বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও ইতিহাসবিদ এ.আর মল্লিকের আজ জন্মদিন। তার পুরো নাম আজিজুর রহমান মল্লিক। তিনি ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দের আজকের এই দিনে বৃহত্তর ঢাকা জেলার ধামরাই উপজেলার রাজাপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে এ.আর মল্লিক ছিলেন সবার বড়। তার শৈশব কেটেছে রেঙ্গুনে। বাড়িতে গৃহ শিক্ষকের নিকট তিনি প্রথমে আরবি ও কোরান শিক্ষা লাভ করেন। এরপর রেঙ্গুনের একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি হন। বাবা মোহাম্মদ ইসমাইল মল্লিক চাকরি সূত্রে তখন সপরিবারে রেঙ্গুনে অবস্থান করছিলেন। সপ্তম শ্রেণিতে পড়াকালে পারিবারিক কারণে তাদের সবাইকে ঢাকা ফিরে আসতে হয়। ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দে মানিকগঞ্জ মডেল হাই স্কুল থেকে তিনি মেট্রিক এবং ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা সরকারি কলেজ থেকে আইএ পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে ভর্তি হন। তিনি ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে উক্ত বিভাগ থেকে বিএ অনার্স এবং ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে এমএ পাস করেন। এমএ শেষ বর্ষের ছাত্র থাকাকালে তিনি সলিমুল্লাহ মুসলিম হল থেকে প্রকাশিত প্রথম ইংরেজি ম্যাগাজিনের সম্পাদনার কাজ করেন।
এ.আর মল্লিক ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে প্রভাষক পদে যোগদান করেন। কিন্তু পরবর্তীতে ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দে চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে যোগদানের একমাসের মধ্যে তাকে রাজশাহী কলেজে বদলি করা হয় এবং সে সময় থেকে ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি রাজশাহী সরকারি কলেজেই কর্মরত ছিলেন। ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি লন্ডনে যান ও ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি স্কুল অব অরিয়েন্টাল এ্যান্ড আফ্রিকান ষ্টাডিস (লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়) থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। দেশে ফিরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে যোগ দেন। এখানে তিনি কলা অনুষদের ডীন এবং তৎকালীন জিন্নাহ হলের (বর্তমান শেরেবাংলা হল) প্রাধ্যক্ষ ও কিছুদিন লাইব্রেরিয়ানের দায়িত্বও পালন করেন। ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে ড. মল্লিক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিযুক্ত হন। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম-এ তার সক্রিয় ভূমিকা ছিলো।
৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পরেই তিনি চট্টগ্রামবাসীকে সংগ্রামী আন্দোলনের প্রস্ত্ততি নিতে আহ্বান জানান ও বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা ওড়ান। তিনি প্রথমে চট্টগ্রামে অবস্থান করে মুক্তিযুদ্ধের সমন্বয়কারী হিসেবে যুদ্ধ পরিচালনার গুরু দায়িত্ব পালন করেন ও তার সহযোগিতায়ই চট্টগ্রাম বিশ্বদ্যিালয় মুক্তিযোদ্ধাদের নিরাপদ ঘাঁটিতে পরিণত হয়। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে তাকে সভাপতি করে কলকাতায় গঠিত হয় ‘বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি’। যুদ্ধ চলাকালে এ সমিতি তার সর্বাত্মক অবদান রাখে। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষে জনমত সংগ্রহের লক্ষ্যে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশসহ যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন শহর ভ্রমণ করেন ও বক্তব্য প্রদান করেন। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের মন্ত্রিসভার প্রথম শিক্ষা সচিবের দায়িত্বসহ ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশের প্রথম হাই কমিশনারের দায়িত্ব পালন করেন। হাই কমিশনার থাকাকালে বিভিন্ন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি আদায়, পাকিস্তান থেকে বাঙালিদের ফিরিয়ে আনা, রিফিউজি সমস্যা মোকাবেলা প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দের শেষভাগে ড. মল্লিক বাংলাদেশ সরকারের প্রদত্ত অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব কৃতিত্বের সঙ্গে পালন করেন। তিনি তাজউদ্দিন আহম্মেদ এর স্থলাভিষিক্ত হন। ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়এর ইতিহাস বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে উক্ত বিভাগের প্রফেসর এমেরিটাস হন। একই বছর তিনি ‘বাংলাদেশ ন্যাশনাল ব্যাংক’ প্রতিষ্ঠা করেন এবং ১৯৯৩ পর্যন্ত তিনি ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন।
এ.আর মল্লিক একাধিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি বাংলা একাডেমির ফেলো, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি এবং বাংলাদেশ ইতিহাস সমিতি’র সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে British Policy and the Muslims in Bengal, 1757-1856 শিরোনামে তার পিএইচডি অভিসন্দর্ভ প্রকাশিত হয়। আমার জীবনকথা ও বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম প্রফেসর মল্লিকের রচিত এক অনবদ্য আত্মজীবনী। ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দের ৪ ফেব্রুয়ারি আজিজুর রহমান মল্লিক মৃত্যুবরণ করেন।