আবরারের জন্য নদীর কান্না

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

বুয়েটে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার আবরার ফাহাদ নদী ভালোবাসতেন। ইতিমধ্যে 'রিমেম্বারিং' হয়ে যাওয়া ফেসবুক অ্যাকাউন্টে এই মেধাবী শিক্ষার্থী নিজের নয়টি 'ফিচার ফটো' দিয়েছিলেন। তার মধ্যে অন্তত চারটি ছবি নদীর সঙ্গে। আবরার আসলে নদীর সঙ্গেই বেড়ে উঠেছেন। তার পৈতৃক বাড়ি কুষ্টিয়ার কুমারখালীর রায়ডাঙ্গা গ্রামটি গঙ্গা ও গড়াই নদীর 'দোয়াব'। তার বাড়ি থেকে উত্তর, দক্ষিণ, পশ্চিম, যেদিকে হাঁটা যায়, সেদিকেই নদী এসে সামনে দাঁড়ায়। বাংলাদেশের দুটি বড় নদীর তীরে শৈশব কাটানো একটি ছেলের নদীর প্রতি ভালোবাসা স্বভাবতই অন্য অনেকের চেয়ে বেশি। শুক্রবার (১১ অক্টোবর) সমকাল পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে  এ তথ্য জানা যায়।

নিবন্ধে আরও বলা হয়, দুর্ভাগ্যজনক কাকতাল, বুয়েট ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সোমবারের সেই কালরাতে আবরারের ওপর হামলে পড়ার সঙ্গেও জড়িত নদীর বিষয়। বাংলাদেশ ও ভারতের অভিন্ন নদী ফেনী থেকে ত্রিপুরার সাবরুম শহরের জন্য পানি উত্তোলন নিয়ে সম্প্রতি যে সমঝোতা হয়েছে, আবরার ফাহাদ সে ব্যাপারে নিজে মত জানিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছিলেন। বিস্ময় প্রকাশ করে লিখেছিলেন- ভারতের এক রাজ্য যেখানে অন্য রাজ্যকে পানি দিতে চায় না, সেখানে আমরা কোনো বিনিময় ছাড়াই দেব! খুবই ন্যায্য কথা। বস্তুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের সফরে যদি তিস্তার ব্যাপারে সুরাহা হতো, তাহলে আমার ধারণা, ফেনী নদীর চুক্তি নিয়ে এত কথা উঠত না। আর কথা উঠলেই-বা কী? তার জের ধরে পিটিয়ে মেরে ফেলতে হবে!

আমরাও নদী নিয়ে নানা সময় মতপ্রকাশ করি। স্বাভাবিকভাবেই অপ্রিয় সত্য সবসময় সবার পছন্দ হয় না। দখল-দূষণকারী, পানি প্রত্যাহারকারী, বালু উত্তোলনকারীদের তো নয়ই; খোদ বন্ধুদেরই সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয় আমাদের। কিন্তু আবরার ফাহাদের মতো 'খেসারত' কাউকে কি দিতে হয়েছে? নদী আন্দোলন করতে গিয়ে নিহত হওয়ার নজির বিরল নয়। নদী হত্যাকারীরা সারাবিশ্বেই শক্তিশালী পক্ষ। কিন্তু তাদের কাউকেই উল্লিখিত বিষয়ের সঙ্গে নূ্যনতম সম্পর্কহীন এক যুযুধান দঙ্গলের হামলার মুখে পড়তে হয়েছে- এমন নজির নেই। আবরার নিজের ফেসবুক ওয়ালে ফেনী নদী সমঝোতা নিয়ে সমালোচনা করেছেন, তাতে বুয়েট ছাত্রলীগের কী?

আক্ষেপ করে আমার ফেসবুক ওয়ালে লিখেছিলাম- 'বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ নিজের মতপ্রকাশের জন্য খুন হননি; খুনিরা বরং নিজেদের ক্ষমতা প্রকাশে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। এদের যদি ইচ্ছা হয়, আপনি নিশ্চুপ থেকেও খুন হতে পারেন। তাদের পক্ষে থেকেও অনেকে খুন হয়েছেন। পুরো বিষয়টি আসলে ক্ষমতার। কার ক্ষমতা কত বেশি, সেটা প্রদর্শন করাই ব্যাপার। আপনি মতপ্রকাশ করেন বা না করেন; তারা চাইলে আপনাকে এড়িয়ে যেতে পারে, চাইলে মেরেও ফেলতে পারে। আপনার জীবন তাদের কাছে নিছক মেজাজ-মর্জির বিষয়, তুড়িয়াকা মামলা।'

