আবদুল্লাহ্ আবু সায়ীদ, একটি বেনামি বাস্তব গল্প

আবু এন এম ওয়াহিদ |

সাম্প্রতিক বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে আলোচিত, পরিচিত ও জনপ্রিয় মানুষদের মাঝে নিঃসন্দেহে অধ্যাপক আবদুল্লাহ্ আবু সায়ীদ অন্যতম। তাঁর এই জনপ্রিয়তা আজকের বা ইদানীংকালের নয়। জনপ্রিয়তার রাজত্বে তিনি রাজা হয়ে বিরাজ করছেন প্রায় চার যুগ ধরে। শিক্ষার্থীদের মনে ভালোবাসার জায়গা দখল করার এ যাত্রাপথে তাঁর পথচলা শুরু হয় ষাটের দশকের গোঁড়া থেকেই যখন তিনি কলেজ অধ্যাপনায় যোগ দেন। শুরু থেকেই স্যারের বিদ্যা বিলাবার গতিবেগ এতটাই শ্লথ ও ধীরস্থির ছিল যে, তাঁর হাতে সারা বছরেও রবি ঠাকুরের ‘হৈমন্তী’ শেষ হয়েও শেষ হত না!

কলেজ প্রশাসনের কাছে এটা আশ্চর্যের কিছু ছিল না, সাগরেদরাও এ নিয়ে উচ্চবাচ্য করত না, এমন কি তাদের কোনো আফসোসও ছিল না। থাকবেই বা কেন, ওস্তাদের সাহিত্যরসের ভরা কলসি যে গলা উপচিয়ে গা গড়িয়ে ফোঁটা ফোঁটা হয়ে পড়ে শিক্ষার্থীদের হৃদয়-মনকে সদা সিক্ত করে দিত, সে কথা তাঁর সংস্পর্শে  যেই এসেছে তার না জানার কথা নয়! তাই তো তরুণ বয়সে এই সফল শিক্ষকের বাংলা ক্লাসে যারা বসত তাদের কাছে জ্ঞানার্জনের চেয়ে সাহিত্যানুরাগ ও ভাবের অনুভবটাই ছিল বড়। ভাবের সঙ্গে ভালোবাসার একটি সম্পর্কও আছে বৈকি।

আর এই সম্পর্কের কারণে অধ্যাপক সায়ীদের ছাত্ররা তাঁর একটি ক্লাস শেষ হতে না হতেই আরেকটি ক্লাসের জন্য অধীর আগ্রহে উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করত। গুরু-শিষ্যের এমন প্রেম বাস্তবিকই বিরল! জ্ঞানতাপস এই মানুষটির শিক্ষকতা জীবনের উজ্জ্বলতম দিনগুলো কেটেছে ঢাকা কলেজে। দুর্ভাগ্যবশত, এমন কলেজে পড়ার মত সৌভাগ্য নিয়ে আমি জন্মাইনি। সুদূর সিলেটের একটি থানা সদরের স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেছিলাম বলেই হয়তো বা রাজধানী শহরের ওই নামি কলেজের নামই জানতাম না, ভর্তি হওয়া তো দূরে থাক। অবশ্য ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দের সিলেটের এমসি কলেজে গিয়ে যখন ঢুকলাম তখন এই নিবেদিতপ্রাণ বিদ্যানুরাগীরই এক সতীর্থ ও ঘনিষ্ট বন্ধু আব্দুল মান্নান সৈয়দকে আমরা পেলাম বাংলা বিভাগের একক অধ্যাপক হিসেবে।

কলেজভবনের প্রথম তলায় বিশাল অডিটোরিয়ামে স্যারের বাংলা ক্লাস – সে তো বিদ্যাপাঠ নয়, আমাদের জন্য এ যেন ছিল যাদু দর্শনের মত! স্যারের বক্তৃতা মন্ত্রমুগ্ধের মত তন্ময় হয়ে শুনতাম। তাঁর হাঁটা, তাঁর দাঁড়ানো, তাঁর বসা, এক হাতে বই খুলে ধরা, বাচনভঙ্গি, ইত্যাদি আজো চোখের সামনে ভাসে। স্যারের মধুর মধুর সব কথা, তাঁর কন্ঠস্বর  থেকে থেকে এখনো যেন কানে বাজে। এমন গুরুর শিষ্য হওয়াও কম  গৌরবের বিষয় নয়। পড়াতে পড়াতে তিনি আমাদেরকে যে স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, মরীচিকার মত আজো তার পেছনেই ছুটছি, ধরতে পারিনি। স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেলো। এতেও এক ধরনের প্রাশন্তি মিলে, স্বপ্ন পূরণে মোহভঙ্গ হওয়ার ভয় থাকে না! বেশ ক’বছর হলো, মান্নান স্যার দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছেন। রেখে গেছেন তাঁর সুযোগ্য প্রিয় বন্ধুকে যিনি একাই দু’জনের জীবনস্বপ্নকে আরো সমৃদ্ধ ও সম্প্রসারিত করে সগৌরবে সেগুলোকে একের পর এক বাস্তবায়ন করে চলেছেন।

