আগে বোশেখি ভাতা-পরে মঙ্গল শোভাযাত্রা

অধ্যক্ষ মুজম্মিল আলী |

এটি কোন অনাকাঙ্খিত প্রত্যাশা নয়। কোন অযৌক্তিক দাবী ও নয়। কারো করুণা কিংবা  অনুদান নয় । কোন অবাঞ্চিত চাওয়া ও নয় । বাঙ্গালি বলে একান্ত নিজের অধিকার । জাতীয় স্বকীয়তায় নিজেরই অর্জন । হ্যাঁ প্রিয় পাঠক, বলছিলাম এ দেশের পাঁচ লক্ষ এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারী ও তাদের পরিবার-পরিজনের অতিশয় ন্যায় সঙ্গত একটি দাবীর কথা । তাদের প্রিয় ‘বোশেখি ভাতা’র কথা ।

অহর্নিশ বলে যাচ্ছি -বলেই যাবো । অনেকে বলেন । আমি ও তাই বলি । কারো ন্যায় সঙ্গত অধিকার কিংবা ন্যায্য পাওনা ব্যাহত হলে নীরবে মেনে নেয়া  মহা অন্যায় । জেনে শুনে নীরব থাকি কী করে ?

যা ন্যায় সঙ্গত, তা বলে যেতে হয়। সেটিই নিয়ম । বিবেকের তাড়নায় – একান্ত বিবেকের দংশনে ।

বাংলা নববর্ষ উদযাপনের তাগিদ দিয়ে পরিপত্র এসেছে । মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজন করার নির্দেশনা । দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ৯৭% বেসরকারি ধারায় চলে । সরকারি ধারায় মাত্র ৩% । এ সব পরিপত্র বা নির্দেশনা কেবল সরকারি প্রতিষ্ঠানের জন্য , নাকি সরকারি-বেসরকারি উভয় ধারার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য ? এ ক্ষেত্রে কোন বৈষম্য তো নেই । নির্দেশনা সবার জন্য । সবার কাজ সমান । কেবল দেবার বেলা দু’ নজর । কম-বেশ করে দেয়া । বিমাতা সুলভ আচরণ আর কাকে বলে ?

দু’চোখে দেখার ফল তেমন ভাল হয় না । কোনদিন হয়নি । পাকিস্তানীরা আমাদের দু’ নজরে দেখতো । আজ তারা কই ? তামাম দুনিয়ায় অশান্তির কোন দেশ থেকে থাকলে সেটি পাকিস্তান । আমাদের দু’নজরে দেখার ফল তারা হাড়ে হাড়ে টের পেয়ে চলেছে । জীবনে ও তাদের কোনদিন শান্তি আসবে কীনা, কে জানে ?

আনন্দ ও উৎসবমুখর পরিবেশে নববর্ষ উদযাপন এবং এর সাথে মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজনের সরকারি নির্দেশ । ভাল কথা। একটার পর একটা নির্দেশ আসে। দেশের বেসরকারি শিক্ষকগণ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন সে সব নির্দেশ । কিন্তু, সংশ্লিষ্ট ভাতা ও সম্মানীর ক্ষেত্রে তাদের প্রতি যত অবহেলা আর অবজ্ঞা । এর সাথে তাদের মর্যাদার প্রশ্ন জড়িয়ে-সে কি কেউ ভেবে দেখে ?

এবার নতুন করে মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজনের নির্দেশনা । বাংলা নববর্ষের সাথে মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজন প্রাসঙ্গিক বটে । কিন্তু, বেসরকারি শিক্ষকরা নিজেদের মর্যাদা ও সম্মানের প্রশ্নে এক বছর থেকে যেটি চেয়ে আসছেন, সেই বোশেখি ভাতার কোন খবর নেই। মঙ্গল শোভাযাত্রা তাদের জন্য কী কোন মঙ্গল বয়ে আনতে পারে না ?

মঙ্গল শোভাযাত্রার মাধ্যমে বাঙ্গালীর জীবনযাত্রা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয় । প্রথমে এর নাম মঙ্গল শোভাযাত্রা ছিল না । এর একটু পেছন ফিরে দেখা যাক ।

মঙ্গল শোভাযাত্রা এখন বাংলা নববর্ষ উদযাপনের অন্যতম অনুষঙ্গ । ১৯৮৬ সালে যশোরে ‘চারুপীঠ’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান পহেলা বৈশাখে আনন্দ শোভাযাত্রা বের করে । সে শোভাযাত্রায় পাপেট, বাঘের প্রতিকৃতি, পুরনো বাদ্যসহ অনেক শিল্পকর্ম ছিল ।

