আইনকে পরোয়া করছে না বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় : ইউজিসি

নিজস্ব প্রতিবেদক |

প্রতিষ্ঠান পরিচালনার ক্ষেত্রে বিদ্যমান বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনের তোয়াক্কা করছে না দেশের বেশিরভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। সরকারের নির্দেশ উপেক্ষা করে এখনও ৩০টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অস্থায়ী ক্যাম্পাসে কার্যক্রম চালাচ্ছে।

ইউজিসির নির্দেশনা সত্ত্বেও কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ই দুই সেমিস্টার পদ্ধতি চালু করেনি। শিক্ষার্থী ভর্তিতে মানছে না অনুমোদিত আসন সংখ্যা। ভিসি-প্রোভিসি-কোষাধ্যক্ষ নিয়োগের বিধানও মানা হচ্ছে না। মিটিং-সিটিং আর নানা কেনাকাটার আড়ালে কোটি কোটি টাকা নিয়ে যাচ্ছেন বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সদস্যরা।

বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার অ্যাপেক্সবডি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আইন অমান্যের এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। সম্প্রতি প্রতিবেদনটি রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের কাছে হস্তান্তর করেছে ইউজিসি। 

দেশের সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের কার্যক্রমের ওপর এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। ৫৩৫ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে ২৯টি সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে। দেশে সরকারি বেসরকারি মিলিয়ে বর্তমানে ১৫০টি বিশ্ববিদ্যালয় আছে। তবে প্রতিবেদনে ৪০টি সরকারি ও ৯৪টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য স্থান পেয়েছে। বাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ২০১৮ সালে কার্যক্রম শুরু করেনি। কিছু অনুমোদন পেলেও কার্যক্রম শুরু করেনি।

ইউজিসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কাজী শহীদুল্লাহ সাংবাদিকদের বলেন, সংস্থার ৪৫তম বার্ষিক প্রতিবেদন আমরা রাষ্ট্রপতির কাছে পেশ করেছি। এতে উচ্চশিক্ষার বর্তমান অবস্থা, সমস্যা ও করণীয় সম্পর্কে কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। সাক্ষাৎকালে রাষ্ট্রপতি আমাদের কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন। সে অনুসারে পদক্ষেপ নেয়া হবে।

প্রতিবেদনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর লাগামহীনভাবে চলার চিত্র ফুটে উঠেছে। সুপারিশের মধ্যে আরও আছে- অনেক প্রতিষ্ঠান আর্থিক নিরীক্ষা প্রতিবেদন ইউজিসিতে দাখিল করে না। শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য চাকরিবিধি নেই। ইচ্ছেমতো নিয়োগ, ছাঁটাই, পদোন্নতি দিয়ে থাকে।

আইন অনুযায়ী সিন্ডিকেট, বোর্ড অব ট্রাস্টিজ, একাডেমিক কাউন্সিলের মিটিংসহ বিভিন্ন মিটিংয়ের জন্য বিধিমালা তৈরি করা প্রয়োজন। পাশাপাশি ওই নীতিমালা চ্যান্সেলরের কাছ থেকে অনুমোদন গ্রহণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নির্দেশনা প্রদান করা দরকার।

এতে আরও বলা হয়, বিশ্ববিদ্যালয়েরই মনোনীত ৩টি অডিট ফার্ম থেকে মন্ত্রণালয় একটি মনোনয়ন দেয়। এতে আর্থিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা যায় না। তাই ইউজিসির পরামর্শ অনুযায়ী ফার্ম নিয়োগ করে হিসাব নিরীক্ষার ব্যবস্থা করা। শিক্ষক ও গবেষকদের প্রণোদনা দেয়ার ব্যবস্থা করা দরকার।

পাশাপাশি আরও বলা হয়েছে, সব মিলিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনেকাংশে লঙ্ঘন করা হচ্ছে। তাই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিবিড় পর্যবেক্ষণে আনা প্রয়োজন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সুশাসন নিশ্চিতে বিদ্যমান আইন যুগোপযোগী করা জরুরি।

প্রতিবেদনে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে বেশকিছু সুপারিশ স্থান পেয়েছে। এতে উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য পৃথক বেতন স্কেল ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেয়ার উদ্যোগ নিতে বলা হয়েছে।

এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য আন্তর্জাতিক মানের ইউনিভার্সিটি টিচার্স ট্রেনিং একাডেমি প্রতিষ্ঠা, ন্যাশনাল রিসার্চ কাউন্সিল (এনআরসি) গঠন করা, এনআরসির অধীন সেন্ট্রাল রিসার্চ ল্যাবরেটরি স্থাপন ও বিদেশে কর্মরত বাংলাদেশি গবেষকদের জীবনবৃত্তান্তসহ ডিরেক্টরি তৈরির সুপারিশ করা হয়েছে। এ জন্য প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় উদ্যোগ নিতে পারে বলে এতে পরামর্শ দেয়া হয়।