শিক্ষকতা জীবনের প্রথম দিকে যারা তাঁর সরাসরি ছাত্র ছিল শুধু তারাই অধ্যাপক আব্দুল্লাহ্ আবু সায়ীদকে চিনত, তারাই জানত, কিন্তু বুঝত কি না জানি না। সায়ীদ স্যারকে বোঝতে পারা না পারার ব্যাপারে কেন আমার এই সংশয়? কারণ হলো, আব্দুল্লাহ্ আবু সায়ীদের প্রায় প্রতিটি কথার বাহ্যিক অর্থ যাই থাকুক না কেন, তার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, মর্মবাণী ও গূঢ় অর্থের শিকড় মানুষের ভাবনাজ গতের অনেক গভীওে প্রোথিত। সীমিত জ্ঞান, স্থুলবুদ্ধি এবং সংকীর্ণ মন ও মনন নিয়ে আমরা ক’জনই বা তাঁর সব কথা বোঝার চেষ্টা করি, বুঝতে পারি, হৃদয়ঙ্গম করতে পারি! ব্যক্তিগত জীবনে মানা, না মানা, অনুসরণ করা করা না করা – সে তো অনেক পরের কথা। তাই শুরুতে সীমাবদ্ধ জনপ্রিয়তার মাঝে সায়ীদ স্যারের প্রকৃত শিষ্য ও প্রকৃত বন্ধু ছিল হাতে গোনা কয়েক জন।

আরো কিছু দিন গড়িয়ে গেলে, অধ্যাপক সায়ীদ নিয়মিত বিটিভির অনুষ্ঠানে অংশ নিতে আরম্ভ করেন। তখন থেকে তাঁর নামডাক ঢাকা কলেজের চার দেওয়াল পেরিয়ে আস্তে আস্তে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। সাধারণ শিক্ষিত মানুষের মাঝে তিনি পরিচিতি পেতে থাকেন। তাঁর মত শিক্ষক তো আরো অনেকেই ছিলেন এবং এখনো আছেন, অন্যদের তুলনায় তাঁর যশ, খ্যাতি ও পরিচিতি এত বেশি হলো কেন? এক কথায় এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া খুবই মুশকিল। মানুষ বুঝুক বা না বুঝুক, ব্যক্তিত্বের বল ও মুখের কথা দিয়েই স্যার আসর মাত করে দিতেন এবং এখনো দেন। তাঁর বাণীপ্রধান বক্তব্য শুনেই সবাই মুগ্ধ হয়ে যায়। সায়ীদ স্যারের শব্দ চয়ন, বাক্য বিন্যাস, পরিমিত রসবোধ, যুক্তির যথার্থতা ও সর্বোপরি বলার ভঙ্গি ও বক্তব্যের গভীরতা প্রতি মুহূর্তে আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, তিনি একজন কথার যাদুকর, রসে ভরা চির তরুণ এক রসিক মানুষ। কৌতুক ও হাস্যরসের মাধ্যমে তিনি জীবন যৌবনের কথা, জ্ঞানের কথা, শিল্প সাহিত্যের কথা, গভীর ঐতিহাসিক ও দার্শনিক তত্ত্বকথা, দেশপ্রেম, দেশ ও মানুষ গড়ার কথা অবলীলায় অনর্গল বলে  যেতে পারেন। গন্ডায় গন্ডায় এমন গুণী মানুষ শুধু বাংলাদেশ কেন দুনিয়ার যে কোনো দেশেই মেলা ভার। তাঁর কাপড়চোপড়, চালচলন, জীবনযাপন অতি সাধারণ। সাধারণ হয়েও চরিত্রের সততা ও কথার সম্মোহনী শক্তিতে তিনি অসাধারণ হয়ে আছেন।