১৯৮০’র দশকে স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের ঐক্য এবং একই সঙ্গে শান্তির বিজয় ও অপশক্তির ধ্বংশ কামনায় ১৯৮৯ সালে সর্বপ্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটের উদ্যোগে পহেলা বৈশাখে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের করা হয় । সে বছরই এটি ঢাকাবাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয় । সে থেকে প্রতি বছর তা অব্যাহত আছে । এর প্রধান আকর্ষণ বিশালকায় চারুকর্ম পুতুল , হাতি , কুমির ও ঘোড়াসহ বিচিত্র মুখোস ও সাজসজ্জা । সে সাথে বাদ্যযন্ত্র ও নৃত্য ।

এ বছর বাঙ্গালির মঙ্গল শোভাযাত্রাটি ভিন্ন এক মর্যাদায় আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। আমাদের সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ের আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০১৬ খৃষ্টাব্দের ৩০ নভেম্বর বাংলাদেশের মঙ্গল শোভাযাত্রা জাতিসংঘের ইউনেস্কোর অধরা বা ইনট্যানজিবল সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান লাভ করেছে ।

মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রেক্ষাপটে খুঁজে পাই, এটি মানুষের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠায় সহায়ক । এটি শান্তির বিজয় ও অপশাসনের ধ্বংশ নিয়ে আসে । আনন্দ-উচ্ছাসে মেতে ওঠার ভিন্ন এক আহ্বান ।

বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের বোশেখি ভাতা না দিয়ে সারা দেশ জুড়ে মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন কেবলি নিস্ফল ও নিরর্থক একটি শ্রম বৈ আর কিছু নয় । বোশেখি ভাতার কারণে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদে অনৈক্যের চিড় ধরেছে । এক শ্রেণির মনে আনন্দের চেয়ে ব্যথা-বেদনা বেশী। মঙ্গল শোভাযাত্রা তাদের জন্য ‘কাটা গায়ে লবনের ছিটা’র মত।

পহেলা বোশেখের আর মাত্র ক’টা দিন বাকি । আজ-কালের মধ্যে একটা সার্কুলার জারি করে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের বোশেখি ভাতা প্রদান করুণ । তা না হলে নববর্ষ ও মঙ্গল শোভাযাত্রার সকল আয়োজন ব্যর্থ হবে । জোর করে আনন্দ করানো যায় না । এর জন্য মনে আনন্দ থাকতে হয় । এবারের নববর্ষের প্রাক্ষালে দেশের এমপিওভুক্ত কোন শিক্ষক-কর্মচারীর মনে বিন্দুমাত্র আনন্দ নেই । আগে তাদের মনে আনন্দটুকু জাগ্রত করুণ । তাহলে  নববর্ষ উদযাপন ও মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজনের জন্য কোনো পরিপত্র জারি করা লাগবে না ।

মুজম্মিল আলী: অধ্যক্ষ, চরিপাড়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, কানাইঘাট, সিলেট ও দৈনিকশিক্ষার নিজস্ব সংবাদ বিশ্লেষক।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ভুইফোঁড় শিক্ষক সমিতি নেতাদের এমপিও বাতিল হতে পারে - dainik shiksha ভুইফোঁড় শিক্ষক সমিতি নেতাদের এমপিও বাতিল হতে পারে শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবইয়ের সংশোধনী প্রকাশ - dainik shiksha শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবইয়ের সংশোধনী প্রকাশ ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের জাপান টিকিট ৩০ লাখ! - dainik shiksha ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের জাপান টিকিট ৩০ লাখ! যৌন হয়রানি: ঢাবি শিক্ষক নাদির জুনাইদকে অব্যাহতি - dainik shiksha যৌন হয়রানি: ঢাবি শিক্ষক নাদির জুনাইদকে অব্যাহতি জাল সনদধারী শিক্ষকের এমপিও বাতিল - dainik shiksha জাল সনদধারী শিক্ষকের এমপিও বাতিল অভিযুক্ত শিক্ষা সাংবাদিকদের পক্ষে জোর তদবির - dainik shiksha অভিযুক্ত শিক্ষা সাংবাদিকদের পক্ষে জোর তদবির কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে যৌ*ন হয়*রানি: ঢাবি শিক্ষক নাদির জুনাইদকে অব্যাহতি - dainik shiksha যৌ*ন হয়*রানি: ঢাবি শিক্ষক নাদির জুনাইদকে অব্যাহতি দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে ষষ্ঠ-নবম শ্রেণিতে ষাণ্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়নের সূচি - dainik shiksha ষষ্ঠ-নবম শ্রেণিতে ষাণ্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়নের সূচি please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.002565860748291