নিজের মধ্যে এই প্রশ্নও জেগেছিল- পাষণ্ড ওই খুনিরাও কি নদীমাতৃক বাংলাদেশের সন্তান? আবরারের মতো তাদের শৈশব নদীর সঙ্গে কেটেছে কি-না, খোঁজ নেওয়ার রুচি হয়নি। তাদের ফেসবুক ওয়ালেও এটা দেখতে যাওয়ার গরজ তৈরি হয়নি যে, নদীর প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ কোথাও রয়েছে কি-না। সবাই মিলে যেভাবে পিটিয়ে পিটিয়ে এক প্রাণবন্ত তরুণকে হত্যা করেছে, তাতেই তাদের পৈশাচিকতা স্পষ্ট। ওই দৃশ্য কল্পনা করলে হায়েনার কবলে পড়া হরিণশাবকের নিরুপায় পরিস্থিতির কথা মনে হয়। হিংস্র অন্যান্য পশুর সঙ্গে হায়েনার পার্থক্য হচ্ছে, তারা দলবেঁধে আসে এবং শিকারকে দীর্ঘ সময় নিয়ে হত্যা করে। যন্ত্রণা দিয়ে দিয়ে। আবরার ফাহাদকে হায়েনার কায়দায় হত্যাকারীরা নদী ভালোবাসবে কীভাবে? কোথাও পড়েছিলাম- সংবেদনশীল মানুষের প্রধান পাঁচটি চিহ্নের একটি হচ্ছে, তারা নদী ভালোবাসে। আবরারের হত্যাকারীরা সংবেদনশীল হতে পারে না।

আবরার ফাহাদ সংবেদনশীল ছিলেন, নদীর প্রতি ভালোবাসা তার প্রমাণ। দেশের প্রাণপ্রবাহ নদীগুলোর জন্য তার কান্নায় ফেসবুকের পৃষ্ঠাগুলো ভেজা।

নদীও কি কাঁদে? সুবীর নন্দী গাইতেন, ঝর্ণা আসলে পাহাড়ের কান্না। পাহাড়টা বোবা বলে শব্দ হয় না। বর্ষণমুখর এক দিনে চিলমারী ঘাটে ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে বসে এক সাধক আমাকে বলেছিলেন, ভালোমানুষ মারা গেলে আকাশ কাঁদে, তাই বৃষ্টি হয়। আমি নিশ্চিত, নদীও কাঁদে। বাংলাদেশের নদনদী আবরার ফাহাদের জন্য কাঁদছে। সেই কান্না শোকের ও ক্ষোভের। নদী বোবা নয়; আমরা কালা বলে শুনতে পাচ্ছি না।

শেখ রোকন : লেখক ও গবেষক; মহাসচিব, রিভারাইন পিপল।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা - dainik shiksha দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার চাকরির বয়স নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর চিঠির পর সমাবেশের ডাক দিলো ৩৫ প্রত্যাশীরা - dainik shiksha চাকরির বয়স নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর চিঠির পর সমাবেশের ডাক দিলো ৩৫ প্রত্যাশীরা স্কুলে গ্রীষ্মের ছুটি কি এপ্রিলে এগিয়ে আনা দরকার? - dainik shiksha স্কুলে গ্রীষ্মের ছুটি কি এপ্রিলে এগিয়ে আনা দরকার? কলেজের শিক্ষকদের ডিজিটাল বদলির আবেদন শুরু রোববার - dainik shiksha কলেজের শিক্ষকদের ডিজিটাল বদলির আবেদন শুরু রোববার বুটেক্সের প্রথম সমাবর্তন ৭ সেপ্টেম্বর - dainik shiksha বুটেক্সের প্রথম সমাবর্তন ৭ সেপ্টেম্বর শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি: শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি: শিক্ষা মন্ত্রণালয় দুর্যোগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটিতে বিশেষ কমিটি গঠনে নীতিমালা হবে: শিক্ষামন্ত্রী - dainik shiksha দুর্যোগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটিতে বিশেষ কমিটি গঠনে নীতিমালা হবে: শিক্ষামন্ত্রী দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.004033088684082