডেভেলপমেন্ট কম্পানির নৌবিহারে উপস্থিত ছিলেন আইডিয়ালের অধ্যক্ষও।

শিক্ষার সব খবর সবার আগে জানতে দৈনিক শিক্ষার ইউটিউব চ্যানেলের সাথেই থাকুন। ভিডিওগুলো মিস করতে না চাইলে এখন দৈনিকশিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন এবং বেল বাটন ক্লিক করুন। বেল বাটন ক্লিক করার ফলে আপনার স্মার্ট ফোন বা কম্পিউটারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভিডিওগুলোর নোটিফিকেশন পৌঁছে যাবে।

দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল    SUBSCRIBE  করতে ক্লিক করুন।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
জোর করে প্রতিষ্ঠান প্রধানদের পদত্যাগ, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের করা হুঁশিয়ারি - dainik shiksha জোর করে প্রতিষ্ঠান প্রধানদের পদত্যাগ, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের করা হুঁশিয়ারি রাজনীতি করি না, ভবিষ্যতেও করবো না: ঢাবির নতুন ভিসি - dainik shiksha রাজনীতি করি না, ভবিষ্যতেও করবো না: ঢাবির নতুন ভিসি চার তারিখের মধ্যে মাদরাসা শিক্ষকদের এমপিওর আবেদন - dainik shiksha চার তারিখের মধ্যে মাদরাসা শিক্ষকদের এমপিওর আবেদন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন উপাচার্য অধ্যাপক আমানুল্লাহ - dainik shiksha জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন উপাচার্য অধ্যাপক আমানুল্লাহ দীপু-টিপু-রতন সিন্ডিকেটের ঘুষের সাম্রাজ্য - dainik shiksha দীপু-টিপু-রতন সিন্ডিকেটের ঘুষের সাম্রাজ্য এনসিটিবির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের শাস্তি দাবি বৈষম্যবিরোধীদের - dainik shiksha এনসিটিবির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের শাস্তি দাবি বৈষম্যবিরোধীদের কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0025219917297363