সুপারিশের মধ্যে আরও আছে- অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল যাতে শিক্ষার মান নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করতে পারে, সে লক্ষ্যে ইউজিসি প্রস্তাবিত ন্যাশনাল কোয়ালিফিকেশন ফ্রেমওয়ার্ক অব বাংলাদেশের (এনকিউএফবি) খসড়াটি চূড়ান্ত করা, ফ্ল্যাগশিপ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, উচ্চ মানোন্নয়ন প্রকল্পের (হেকেপ) মতো আরও নতুন প্রকল্প গ্রহণ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় গুচ্ছভর্তি পরীক্ষা চালু করা, এসডিজি অনুসারে বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিকুলাম পরিমার্জন করা, দেশ-বিদেশের প্রথিতযশা অধ্যাপকদের লেকচার শিক্ষার্থীদের কাছে স্থাপনের লক্ষ্যে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রযুক্তিনির্ভর ক্লাসরুমের ব্যবস্থা করা, ইউজিসি ডিজিটাল ল্যাবরেটরির দেয়া ই-রিসোর্স সেবা কার্যক্রম আরও সম্প্রসারিত করা।

প্রতিবেদনে শিক্ষার্থীদের ইন্টার্নশিপ চালুর ব্যাপারে বলা হয়, ইউনিভার্সিটি-ইন্ডাস্ট্রি কোলাবরেশনের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য ৩-৬ মাসের ইন্টার্নশিপ চালু করা, যাতে চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে গ্র্যাজুয়েটদের দক্ষতা বৃদ্ধি পায়।

সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যমান সান্ধ্য কোর্স বন্ধ করা দরকার। শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা যাতে বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে দেশের সংবিধান পরিপন্থী কোনো কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে না পারে, সে জন্য নজরদারি করা। এ ছাড়া ইভটিজিং, যৌন হয়রানি, শারীরিক নির্যাতন, র‌্যাগিং ও মাদকাসক্তি প্রতিরোধের ব্যবস্থা করার সুপারিশও করা হয়েছে।

এতে আরও সুপারিশ করা হয়- ইউজিসির অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও জনবল বৃদ্ধি করা দরকার। এ ছাড়া উচ্চশিক্ষার মান বৃদ্ধির জন্য গ্রহণযোগ্য ও আন্তর্জাতিক মানের র‌্যাংকিং পদ্ধতি চালু, অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিলের সঙ্গে ইউজিসি একযোগে কাজ করা, উচ্চশিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত সব সেবা ডিজিটাইজড করা, ভিশন-২০২১, ভিশন-২০৩০ ও ভিশন-২০৪১-এর লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে উচ্চশিক্ষায় গবেষণা বরাদ্দ বৃদ্ধি, ২০২২ সালের মধ্যে জাতীয় বাজেটের ২ শতাংশ ও ২০৩০ সালের মধ্যে ৬ শতাংশ উচ্চশিক্ষায় বরাদ্দ করা।

তবে, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকল্প ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইউজিসির কয়েকজন কর্মকর্তার ঘুষ নেয়ার বিষয় টিআইবি  ও বিভিন্ন গণমাধ্যমে বারবার প্রকাশিত হলেও নিজ নিজ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার নজির নেই ইউজিসির। বরং দেখা গেছে অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের রক্ষায় লোকদেখানো কমিটি গঠন ও প্রতিবেদন জমা দিয়ে তা বছরের পর বছর গোপনই রাখা হচ্ছে। 

কয়েকবছর আগে প্রশ্নফাঁস চক্রের কয়েকজন সদস্যকে র‌্যাব পাকড়াও করেছে ইউজিসি ক্যাম্পাস থেকে। ওই ঘটনায় জড়ি ছিলো ইউজিসিরই কেউ কেউ। আবার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ঘুষ নেয়ার অভিযোগ উঠেছিল ইউজিসির বর্তমান অতিরিক্ত পরিচালক ফেরদৌসের বিরুদ্ধে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা প্রকল্প থেকে ঘুষ লেনদেনের অভিযোগে ফেরদৌস ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তার নাম আসে। যথারীতি তদন্ত কমিটি গঠন হয়। কিন্তু কমিটির প্রতিবেদন প্রকাশ হয় না।   


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি, জানালো শিক্ষা মন্ত্রণালয় স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের এমপিওর চেক ছাড় - dainik shiksha স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের এপ্রিল মাসের এমপিওর চেক ছাড় গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটে প্রথম লামিয়া - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটে প্রথম লামিয়া প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে দ্বিতীয় ধাপের চূড়ান্ত ফল আগামী সপ্তাহ - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগে দ্বিতীয় ধাপের চূড়ান্ত ফল আগামী সপ্তাহ ছাত্রলীগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিলিস্তিনের পতাকা উড়াবে কাল - dainik shiksha ছাত্রলীগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিলিস্তিনের পতাকা উড়াবে কাল চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রী যা জানালেন - dainik shiksha চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ করার বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রী যা জানালেন গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ, পাস ৩৬.৩৩ শতাংশ - dainik shiksha গুচ্ছের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার ফল প্রকাশ, পাস ৩৬.৩৩ শতাংশ কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0029850006103516