তিনি কি কেবল কথারই যাদুকর? এটাই কি তাঁর একমাত্র পরিচয়?। না, তিনি কাজেও করিৎকর্মা, পারঙ্গম। তাঁর কাজ মানুষ গড়া, মানুষের মনকে বিকশিত করা, কিশোর-তরুণদের সুনাগরিক হিসেবে তৈরি করা যাতে তারা দেশটাকে, সমাজটাকে সঠিকভাবে, সুন্দরভাবে বিনির্মাণ করতে পারে। এ কাজটি তিনি আরো কার্যকরভাবে আরো ছড়িয়ে দিতে শুরু করেন আরেকটু পরে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সূচনালগ্ন থেকে।  এই কেন্দ্রের মাধ্যমে তিনি দেশব্যাপী ‘আলোকিত’ মানুষ গড়ার নতুন এক আন্দোলন গড়ে তুলেন। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরির মাধ্যমে স্যার পাড়ায় পাড়ায় বই বিলাতে লাগলেন, বইয়ের অনুরাগী পাঠক  তৈরি করতে লাগলেন। এভাবে তিনি মানুষের মাঝে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দেওয়ার মত বন্ধুর এক যাত্রাপথে পা বাড়ান। মানুষ গড়ার সাথে সাথে তিনি মানুষের জন্য নিরাপদ বাসস্থান নিশ্চিতের আশায় দেশের মাটি, পানি ও হাওয়াকে সুরক্ষা দিতে সচেষ্ট হন,  অর্থাৎ তিনি পরিবেশ আন্দোলনের এক জন সক্রিয় সহকর্মী হয়ে ওঠেন। তাঁকে একবার বলা হয়েছিল, আপনি পরিবেশের কথা বলেন, আপনি পরিবেশের কে? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আমি পরিবেশের লাঠিয়াল’। স্যার একটি অপ্রত্যাশিত প্রশ্নের একটি অপ্রত্যাশিত উত্তরই দিয়েছিলেন!

বইপুস্তক বিলিয়ে, বই পড়ায় মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে করতে তিনি ‘আলোকিত’ মানুষ সৃষ্টি করতে লাগলেন। আজ বাংলাদেশের ‘আলোকিত’ মানুষ বলতে যাঁর চেহারা আমার চোখের সামনে ভাসে তিনি আর কেউ নন, তিনি অধ্যাপক আব্দুল্লাহ্ আবু সায়ীদ। তাঁর নামের সাথে আজ আর কোনো বিশেষণ যুক্ত করার প্রয়োজন পড়ে না। অনেকে তাঁকে ‘আলোকিত’ মানুষ গড়ার কারিগর বলে থাকেন। অনেক দিন ধরে তিনি ‘আলোকিত’ মানুষ গড়ছেন, তাই বলে কি তিনি নিজে ‘আলোকিত’? আপনারা ভ্রু কুঁচকিয়ে বলতে পারেন, এমন প্রশ্ন কেন?

নিজে ‘আলোকিত’ না হলে তিনি কেমন করে ‘আলো’ ছড়াচ্ছেন? কেমন করে ‘আলোকিত’ মানুষ বানাচ্ছেন? না, ব্যাপারটা তা নয়। তাঁর নিজের কন্ঠেই শুনুন, এ প্রসঙ্গে তিনি কী বলেছেন। একবার তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘স্যার, আলোকিত মানুষ কে?’ তিনি অত্যন্ত ধীরস্থিরভাবে, সুন্দরভাবে, খুব সুন্দর একটি উত্তর দিয়েছিলেন। তাঁর জবাব শুনে আমার মনটা ভরে গেল। তিনি বললেন, ‘মানুষ ‘আলোকিত’ হয় না, কোন মানুষই ‘আলোকিত’ নয়। অন্ধকার থেকে ক্রমাগত আলোর দিকে এগিয়ে যাওয়ার নিরন্তর প্রচেষ্টাই ‘আলোকিত’ মানুষের বৈশিষ্ট্য’।  অন্য কথায় বলতে গেলে, ‘আলোকিত’ মানুষ হলো একটি স্বপ্নের নাম, এই স্বপ্ন পূরণে যারা একটু একটু করে অগ্রসর হয়, তাদেরকেই আমরা ‘আলোকিত’ মানুষ বলে থাকি’। বোঝলাম, প্রকৃত অর্থে জগতের কোনো মানুষই ‘আলোকিত’ নয়। ‘আলোকিত’ মানুষ গড়ার করিগর সায়ীদ স্যার নিজেও নন! তাহলে সবই কি অন্ধকার। কোথাও কি আলো নেই? রবীন্দ্রনাথ যে বলেছেন, ‘অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো…’। ‘আলোর’ এই উৎসটি কে?  তিনি আর কেউ নন, তিনিই ‘নূরুন আ’লা নূর’, ‘আলোর’ ওপরে ‘আলো’, আপন ‘আলো’য় আপনি উদ্ভাসিত, আপনা থেকেই আপনি প্রশংসিত!

আবু এন এম ওয়াহিদ: শিক্ষক


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মাকে নির্যাতনের অভিযোগ শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস - dainik shiksha শিক্ষার্থী বিক্ষোভের মধ্যে ইহুদিবিদ্বেষ নিয়ে বিল পাস সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল - dainik shiksha সপ্তদশ জুডিশিয়াল সার্ভিস পরীক্ষা কাল দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা - dainik shiksha রোববার থেকে প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলা শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা - dainik shiksha শনিবার থেকে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0022690296173096